X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষা ও মানসিকতা: ঘুণে ধরা সময়ের কথা

মোহাম্মদ আসাদ উজ জামান
০৮ অক্টোবর ২০২২, ১৭:১৯আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০২২, ১৭:১৯

মানুষকে যা কিছু সময়ের উপযোগী করে তুলে তাই শিক্ষা। এর ব্যাপকতা ছড়িয়ে আছে ব্যক্তি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র, এবং রাষ্ট্র থেকে পুরো বিশ্বে। শিক্ষার মাধ্যমেই জীবনের সঠিক এবং আনন্দময় স্বাদ আচ্ছাদন করা যায়, যে শিক্ষার মাঝে থাকে পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রতিটি শিক্ষাই মানুষের জন্যে সমান গুরুত্বপূর্ণ। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির ওপর জোর দিয়ে যুগোপযোগী এবং ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা একেবারেই কঠিন। কারণ শিক্ষার মাধ্যমেই গড়ে উঠবে একটি সমাজ, যেখানে সাধারণের অধিকার সহজে সংরক্ষণ করা যাবে, একই সঙ্গে স্বস্তি এবং সামগ্রিক নিরাপত্তার মাধ্যমে মানুষের কাছে জীবন হয়ে উঠবে আনন্দময়।

কিন্তু বর্তমানে শিক্ষা নিয়ে নানান নেতিবাচক কথায় বাতাস ভারি হয়ে আছে। নকল, প্রশ্নফাঁস, একজনের পরীক্ষা আরেকজনের দিয়ে দেওয়া সহ আরও অনেক অনেক অভিযোগ আছে। অভিযোগ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে, একই সঙ্গে অভিযোগ আছে অভিভাবক সম্পর্কে, এমনকি শিক্ষা প্রক্রিয়া নিয়েও অভিযোগের শেষ নেই। একটি বড় অভিযোগ হলো জিপিএ পাঁচ-এর মান নিয়ে। এখানে ছাত্রদের মেধা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না।

আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধার অভাব নেই, মেধা থাকার অর্থ হলো একজন ছাত্রের যথাযথ যত্ন নিলে সে লেখাপড়ায় ভালো করবে। তবে শুধু মেধা থাকলেই ঢালাওভাবে জিপিএ পাঁচ পাওয়ার কথা নয়। মেধার সঙ্গে আগ্রহ থাকতে হয়, আগ্রহ থাকার অর্থ হলো, একজন শিক্ষার্থীকে পড়ার কথা না বললে সে নিজের থেকেই পড়তে বসবে। কিন্তু অল্প কিছু শিক্ষার্থী বাদে সবার লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ থাকার কথা নয়। ফিরে যাই জিপিএ পাঁচ নিয়ে অভিযোগের দিকে। একজন শিক্ষার্থীকে জিপিএ পাঁচ দিয়েছে শিক্ষকরা, শিক্ষকরা কারা, তারা আমরাই। এই জিপিএ পাঁচ নিয়ে অভিভাবকরা অনেক টাকা খরচ করেছেন, অভিভাবক কারা, তারাও আমরাই। জিপিএ পাঁচ পেয়েছে কে? ছাত্র বা ছাত্রী, যে আমাদের সন্তান। আমাদের সন্তানের হাতে জিপিএ পাঁচ তুলে দিয়ে আমরাই হাসাহাসি করছি, অভিযোগ করছি, এটা কেমন কথা। নিজের সন্তানের হাতে একটা কিছু তুলে দিয়ে সেই আমরাই হাসাহাসি করছি, বলতে গেলে পুরো জাতি এই হাসির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। সন্তানকে যে কোনও উপায়েই জিপিএ পাঁচ পেতে হবে– এই মানসিকতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

শিক্ষার মান বাড়ানো নিয়ে কথা হচ্ছে। কীভাবে কী করা যায় এই নিয়েও নানান কথায় বাতাস ভারি হয়ে আছে। এর পেছনে মূল কারণ আমাদের মানসিকতা, যে মানসিকতা আমাদের সমাজের সামগ্রিক রূপটি দেখতে দিচ্ছে না। তাই শিক্ষার উন্নতির জন্যে নতুন কিছু যোগ করার আগে পুরনো অনাসৃষ্টি দূর করতে হবে এবং আমাদের মানসিকার উন্নতি করতে হবে। এখন দেখা যাক কীভাবে আমাদের মানসিকতার জন্যে আজ শিক্ষার এই অবস্থা। এখন সরাসরি চলে যাই কিছু প্রশ্নে।

শিক্ষার মান উন্নয়নে ঠিক কোথা থেকে শুরু করতে হবে?

সেটা অবশ্যই প্রাথমিক পর্যায় থেকে। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাই হলো শিক্ষার ভিত্তি। এই পর্যায়ে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না দিলে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার ভিতটা ঠিকভাবে গড়ে উঠবে না। যোগ্য শিক্ষক মানেই অনেক জ্ঞানী শিক্ষক নয়, শিক্ষার্থীদের প্রতি মমত্ব থেকে শিখানোর আগ্রহ যেন শিক্ষকদের মাঝে থাকে।

এর মানে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবীদের বেশি বেতনে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে?

এতে একটা পরিবর্তন আসতে পারতো। কিন্তু আমাদের বর্তমান পরিবেশের জন্যে উপযুক্ত নয়। শিক্ষক নিয়োগে অনেক ধরনের অনিয়মের কথা শোনা যায়, এখানে টাকা-পয়সাও জড়িত থাকে বলে পত্রিকায় খবর আসে। সেখানে হঠাৎ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে দিলে অনিয়মটাই বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর সমাজে প্রাথমিক শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা একেবারেই তলানিতে।

প্রাইভেট, কোচিং– এসব কিছুতে জড়িত থাকার কারণে এবং আরও কিছু সামাজিক কারণে তাদের সামাজিক মর্যাদা বা ভূমিকা খুবই কম। যার ফলে শুধুমাত্র বেশি বেতন দিয়ে অনেক মেধাবীদের নিয়োগ দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি আশা করা যায় না। একই সঙ্গে এই মেধাবীর সঙ্গে ফাঁকে ফাঁকে প্রভাবশালীদের অনেক আত্মীয়-স্বজনও ঢুকে পড়বে, এতে আরও বড় ধরনের দুর্নীতির সুযোগ বেড়ে যেতে পারে। আর পুরো দেশের প্রাথমিক স্তরে এত মেধাবী শিক্ষকের জোগান দেওয়াও সম্ভব নয়।  

যদি প্রাথমিক শিক্ষকদের বেশি সম্মান দেওয়া হয়?

আমরা চাইলেই প্রাথমিক শিক্ষকদের বেশি সম্মান দিতে পারি না, সম্মানের সঙ্গে অনেক কিছুই জড়িত থাকে। আর এতদিনের জং ধরা সম্মানে হঠাৎ করে চকচকে রং লাগালেও তা কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হবে না। আমাদের দরকার টেকসই এবং স্থায়ী সমাধান।   

তাহলে কোথা থেকে এবং কীভাবে শুরু করবো?

আমরা যে কোনও পর্যায় থেকেই শুরু করতে পারি। কিন্তু সবার আগে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করতে হবে যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সমস্যা আছে। এরপর আমাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এর জন্যে সময় দরকার। এরপর হলো সমাধানের জন্যে চেষ্টা করা। একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে যে, যে সমস্যা তৈরি হয়েছে অনেক দিন ধরে, সে সমস্যা অল্প দিনেই সমাধান করা সম্ভব নয়, এর জন্যে অনেক সময় দিতে হবে, দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ এবং ধৈর্যের সঙ্গে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। তবে বিশেষ কিছু স্কুল দিয়ে শুরু হতে পারে। এতে করে গভীরভাবে সুবিধা এবং অসুবিধার পর্যালোচনা করার সুযোগে থাকে।

লেখাপড়ার মূল ব্যাপারটা আসলে কী?

আমাদের সন্তানকে সময়ের উপযোগী করে তোলা। এরজন্যে একজন ছাত্রকে বই পড়তে হবে, বই থেকে নানান ধরনের তথ্য এবং জ্ঞান আহরণ করতে হবে, সেই জ্ঞান বাস্তবে কাজে লাগাতে শিখতে হবে, এভাবেই ধীরে ধীরে একজন ছাত্র নিজেকে সময়ের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে নোট, প্রাইভেট, কোচিং এসব কারণে ছাত্ররা মূল বইতে মনোযোগ দিতে পারছে না। এসব অনাসৃষ্টি দূর করতে হবে।  

প্রাইভেট বা কোচিং বন্ধ করতে পারলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে?

হতে পারতো, কিন্তু বর্তমানে সেই পরিবেশ নেই। একজন স্কুল শিক্ষক যে বেতন পান, তা দিয়ে একটি সংসার চালানো খুব কঠিন। স্কুলে তাদের বেতন ইচ্ছে করলেই বাড়ানো যায় না, ছাত্র-ছাত্রীর প্রাইভেট বাবদ অভিভাবকরা অনেক টাকা খরচে করতে আগ্রহী হলেও স্কুলে ছাত্রের বেতন বেশি দিতে চায় না। আবার এতদিনের প্রাইভেট এবং কোচিং করা ছাত্র বা ছাত্রীকে নিজে নিজে পড়তে বললে হয়তো বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারবে না। সেক্ষেত্রে একটা নিয়ম হতে পারে, কোনও স্কুল শিক্ষক যেন কোনোভাবেই কোনও কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারে। সমাজে যারা বেকার, কিংবা এখনও চাকরি পায়নি, কোচিং তাদের জন্যে সাময়িক একটি অবলম্বন হতে পারে। পরের ধাপে কোচিংটা পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেই হবে। একইভাবে প্রাইভেটটাও বন্ধ করে দিতে পারলে খুব ভালো হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষক এবং অভিভাবকদের সঙ্গে সরকার যুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের একটি নির্দিষ্ট বেতন ঠিক করে দেবে, যাতে করে একজন শিক্ষক প্রাইভেট এবং কোচিং না করিয়েও সংসারের ব্যয় মেটাতে পারেন। অর্থাৎ পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যেই একটি স্বতন্ত্র বেতন স্কেল থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে যে বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক সক্ষমতার সঙ্গেই সম্মান জড়িত।   

একজন শিক্ষার্থী কি শুধু লেখাপড়াই করবে?

মোটেও না। জীবনের জন্যে লেখাপড়া, লেখাপড়ার জন্যে জীবন নয়। একজন ছাত্রের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্যে খেলাধুলা করতে হবে, বাড়ির কাজ করতে হবে, পারিবারিক এবং সামাজিক দায় বুঝতে হবে, ধর্মীয় আচার-আচরণ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। কারণ প্রতিটি ছাত্রকেই একজন মানুষ হতে হবে, এবং একজন মানুষ মাত্রই পুরো বিশ্বের একটি সম্পদ।

সমস্যা কি প্রাথমিক আর মাধ্যমিক স্তরেই সীমাবদ্ধ?

নিরবিচ্ছিন্ন সমাজে একটি সমস্যা কোনোভাবেই একটি নির্দিষ্ট পরিগণ্ডির মাঝে আটকে রাখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও অনেক সমস্যা আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এক ধরনের সমস্যা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালগুলোতে আরেক ধরনের সমস্যা। আবাসিক হলের সামগ্রিক পরিবেশ থেকে শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও অনেক অভিযোগ আছে। ইউজিসিও কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে ছাত্রদের উপদেশ দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগেও কি মানসিকতার প্রভাব আছে?

আছে, এবং বলতে অনেক বেশিই আছে। নিয়োগ পরীক্ষার ভাইভায় নানা কায়দা কানুন করে বিশেষ কাউকে বাদ দেওয়া থেকে বিশেষ কাউকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে এই ধরনের অভিযোগ প্রায় অহরহ।

নিয়োগ পরীক্ষায় ভাইবার পরিবর্তে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে কি এর থেকে উত্তরণ সম্ভব?

লিখিত পরীক্ষা কে নেবে, প্রশ্ন কে করবে? সেই তো আমাদের দেশের শিক্ষকরাই। যতক্ষণ আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন না হচ্ছে ততক্ষণ এর থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। দেখা যাবে লিখিত পরীক্ষায় অন্য ধরনের অনাচার শুরু হয়েছে।  

এর থেকে মুক্তির কি কোনও উপায়ই নেই?

যে কোনও সমস্যা থেকেই উত্তরণের উপায় আছে, কিন্তু তার আগে সমস্যাটা যে একটা সমস্যা এটা স্বীকার করতে হবে। তাই শুরুতেই রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে স্বীকার করে নেওয়া – নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সমস্যা আছে। তারপরেই সমাধানের দিকে নজর দিতে হবে। কোনও নিয়োগ কমিটি সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন দেখা দিলে তা ভালোভাবে ক্ষতিয়ে দেখতে হবে, এবং কোন ধরনের, যত সামান্যই হোক না কেন, গরমিল দেখা দিলেই সেই নিয়োগ কমিটির সবাইকে আর কোনও নিয়োগ পরীক্ষার কমিটিতে রাখা যাবে না, এবং ভবিষ্যতে তাদেরকে কোনও প্রশাসনিক দায়িত্বও দেওয়া যাবে না। এই ধরনের দৃষ্টান্তমূলক কিছু শাস্তির সুযোগ না থাকলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা খুবই কঠিন।

কিন্তু এই ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা কে করবে?

আগেই বলেছি, প্রথমেই রাষ্ট্রকে স্বীকার করতে হবে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সমস্যা আছে। তারপর সম্মিলিত উদ্যোগের ব্যবস্থাও রাষ্ট্রকেই করতে হবে। কিন্তু যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তারাই যদি রাষ্ট্র যন্ত্রের ক্ষমতার ভাগীদার হয়ে থেকে, তখন এর উত্তরণ কঠিন, এবং এই ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও হয়তো এর প্রয়োগ করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। সেজন্যেই বলছি, সমস্ত কিছুর মূলে আমাদের মানসিকতা। এই দেশ, এই সমাজ, এই শিক্ষা ব্যবস্থা, কোনোটাই কারও ব্যক্তি সম্পদ নয়, এগুলোর সবই আমাদের সামগ্রিক সম্পদ। এই বোধটা যতক্ষণ আমাদের মাঝে জাগ্রত করতে না পারি, ততক্ষণ শিক্ষার কোনও সমস্যাই দূর কর সম্ভব নয়। আর যথার্থ শিক্ষা ব্যতিরেকে এই ধরনের একটি বোধ মানুষের মাঝে জাগ্রত করাও সম্ভব নয়। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো–  একটি শিক্ষা বান্ধব পরিবেশের জন্যে যেমন ছাত্র গড়ে তুলতে হয়, তেমনি গড়ে তুলতে হয় শিক্ষক এবং অভিভাবক। উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন মানসিকতার শিক্ষক এবং অভিভাবক না থাকলে একটি শিক্ষা বান্ধব পরিবেশ অধরাই থেকে যাবে। তখন সমাজে একটি বিষয়ই প্রকট থাকবে, আর সেটা হলো অভিযোগ।

নিয়োগ আর ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে অনেক উপাচার্যদের বিরুদ্ধেই পত্রিকায় অনেক খবর এসেছে। কিন্তু সেই অনুপাতে কোনও শাস্তি বা কোনও প্রতিকারের খবর পত্রিকায় আসে না। এ কারণেই হয়ত দিনে দিনেই উপাচার্যদের নিয়ে লাগাম ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহারের খবর পত্রিকায় চলে আসে, যা শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশের জন্যে এক ভয়াবহ অশনিসংকেত!   

অনেক সময় শোনা যায় অনেক যোগ্য প্রার্থীও একটি দ্বিতীয় বিভাগের জন্য নিয়োগ পাননি, এই অভিযোগকে কি বিশেষ কোনও দৃষ্টিতে দেখার অবকাশ আছে?

যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার শর্ত থাকে যে কোনও পরীক্ষাতেই দ্বিতীয় বিভাগ থাকতে পারবে না, তাহলে এই অভিযোগ আমলে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। কারণ নিয়ম না মানার রোগ আমাদেরকে পেয়ে বসেছে। এমন কি বিশেষ যোগ্য প্রার্থী, বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি হার্ভার্ডের অধ্যাপকও যদি একটি দ্বিতীয় বিভাগের কারণে আমাদের দেশের কোনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না পান, তবুও এই অভিযোগ কোনও আমল পেতে পারে না। কারণ হার্ভার্ড জানে কাকে নিয়োগ দিতে হবে, ওখানে পরীক্ষার ফলাফলের চেয়ে একজন প্রার্থীর কাজকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা। তাদের সেই পরিবেশ আছে। কিন্তু সেই দ্বিতীয় বিভাগ প্রাপ্ত হার্ভার্ড অধ্যাপককে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগে দেখা যাবে কোনোভাবে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছে এমন প্রার্থীকেও বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, শুধু মাত্র বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, এর পেছনের মূল কারণ আমাদের মানসিকতা।         

কিন্তু শিক্ষার বর্তমান অবস্থাকেই মেনে নিলে ক্ষতি কী?

এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। আমরা জানি ঢাকার কাছে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি খুবই ময়লা। এই ময়লা পানিকে মেনে নিলে ক্ষতি কী। এতে অনেক অনেক ক্ষতি। এই পানিতে মানুষ নেমে গোসল করছে, মানুষের মুখ দিয়ে পানি তার শরীরে ধুকছে, এতে নানান অসুখ-বিসুখ হওয়ার সুযোগ থাকে, এই পানিতে মাছের ভেতর ময়লা থাকবে, যে মাছ খেলে মানুষের শরীরে ক্ষতিকর উপাদান ঢুকে পড়বে, এই পানিতে চাষাবাদ করলে একই কথা, মোটকথা সামগ্রিক পরিবেশের ভারসাম্যের জন্যে ময়লা নদীর পানি একটি ভয়ানক হুমকি। ঠিক একইভাবে শিক্ষা হলো জীবনের পরিশোধক। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষের মনন গড়ে ওঠে, একই সঙ্গে শিক্ষার মাধ্যমেই সমাজ থেকে দূর হয়ে যাওয়ার কথা যত অনাচার, অবিচার– সেই শিক্ষার ভেতরেই যদি সমস্যা থাকে, তাহলে সমাজ থেকে অনাচার দূর হবে কীভাবে?

তার মানে যে কোনও সমস্যার সমাধানের পূর্বশর্ত প্রকৃত শিক্ষা।  অর্থনৈতিক সক্ষমতায় আমরা এগিয়ে গেলেও সামাজিক জীবনে নিরাপত্তা এবং সামগ্রিক স্বস্তির দিক থেকে আমরা বেশ পিছিয়ে আছি, এবং দিন দিন যেন আরও বেশি পিছিয়ে পড়ছি। আপনি যদি ভেজালমুক্ত খাবার বাজার চান, তাহলে দোকানিদের শিক্ষা থাকতে হবে ভেজাল খেলে মানুষের কী কী ক্ষতি হতে পারে, এই শিক্ষা ব্যবসায়ীদের থাকতে হবে, আর এটা পরিণত বয়সে মুনাফা লোভী মানুষের মাঝে দেওয়া কঠিন। শুরু করতে হবে ছোটকাল থেকেই। একইভাবে টেকসই রাস্তা চান, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন চান, সামাজিক অবক্ষয় থেকে মুক্তি চান, ব্যাংকের টাকার লোপাট বন্ধ করতে চান– মোট কথা আপনি ভালো যা কিছুই চান না কেন, এবং খারাপ যত কিছুই উপড়ে ফেলতে চান না কেন, আপনাকে শুরু করতে হবে শিক্ষা থেকে, এবং সমস্যাগুলোকে প্রথমেই রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নিতে হবে। এভাবেই ধীরে ধীরে শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ শিক্ষা হচ্ছে সামাজিক এবং মানসিক সমস্যা দূর করার জন্যে সবচেয়ে বড় পরিশোধক এবং সহজ উপায়, কিন্তু সময় সাপেক্ষ। যে কোনও ভালো পরিবর্তনের জন্যে প্রকৃত শিক্ষাকেই আমাদেরকে আঁকড়ে ধরতে হবে, এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনও অনাচার থাকলে প্রথমেই সেগুলো দূর করতে হবে। এরপর শিক্ষার উন্নতির জন্যে নতুন কিছু যোগ করার থাকলে সেগুলো যোগ করতে হবে।

সব শেষে দুটো কথা বলতে চাই–

এক. বাগানের আগাছাকে উপড়ে ফেললেই চলে, কিন্তু সমাজের আগাছা উপড়ে ফেলার কোনও উপায় নেই, একটাই উপায় আগাছারও যত্ন নিয়ে সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা, আর এটা কেবল মাত্র প্রকৃত শিক্ষা দিয়েই সম্ভব।

দুই. সন্তান হচ্ছে আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, ভবিষ্যতের জন্যে উপযুক্তভাবে ওদের গড়ে তুলতে শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশের সংস্কার শুরু করাটা সময়ের দাবিমাত্র।       

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আত্মীয়ের জানাজা শেষে ফেরার পথে প্রাণ গেলো মা-ছেলের
আত্মীয়ের জানাজা শেষে ফেরার পথে প্রাণ গেলো মা-ছেলের
বৃষ্টির প্রার্থনায় বিভিন্ন জেলায় নামাজ আদায়
বৃষ্টির প্রার্থনায় বিভিন্ন জেলায় নামাজ আদায়
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর বোল্ট
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর বোল্ট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ