X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশের নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লবকে বিশ্বব্যাংকের স্বীকৃতি

ফারাজী আজমল হোসেন
২৩ আগস্ট ২০২২, ১৮:৩৪আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০২২, ১৮:৩৪
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে সম্প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে বাংলাদেশ তার দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ১ শতাংশ। সরকার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।  বাংলাদেশ পর পর দুই বছর জিডিপির দিক থেকে ভারতের থেকে এগিয়ে রয়েছে। এই তথ্য উঠে এসেছে পাকিস্তানের ‘গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস’ জার্নালে। তাদের মতে, সাত বছর আগেই বেশ কিছু সামাজিক সূচকে ভারতকে ছাড়িয়ে যেত সক্ষমতা অর্জন করে বাংলাদেশ।

বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি তাদের ওয়েবসাইটে ‘আইসিপি (ইন্টারন্যাশনাল কম্প্যারিসন প্রোগ্রাম) ২০২২-২১ প্রতিবেদন’ প্রকাশ করে। সেখানে ‘বাংলাদেশে নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লবের মোড়ক উন্মোচন’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস জানিয়েছে, চলতি বছরের ২ মার্চ প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল পাকিস্তানের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাপ্তাহিক ‘দ্য ফ্রাইডে টাইমস’-এ। পাকিস্তানি গণমাধ্যমেও স্বীকার করা হয়েছে,  ‘বিশ্বব্যাংক এই ‘আইসিপি আর্টিক্যাল’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ঢালাও প্রশংসা করেছে।  গোটা দুনিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের ভূমিকা ও সাফল্য ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের প্রধান কাজ হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। তাই বাংলাদেশের এই সাফল্যে তারা খুশি। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের বিদায়ী ভাইস-প্রেসিডেন্ট হার্টউইগ শেফার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশ এখন বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে।’

বর্তমানে বাংলাদেশ রয়েছে নতুন এক উচ্চতায়। বিশ্বব্যাংক-আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ বছর তাদের বসন্তকালীন সভায় কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলা এবং তার প্রভাব থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকারের সঠিক নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নেও বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম পরিসংখ্যানমূলক উদ্যোগ আইসিপি। জাতিসংঘের পরিসংখ্যানের পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। বিশ্বব্যাংক দেশব্যাপী পিপিপির (ক্রয় ক্ষমতার সমতা) সাফল্য তুলে ধরতে তাদের ওয়েবসাইটে ‘আইসিপি আর্টিক্যাল ২০২২-২০২১’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ৩১টি বিষয়কে তালিকাভুক্ত করেছে। আন্তর্জাতিক তুলনা কার্যক্রম বা আইসিপির পরিসংখ্যান ভিত্তিক প্রকাশনাতে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসার বিষয়টি তুলে ধরেছে গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস। বাংলাদেশের সামগ্রিক দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) এবং পিপিপি বৃদ্ধির হার নিয়েও সন্তোষ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

আইসিপির মূল লক্ষ্য তিনটি। প্রথমত, অংশগ্রহণকারী অর্থনীতির ক্রয় ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) এবং মূল্য স্তরের সূচক (পিএলআই) গণনা। দ্বিতীয়ত, পিপিপি ও জিডিপির সঙ্গে মাথাপিছু গড় আয় এবং ব্যয়ের হিসাব সাধারণ মুদ্রায় রূপান্তর। আর তৃতীয়ত, পিপিপিভিত্তিক ব্যয় উল্লিখিত অর্থনীতির মধ্যে মূল্যস্তরের তারতম্যের প্রভাবকে সরিয়ে দিয়ে কেবল আয়তনের পার্থক্যগুলোকে প্রতিফলিত করা। আইসিপি নির্ভরযোগ্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক তথ্য সরবরাহ করে দেশগুলোকে তাদের মূল্য, অর্থনৈতিক আকার এবং বস্তুগত সুস্থতা নিয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করতে সাহায্য করে।

এহেন আইসিপির প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লব নিয়ে ৩১টি তথ্য সমৃদ্ধ বিষয় প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানি গণমাধ্যমের মতে, আইসিপি প্রতিবেদন থেকে বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রকৃত ছবি ফুটে উঠেছে। পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার ৫০ বছর পার করার আগে থেকেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছ থেকে তার পরিচিতি ও মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বলা হয়েছে, সাহায্য প্রাপক থেকে দাতা দেশ হয়ে ওঠার দিকে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।

করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্ব অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি করে। বাংলাদেশ-সহ দক্ষিণ এশিয়ার সব অর্থনীতিতেই এর বিরূপ প্রভাবে পড়েছে। তৈরি পোশাকের উৎপাদন ও রফতানি বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের কারণে বাংলাদেশ সেই ধাক্কা ঠিকমতো সামলাতে সক্ষম হয়েছে বলে পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন।

আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংক দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিকে মহামারির পরিণতি কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। ‘সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক বাউন্স ব্যাক বাট ফেস ফ্র্যাজিল রিকভারি’ শিরোনামে একটি  প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০২১ অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) গড়ে ৭.২ শতাংশ হারে প্রসারিত হতে পারে। কিন্তু ২০২২ অর্থবছরে গড় প্রবৃদ্ধি ৪.৪ শতাংশের কম হতে পারে।’ তবে বাংলাদেশ কিন্তু তাদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬.১ থেকে ৭.২ শতাংশ ঠিক করে রেখেছে। প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এখন ভারত ও পাকিস্তানের থেকে বহু ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে কন্যাসন্তানদের স্কুলে যাওয়ার হার অনেক বেশি। ৫ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার ভারতের তুলনায়  কম বাংলাদেশ। এ দেশে কন্যাসন্তান জন্মাচ্ছেও বেশি।

গ্লোবাল ভিলেজ স্পেসের মতে, বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে ব্যাপক উন্নতি করছে। মাথাপিছু জিডিপি এবং সম্পদ বৃদ্ধি নিয়ে প্রশংসা করেছে টরেন্টো, কানাডা ও বাংলাদেশ-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর রাইটস অ্যান্ড সিকিউরিটি’। তাদের মতে, পাকিস্তান উন্নয়নের সড়ক থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে।

গত বছর ৩০ জুলাই প্রকাশিত তাদের জার্নালে ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তান- পূর্বে এক জাতি, আজ আলাদা’ শিরোনামে মহামারির আগে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা প্রকাশিত হয়।  সেখানে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির হার ৭.৮ শতাংশের তুলনায় পাকিস্তানের ছিল মাত্র ৫.৮ শতাংশ। বাংলাদেশের সাফল্যকে ‘অলৌকিক গল্প’ বলে বর্ণনা করা হলেও পাকিস্তান সম্পর্কে বলা হয়েছে,  ‘বিপর্যয়ের আখ্যান’।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি একটি টুইট করেছেন। সেখানে তিনি মন্তব্য করেন,  ‘আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে’। একইসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন, ‘ভালো খবর হলো, নতুন উন্নত অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে, ভারত পিছিয়ে পড়েছে।  পাঁচ বছর আগে ভারত ২৫ শতাংশ এগিয়ে  ছিল।’ পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কিন্তু কোনও সুযোগের ফল নয়। বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের অর্থনীতি ২০০৪ সাল থেকে যথেষ্ট দ্রুত হারে বেড়েছে। ২০১৬ পর্যন্ত এই অগ্রগতি বজায় ছিল। কিন্তু প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে পরিবর্তন শুরু হয়। করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়।

আইসিপির পরিসংখ্যান দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের তুলনামূলক আলোচনা করে দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে ভারতের জনসংখ্যা ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর বাংলাদেশের বৃদ্ধি পেয়েছে ১৮ শতাংশ। এর প্রভাব পড়েছে মাথাপিছু গড় আয়ে। ২০০৭ সালেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতের তুলনায় অর্ধেক ছিল। ২০০৪ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের তুলনায় ছিল ৭৪ শতাংশ বেশি। এখন চিত্র বদলেছে। তাই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনের ঢালাও প্রশংসা করছে।  পাকিস্তানিরাও মনে করেন, ‘আইসিপি আর্টিক্যাল ২০২২-২০২১’ আসলে হচ্ছে ‘বাংলাদেশের নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লব’কে বিশ্বব্যাংকের স্বীকৃতি। আর এই স্বীকৃতির পূর্ণ কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশি জনগণের।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা নির্মাণের স্বপ্নপূরণে দৃঢ়চিত্তে কাজ করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শত ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে তিনি বিশ্বমঞ্চে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বলেছেন, যত ষড়যন্ত্রই হোক না কেন, দৃঢ়চিত্তে তা মোকাবিলায় তিনি প্রস্তুত।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ