X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বন্যা আর উন্নয়নের বয়ান

ডা. জাহেদ উর রহমান
৩০ জুন ২০২২, ২০:০৪আপডেট : ৩০ জুন ২০২২, ২০:০৪

যে ভয়ংকর বন্যায় দেশের উত্তরাঞ্চলের কিছু জেলা, এবং বিশেষ করে সিলেট বিভাগ আক্রান্ত ছিল কিছুদিন আগে, সেটা নিয়ে আলোচনার আগে দেড় মাস পেছনে যাওয়া যাক। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত দুই সপ্তাহে সিলেট বন্যাক্রান্ত ছিল। এবারকার মতো এত বেশি এলাকায় কিংবা এত বেশি গভীরতার পানি ছিল না সেবার। সেই বন্যার সময়কার কয়েকটি সংবাদের শিরোনাম এরকম–  ‘সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, ত্রাণের জন্য আকুতি’; ‘সিলেটে ত্রাণের জন্য হাহাকার’; ‘ত্রাণ সংকটের পাশাপাশি ঘর নিয়েও দুর্ভোগে বন্যা দুর্গতরা’; ‘সিলেটে বিশুদ্ধ পানির সংকট, ত্রাণের জন্য হাহাকার’; ‘সিলেটে বন্যা: খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে ত্রাণের জন্য হাহাকার’; ‘সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি নেই, ত্রাণ নিয়ে চলছে কাড়াকাড়ি; পুলিশের লাঠিচার্জ’। 

শেষ শিরোনামের সংবাদটির কিছু অংশ এরকম– শনিবার (২১ মে) সকালে কোম্পানিগঞ্জ থানা বাজার এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করেন প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদ। তবে সেই ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয় সিলেটের বন্যার্তদের মধ্যে। এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধ্য হয়। জানা গেছে, তালিকা করে ৬ ইউনিয়নের ১২০ পরিবারের মাঝে চাল-ডালসহ শুকনো খাবার বিতরণ করেন প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী। তবে ত্রাণ নিতে আসেন কয়েকশ’ মানুষ। ফলে দেখা দেয় অপ্রতুলতা। এক পর্যায়ে ত্রাণ নিয়ে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। পরে পুলিশ পিটিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে। তবুও ত্রাণ কেড়ে নিয়ে চলে যায় অনেকেই।

আমাদের প্রচলিত প্রবচন ‘ভাত দেবার মুরোদ নাই, কিল মারার গোঁসাই’ এর প্রদর্শনী এটা। কিন্তু বন্যার মধ্যে ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়ে যাওয়া মানুষের ওপরও এমন এমন বীভৎসতা কেউ হয়ত কল্পনাও করেনি। 

সিলেটে যে বন্যা হয়েছে সেটা খুব অল্প দিন ছিল। এবং সেই বন্যা দেশব্যাপীও ছিল না; ছোট একটা অংশেই ছিল। এই ছোট একটা এলাকায় অল্প কিছু দিনের বন্যাদুর্গত মানুষদের কাছে পর্যাপ্ত দূরে থাকুক ন্যূনতম পরিমাণ ত্রাণ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয় পৌঁছে দিতে পারেনি। 

এরপর কিছুদিন আগে সিলেটে ভয়ংকর বন্যায় মানুষ যে মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন, সেটা নজিরবিহীন। খুব দ্রুত বিপুল পরিমাণ পানিতে সুনামগঞ্জ এবং সিলেট জেলার প্রায় পুরোটা তলিয়ে যাওয়া উদ্ধার কাজকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করেছিল। কিন্তু এখানেও বন্যা নিয়ে আছে সরকারের চরম অবহেলা। সিলেটে যে একটা ভয়াবহ বন্যা দেখা দিতে পারে সেটা নিয়ে পূর্বাভাস ছিল। 

দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকায় প্রকাশিত একজন প্রবাসী বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা কামাল যা বলেছেন সেটা একটু জেনে নেওয়া যাক–

‘আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলো ১০ থেকে ১৬ দিন আগেই সিলেট বিভাগ ও ভারতের মেঘালয় পর্বতের ওপর প্রচণ্ড ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা নির্দেশ করেছিল। জুন মাসের ৫ ও ১২ তারিখে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সাপ্তাহিক কৃষি সংবাদে আমার দুটি সাক্ষাৎকারে আমি স্পষ্টত করে উল্লেখ করেছিলাম জুন মাসের ১৫ তারিখের পরে সিলেট বিভাগে সম্ভাব্য বন্যার কথা’।  

এই যে এখন নানা এলাকা থেকে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেবার জন্য নৌকা পাওয়া যাচ্ছিল না, নৌকার ভাড়া কিংবা নৌকা কেনার ক্ষেত্রে হাজার গুণ পর্যন্ত মূল্য হাঁকা হচ্ছিল, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকলে তো পরিস্থিতি এত খারাপ হবার কথা ছিল না। বড় বন্যায় বিদ্যুৎ বিপর্যয় হতে পারে, তাতে মানুষের দেশলাই, মোমবাতি সহ আর কী কী লাগবে সেগুলো প্রস্তুত রাখার কথা। মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার পর তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করার কথা তো সরকারের। অথচ আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষরাও চরম খাদ্য সংকটে রয়েছেন, এমন সংবাদে মিডিয়া সয়লাব হয়ে গিয়েছিল।

কোনও দুর্যোগে মানুষ যখন সংকটে পড়ে তখন মানুষের পাশে বিশেষ করে দরিদ্র প্রান্তিক মানুষের পাশে সরকারকে দাঁড়াতে আমরা দেখি না। কিছুদিন আগেই করোনার মধ্যে নানা সংস্থার হিসাবে যখন দুই কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছিল এবং আগের দরিদ্রদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তখনও সরকারকে এসব মানুষের পাশে দাঁড়াতে খুব একটা দেখা যায়নি। 

দেশের স্বনামধন্য বেসরকারি সংস্থা যখন সানেম, ব্র্যাক-পিপিআরসি করোনার সময় তৈরি হওয়া নতুন দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা করেছিল, দারিদ্র্যের সংখ্যা বলেছিল, তখন সরকারের দিক থেকে সেটাকে নাকচ করা হয়েছিল। মজার ব্যাপার এই গবেষণা পরিচালনা করে দারিদ্র্যের সংখ্যা জানার মতো প্রতিষ্ঠান (বিবিএস, বিআইডিএস) সরকারেরও আছে। কিন্তু সেগুলো কোনও গবেষণাই পরিচালনা করেনি। যে সরকার দারিদ্র্যের নতুন স্বরূপ এবং সংখ্যা জানতে চায় না, দরিদ্রদের জন্য কাজ করতে সেই সরকারের সদিচ্ছা কতটা, সেটা খুব স্পষ্ট।

সিলেট, সুনামগঞ্জের বন্যার পানি নেমে গেছে। কিন্তু বিশেষ করে সিলেটে যে বন্যা হয়েছে সেখানে পানির তোড়ে বহু মানুষের ঘরবাড়ি ভেসে যেতে দেখেছি আমরা। সেই মানুষগুলো যখন ফিরবে কীভাবে তারা আবার তাদের আগের জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবে? যে সরকারটি চরম দুর্গত অবস্থায় শুধুমাত্র বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের যথেষ্ট সাহায্য করে না, সেই সরকার তার পুনর্বাসনে এগিয়ে আসবে এই আশা কি করা যায় কোনোভাবে? 

যেহেতু সরকার দুর্যোগের সময় নাগরিকদের সাহায্যে পর্যাপ্তভাবে এগিয়ে আসে না, তাই প্রতিটি দুর্যোগের সময় দেখা যায় নানা বেসরকারি সংস্থা, সামাজিক সংগঠন, কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা চাঁদা তুলে ত্রাণ নিয়ে যান বিভিন্ন এলাকায়। মিডিয়ার সংবাদে দেখেছি যারা যারা নিজেদের উদ্যোগে ত্রাণ নিয়ে গেছেন তারা আবার আহ্বান জানিয়েছেন বিভিন্ন সংস্থার কাছে তারাও যেন ত্রাণ নিয়ে যান। সাধারণ মানুষের কাছে তারা আহ্বান জানিয়েছেন, আবারও ত্রাণ নিয়ে যাবার জন্য মানুষ যেন তাদের অনুদান দেন।

একজন মানুষ বিপদে আরেকজন মানুষের পাশে দাঁড়াবেন, এটা চমৎকার। এটাকে মানুষের নৈতিক দায়িত্বও বলা যেতে পারে। যারা এটা করছেন, তারা নিশ্চয়ই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যেকোনও দুর্যোগে দুর্গত মানুষদের সবরকম সাহায্য নিয়ে পাশে থাকার একমাত্র দায়িত্ব সরকারের। এটা তার নৈতিক দায়িত্ব নয় এটা আইনি এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব।

দেশে বড় বড় কিছু মেগা প্রজেক্ট হাতে নিতে দেখি সরকারকে। সেগুলো নিয়ে সরকারের বেশ মনোযোগ এবং মাথা ব্যথাও দেখি। কারণ উন্নয়নের বয়ান তৈরি করতে হবে। দেশের আর্থিক সামর্থ্য বেড়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু একটা অভিযোগ যে আমরা সব সময় করি, দেশের এই আর্থিক সামর্থ্য বৃদ্ধির সুফল হাতে যায় অল্প কিছু মানুষের। বিশেষ করে দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষরা এই সুফল থেকে অনেক দূরে থেকে যায়। তাই একের পর এক মেগাপ্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে যাওয়া বাংলাদেশ সরকারকে পাশে পায় না প্রবল বন্যায় হাবুডুবু খাওয়া বন্যার্ত মানুষরা।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ