X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

ডাক্তার-রোগী ও ক্ষমতার সম্পর্ক

মাহমুদুল সুমন
০৩ জুলাই ২০২২, ১৯:১৯আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২২, ১৯:২৪

আমার পরিচিত একজনের ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, একটি স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল আমাদের গন্তব্য। সামান্য কাজে আমাদের দেশে যেহেতু অনেক সময় লাগে, তাই গবেষণার পরিভাষায় যাকে বলে পর্যবেক্ষণ, তার অনেক সুযোগ থাকে এসব ভ্রমণে। এই হাসপাতালে ধনী দরিদ্র সবাই আছে, প্রচুর রোগী এবং প্রচুর রোগের চিকিৎসা এখানে হয়। ঢাকার অন্যান্য ফাইভ স্টার হাসপাতালের মতো এটি নয়। এই ধরনের হাসপাতালগুলোর পরিসর খানিকটা সমতা ভিত্তির কথা মনে করিয়ে দেয়।

হ্যাঁ, টয়লেটের সামনে দুর্গন্ধটা বেশি। তবে আর সবকিছু আপাতদৃষ্টিতে ঠিকঠাক চলছে! মানে রোগী আসছে, যাচ্ছে। রোগীর জন্য আলাদা লিফট । অ্যাটেনডেন্টদের বসার জায়গা ইত্যাদি। অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে আমার তেমন কোনও সমস্যা হচ্ছে না।  

টিকিট কেটে আমরা ডাক্তারের রুমে ঢুকলাম। একটা টেস্ট ছিল সেটার ফলাফল নিয়ে। যেটা অনুমান করা হচ্ছিল সেরকম কিছুই হয়েছে। সঙ্গত কারণেই রোগী ও আমার ভেতর একটু উদ্বেগ। ডাক্তারের কাছে আমাদের প্রশ্নও অনেক। কিন্তু হোঁচট খেলাম প্রথমেই এবং শেষ পর্যন্ত। আমাদের ডাক্তারের সাথে দেখা হলো। কিন্তু প্রথম থেকেই লক্ষ করলাম উনি বেশ চিলড ভঙ্গিতে মোবাইল ফোন স্ক্রল করছেন। সহযোগী তিন তরুণ ডাক্তার অবশ্য মনোযোগী, কাজ করছে। তরুণদের হাতে অবশ্য মোবাইল ছিল না। পরিস্থিতি হলো এরকম: আমার রোগী নানা প্রশ্ন করে। বড় ডাক্তার এক সেকেন্ডের সোশাল মিডিয়া বিরতি নিয়ে উত্তর দেন। আবার নজর দেন মোবাইলে। আমার রোগী উদ্বেগ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলে উনি আবার কিছু একটা বলেন। এভাবে প্রশ্ন ও উত্তরের ফাঁকে ডাক্তারের সোশাল মিডিয়া দেখা (মানে রোগী দেখা) চলতে থাকে।

সত্যি বলতে কী এরকম পরিস্থিতিতে আর কতই বা প্রশ্ন করা যায়! আমরা একপর্যায়ে থামবার সিদ্ধান্ত নিই। এদিকে আমরা থাকতে থাকতেই পরের সিরিয়ালের অপেক্ষমাণ ব্যক্তিকে ডাকা হয়ে গেছে। দেখলাম জায়গা না পেয়ে ওনারা তখনও দাঁড়িয়ে। আমাদের প্রশ্ন বা ভাষাভঙ্গি থেকে কিছু একটা টের পেয়ে ডাক্তার সাহেবা শেষে একবার শুধু বললেন,  ‘চিন্তা করবেন না! আমরা বিষয়টি দেখছি।’ ওনার চোখ তখনও মোবাইলে আটকে। সম্ভবত ফেসবুক। ইনস্টাগ্রামে থাকলে ক্ষণে ক্ষণে এত হাসবার কথা নয়! আরও বললেন, ‘ফলোআপে আসতে হবে।’ আমি অবশ্য ততক্ষণে ঠিক করে ফেলেছি এই ডাক্তারের কাছে আর নয়!

এখানে যে প্রক্রিয়ায় প্রেসক্রিপশন লেখা হয়েছিল, সেটাও একটু বলা দরকার। ডাক্তার যেভাবে রোগী ‘দেখলেন’ ঠিক একই প্রক্রিয়ায় প্রেসক্রিপশন লেখা হলো। মানে সহকারীদের মধ্যে যিনি সিনিয়র, তিনি কিছু একটা জিজ্ঞেস করেন, বড় ডাক্তারের হ্যাঁ-না থেকে দ্রুত সেটা টুকে রাখেন। এরমধ্যেই সহকারী ডাক্তারদের একজন নিজের সেল ফোন দিয়ে লিখিত হতে থাকা প্রেসক্রিপশনের একটা ছবিও তুলে রাখলেন। অনুমান করি পড়াশোনার জন্যই হয়তো ছবিটা তুলেছেন তরুণ ডাক্তার (হয়তো ইন্টার্নশিপ চলছে)। কিন্তু রোগীর প্রাইভেসি বলেও তো একটা কথা আছে। তরুণ ইন্টার্ন কি একটা অনুমতি নিতে পারতেন না? রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে আমি তখন এসবই দেখছি ও ভাবছি। ফিজিক্যাল এক্সামিনেশনের জন্য আমাকে রোগীর সঙ্গ ছাড়তে হয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। পরে শুনলাম সেখানেও অনুমতি না নিয়েই একজন নারী ও দুজন পুরুষ ডাক্তার এক্সামিনেশন বেডে হাজির, পুরুষ ডাক্তার রোগী প্রেফার করবেন কিনা তা না জিজ্ঞেস করেই!

রোগী মনে করিয়ে দেওয়াতে অবশ্য পরে বুঝতে পারলেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে স্বার্থে রোগী অবশ্য সবাইকেই ফিজিক্যাল এক্সামিনেশনের সুযোগ দিয়েছিলেন, সেটা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ।

ডাক্তারদের নিয়ে একটি সাধারণীকৃত বক্তব্য দেওয়া বা একজন ডাক্তারের অপেশাদারিত্বের উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশের হাজারো কর্মরত এবং নিষ্ঠাবান ডাক্তারদের অপমান করবার কোনও কারণ থেকে এই লেখা নয়। বড় কোনও সার্ভের তথ্য-উপাত্ত হাজির না করেই আমরা মনে হয় প্রায় সকলেই যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ডাক্তারখানায় বা হাসপাতালে আমাদের অভিজ্ঞতাটা খুব একটা ভালো নয়। কেন নয়? সেই প্রশ্নগুলো যতদিন যাবে সাধারণ নাগরিকদেরই তুলতে হবে।

ডাক্তারের কাছে আমরা নিশ্চয়ই আরও একটু মনোযোগ আশা করতে পারি। এও আশা করতে পারি যে রোগীরও কিছু জানার থাকতে পারে এবং তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সেটা অবান্তর নয়। যেই পরিস্থিতির বর্ণনা আমি করলাম তা থেকে স্পষ্ট মনে হতে পারে যে এখানে ডাক্তার তার পেশাগত অবস্থানকে ব্যবহার করে ক্ষমতার চর্চা করছেন। পেশাদারী আচরণের কথা যদি বাদও দেই, এই উদাহরণটা চিকিৎসাশাস্ত্রের এক পুরনো প্যাটারনালিস্টিক মডেলকেই উন্মোচন করে, যেখানে ডাক্তার হচ্ছেন পিতাসুলভ ও রোগী সন্তানের মতো। আমরা নিজেরা ডাক্তার সাহেবকে ডক্টর হিসাবে সম্বোধন করলেও লক্ষ করলাম অনেক রোগী ও রোগীর অ্যাটেনডেন্টরা ডাক্তার সাহেব (বাংলা নাটকেও এই সম্বোধন শুনেই আমরা বড় হয়েছি) না বলে “স্যার” সম্বোধন করছেন।

আমার মনে হয় চিকিৎসকদের এই তাত্ত্বিকতার নানা দিক ও ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের বিবিধ অ্যাপ্রোচগুলো নিয়ে ভাবা এবং চর্চার মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। তাহলে হয়তো স্পষ্ট হবে রোগী শিশু নয়, বন্ধু। ডাক্তারও বাবা নয়, শিক্ষক হতে পারেন। নানা তথ্যের সমবায়ের মধ্য দিয়ে রোগীও নিজের ওপর আরও একটু নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।        

একটি ডাক্তারখানায় সংঘটিত ঘটনার উপরোক্ত বর্ণনা একটি দুঃখজনক ব্যতিক্রম হলে তো খুবই ভালো। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা বলে এগুলোই বরং সাধারণ চর্চা। তাই জনস্বার্থে প্রসঙ্গটি এখানে তুললাম। এমন নয় যে আমাদের অভিজ্ঞতা সবসময় খারাপ। ভালো একটা অভিজ্ঞতা দিয়েই বরং আলোচনাটা শেষ করবো।

শেষোক্ত ডাক্তারের কাছে নিয়মিত একজন রোগীর সঙ্গে আমি যাতায়াত করি। প্রতিবারই হাসিমুখে আমাদের সঙ্গে ডাক্তার সাহেব আলাপ করেন। সময় নিয়ে উপদেশ দেন। রোগীকে আশ্বস্ত করেন। কখনও কখনও ইনটারনেটে গুগল করে আরও বিস্তারিত দেখে নিতে বলেন। তো শেষবার যেবার গেলাম, আমার প্রিয় রোগী প্রিয় ডাক্তারের ভিজিটের পরিমাণ ভুলে গেলেন। পাঁচশত টাকার একটা নোট এগিয়ে দিয়ে আমতা আমতা করছেন। ডাক্তার যথারীতি হেসে বললেন, ‘এতেই চলবে’। আমরা জানতে চাইলাম কিন্তু আপনার ভিজিট কত? বললেন, ‘প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মানতে আটশত টাকা করা হয়েছে’। আমরা জোরাজোরি করে ভিজিটের পুরোটা দিয়ে বিদায় নিলাম। অনুমান করি এই ডাক্তারেরও নিশ্চয়ই একটা স্মার্টফোন আছে। কিন্তু রোগী দেখবার সময় তিনি সেটার এস্তেমাল করেন না। এরকম ডাক্তার ব্যতিক্রম না হোক।

 
লেখক:  অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সেন্ট জোসেফ স্কুলে তিন দিনব্যাপী লিট ফেস্টিভ্যাল শুরু
সেন্ট জোসেফ স্কুলে তিন দিনব্যাপী লিট ফেস্টিভ্যাল শুরু
জাকিরের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
জাকিরের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
অবশেষে মোংলায় ঝরলো কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি
অবশেষে মোংলায় ঝরলো কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি
‘দেওরা’ সফলতার পর ‘মা লো মা’ চমক
‘দেওরা’ সফলতার পর ‘মা লো মা’ চমক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ