X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

‘এটি শুধু সেতু নয়’

রেজোয়ান হক
২৫ জুন ২০২২, ০০:০৩আপডেট : ২৫ জুন ২০২২, ১৪:৫৭

বিশ্বের বড় বড় সেতুগুলো সম্পর্কে জানতে গুগলে সার্চ দিলাম। জানা গেলো সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু চীনের ডানইয়াং-কুনশান গ্র্যান্ড ব্রিজ, যা আজ থেকে একযুগ আগে নির্মিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ১৬৪.৮ কিলোমিটার। আর আমাদের পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য মাত্র ৬.১৫ কিলোমিটার। দৈর্ঘ্যের দিক বিবেচনায় পদ্মা সেতু হতে যাচ্ছে বিশ্বের ১২২তম সেতু। তারপরও বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো এই সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করছে। চীন, রাশিয়া, জাপান, ইতালি, সৌদি আরব, ভারতের মতো দেশগুলোর পর সবশেষে অভিনন্দন জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান। এই দুটো দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, দেরি করলেও শেষ পর্যন্ত অভিনন্দন না জানিয়ে পারেনি। একটা সেতুর জন্য বিশ্বের কাছ থেকে এমন প্রশংসা অস্বাভাবিক মনে হওয়াই স্বাভাবিক। এটা সম্ভব হবার কারণ- এটি শুধু একটি সেতু নয়।

পদ্মা সেতু বিশ্বদরবারে দেশের সক্ষমতার সর্বশেষ এবং বিশেষ প্রতীক। আমাজন নদীর পর বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী পদ্মার ওপর এ সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে তিনটি বিশ্বরেকর্ড হয়েছে।

খরস্রোতা পদ্মাকে বশে আনতে যে পাইল পোতা হয়েছে তা বিশ্বে গভীরতম। এজন্য জার্মানি থেকে তৈরি করে আনতে হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী হ্যামার। মোট ২৯৪টি পাইলে ভর করে মাথা তুলেছে সেতুর ৪২টি পিলার, যার ওপর বসেছে ৪১টি স্প্যান।

নদীর তলদেশের গভীরে নরম কাদামাটির স্তর থাকায় ২২টি পিলারের নকশায় পরিবর্তন এনে বিশেষ প্রকৌশল জ্ঞান প্রয়োগ করতে হয়েছে। আট মাত্রার ভূমিকম্প, চার হাজার টন জাহাজের ধাক্কা সামলাতে পিলার আর স্প্যানের মাঝে বসানো হয়েছে ১০ হাজার টন সক্ষমতার বিয়ারিং,যা আরেকটি বিশ্বরেকর্ড।

তৃতীয় বিশ্বরেকর্ড হলো নদী শাসন সংক্রান্ত। দুই পাড়ের ১৪ কিলোমিটার এলাকা শাসন করতে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। নদী শাসনের ফলে শুধু সেতুটিই সুরক্ষিত হবে না, পাশাপাশি শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের প্রায় সাড়ে ১২ কিলোমিটার এলাকার ১১ হাজার হেক্টর জমি এবং মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের দেড় কিলোমিটার এলাকার দুই হাজার হেক্টর জমি ভাঙনের কবল থেকে নিরাপদ থাকবে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।

নদীর প্রচণ্ড স্রোত, ভয়ংকর ভাঙন আর ধসকে বশে এনে যেভাবে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে তা প্রকৌশল জগতে এক বিস্ময়। ভবিষ্যতে কোন দেশে এরকম জটিল পরিবেশে অবকাঠামো নির্মাণ করতে গেলে পদ্মা সেতুকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে হবে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

প্রকৌশলগত নতুন নতুন জ্ঞান প্রয়োগ করে নির্মিত পদ্মা সেতু শুধু এসব কারণেই বিশ্বাসীর নজর কাড়েনি, এর রাজনৈতিক দিকও সকলকে চমকে দিয়েছে। বিশাল এই প্রকল্পে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া, কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ করতে প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সিদ্ধান্ত, বিশ্বব্যাংকের তোলা দুর্নীতির অভিযোগ আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হবার পর তাদের ফিরে আসার কথা জানানো, কিন্তু বাংলাদেশের রাজি না হওয়া। এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই, কারণ দেশবাসী এসব জানেন।

বিশ্বনেতারাও তা জানেন এবং উপলব্ধি করেন বলে সোয়া ৬ কিলোমিটারের মামুলি দৈর্ঘ্যের একটি সেতুর ব্যাপারেও তারা বাংলাদেশকে বাহবা দিচ্ছেন। কিন্তু গর্বের এই বিষয়টিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশে প্রচলিত রাজনীতির বিষয় হওয়া থেকে রেহাই পায়নি। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের সমমনারা ক্রমাগত বলে চলেছেন সেতু নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে। তারা সব ক্ষেত্রেই একই অভিযোগ করে বলে এক্ষেত্রে তা ততটা গুরুত্ব না পেলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ এবং বিশ্বের বহু দেশ এর প্রশংসা করায় বিএনপি এক্ষেত্রে একটু সদয় হতে পারতো। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বেগম খালেদা জিয়াই পদ্মা সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন- এমন দাবি করে তারা সেতুটি নির্মাণের কৃতিত্বের ভাগ নিতে চাইলেও যে সরকার নানা বাধাবিপত্তি মাড়িয়ে দেশের টাকায় এত বড় প্রকল্পটি শেষ করলো তাদের কোনও কৃতিত্ব দিতে নারাজ।

সে যাক, প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচে নির্মিত এই সেতু জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক দুই তিন শতাংশ বাড়াবে,সেতুকে ঘিরে গড়ে উঠবে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বাড়বে শিল্পায়ন। সেতুটি এশিয়ান হাইওয়ের সাথে সংযোগের বড় লিংকও বটে। তবে এ ধরনের ভারী ভারী পরিসংখ্যানে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কম। তারা খুশি এই সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করবে সে জন্য।

২০১৯ সালের সেই ঘটনাটি নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে। মুমূর্ষু রোগী নিয়ে ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে অ্যাম্বুলেন্স। পার হতে পারছে না নদী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা ফেরির জন্য। এভাবে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটে ফেরি পেতে দেরি হওয়ায় পথেই অ্যাম্বুলেন্সে মারা গিয়েছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত নড়াইলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষ। আর কোনও মা-কে এ জন্য কাঁদতে হবে না- এর চেয়ে খুশির আর কি আছে?

আমার বাড়ি কুষ্টিয়ায়। মানিকগঞ্জের সাবেক আরিচা, বর্তমানে পাটুরিয়া ঘাট থেকে এই পদ্মা পার হয়েই রাজবাড়ী হয়ে আমাদের যেতে হয়। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, পদ্মা সেতু হয়ে গেলে দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার বেশি হবে। তারপরও আসন্ন কোরবানির ঈদে এই সেতু হয়েই যাবার নিয়ত করেছি। কারণ, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাট পার হতে যে ভোগান্তি সইতে হয়, তার চেয়ে টানা চলতে পারলে ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব কোনও ব্যাপারই না।

লেখক: বার্তা প্রধান, মাছরাঙা টেলিভিশন

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ