X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাস বন্ধে লাভ হলো কার?

মাসুদ কামাল
১৭ অক্টোবর ২০২২, ১৬:০১আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০২২, ১৬:০১

রাজনীতিবিদদের কথাবার্তার ওপর আমার ভরসা কম। তারা কখন কী মতলবে কী বলেন, সেটা বোঝা মুশকিল। অনেক প্রতিশ্রুতি তারা দেন, যার সিংহভাগই বাস্তবায়িত হয় না। এই যে বাস্তবায়িত না হওয়া, এনিয়ে তারা লজ্জিতও হন না। তারা সবসময় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন, তাই কথা দিয়ে কথা না রাখার ব্যাপারে জনগণ তাদেরকে প্রশ্ন করারও সুযোগও পায় না। আর যদি বা কখনও, কালে-ভদ্রে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েও যান, অবলীলায় বলে দেন– ওটা আসলে মাঠের বক্তৃতা ছিল! রাজনীতির মাঠের বক্তৃতাকে অতটা সিরিয়াসলি নেওয়ার কী দরকার!

তবে এইসব রাজনীতির মেঠো বক্তৃতা কিন্তু আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু নয়। আজ বরং কথা বলতে চাই রাজনীতির মাঠদখল করতে গিয়ে কত কত অপকর্ম হয়– তা নিয়ে। সেই অপকর্মে নেতিবাচক প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর কীভাবে পড়ে– সেসব নিয়েও।

বিএনপি এখন মাঠগরমের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছে। বিভাগীয় শহরগুলোতে জনসমাবেশ করছে। চট্টগ্রামের পর শনিবার তাদের জনসভা ছিল ময়মনসিংহে। শনিবারের এই জনসভা নিয়ে যে সকল ঘটনা ঘটেছে, তা খুবই মর্মান্তিক। জনসভার শহর ময়মনসিংহকে যেন পুরো এক অবরুদ্ধ জনপদে পরিণত করা হয়েছিল। আশপাশের জেলাগুলো থেকে কেউ যাতে ময়মনসিংহে যেতে না পারে, সেজন্য বাসরুটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। শনিবার সকাল থেকেই কেবল নয়, শুক্রবার রাত থেকেই সংলগ্ন জেলাগুলো থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশে কোনও যাত্রীবাহী গাড়ি ছাড়েনি। বাস স্টপেজগুলোতে যাত্রীদের ভিড় ছিল, কিন্তু কোনও গাড়ি সচল হয়নি। পত্রিকায় একটা নিউজ দেখলাম, কিশোরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে একজন মধ্যবয়স্ক হতাশ হয়ে বলছিলেন, ‘আমি তো বিএনপি করি না, আমি রাজনীতিও করি না। তাহলে আমাকে কেন ভোগান্তি পোহাতে হবে?’

তার এই কথাগুলো দুটি কারণে আমাকে খুবই স্পর্শ করেছে। প্রথমত, তিনি ময়মনসিংহে থাকা তার অসুস্থ কন্যাকে দেখতে যেতে পারছেন না। আর দ্বিতীয়ত, তিনি তো রাজনীতি করেন না, বিএনপি করেন না, তবু কেন তিনি যেতে পারবেন না?

এই যে এক জায়গা থেকে আর জায়গায় যেতে না পারা, কাউকে যেতে না দেওয়া, এটা কি স্বাভাবিক? একটা স্বাধীন দেশে, যেখানে আবার সরকার প্রতিনিয়ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গর্ব করে থাকে, সেখানে এধরনের ভোগান্তি খুবই অপ্রত্যাশিত। আর দ্বিতীয় যে কথাটা, সেটা আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষ কী ভাবে, সেখানে খুবই নগ্নভাবে তা প্রকাশিত হয়েছে। খুব একটা চিন্তা না করেই ভদ্রলোক মর্মান্তিক একটা বাস্তবতাকে প্রকাশ করে দিয়েছেন। ‘আমি তো রাজনীতি করি না, বিএনপি করি না, তবুও কেন?’ যেন উনি পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে বুঝেই গেছেন, বিএনপি করলে তার জন্য এই সমাজে ভিন্ন ব্যবস্থা। তার মধ্যে এমন ধারণা দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে যে, কেউ বিএনপি করলে তাকে সরকার কিংবা প্রশাসন বিভিন্ন ভোগান্তিতে ফেলতেই পারে। আর এটা কোনও অন্যায় নয়!

কেবল ওই ভদ্রলোকই কেন, প্রশাসন বা সরকারও বোধকরি সেরকম কিছুই ভাবেন। আর ভাবেন বলেই সবাই মিলে একটা মিটিংকে না হতে দেওয়ার যতগুলো সম্ভাব্য উপায় আছে সবগুলোই তারা ব্যবহার করেছে। প্রথম ঝামেলাটা করেছে জনসভার স্থান নিয়ে। আমি নিজে ময়মনসিংহের মানুষ। তাই জানি সেখানে বড় যে কোনও সমাবেশের জন্য সর্বোত্তম স্থান হচ্ছে- সার্কিট হাউজ ময়দান। এই জায়গাটি বড়, তাই এখানে জনসমাবেশ ঘটলে আর যা কিছুই হোক রাস্তায় ভিড় জমতো না।

এই সমাবেশের পরদিন, ময়মনসিংহে থাকা এক বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলো। বন্ধুটি অনেকটাই আওয়ামী ভাবাপন্ন। জানতে চাইলাম, বিএনপির সমাবেশে আনুমানিক কত লোক হয়েছিল? সে বলল, পলিটেকনিকের যে মাঠে সমাবেশ হয়েছে তার ধারণক্ষমতা বড়জোর ২০ হাজার। তাই ত্রিশ হাজার লোক হলেও সেটা কিন্তু মাঠের বাইরে সংলগ্ন মহাসড়কে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে যখন দেখা গেছে সামনের রাস্তা পার হয়ে চরপাড়া বা মাসকান্দা পর্যন্ত মানুষ দাঁড়িয়ে নেতাদের বক্তব্য শুনছে, মনে হয়েছে লাখ লাখ লোক বুঝি হয়েছে। অথচ এই জনসভাটিই যদি সার্কিট হাউজ ময়দানে হতো, হয়তো মাঠের অর্ধেকের বেশি ভরতোই না।

তাহলে সার্কিট হাউজ ময়দানে জনসভার অনুমতি দেওয়া হলো না কেন, জানতে চাইলাম। বন্ধুটি কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গেই বললেন, সমস্যাটি তো এখানেই। অনুমতি যারা দেবে, তারা ভেবেছে অনুমতি না দিলে বোধকরি সরকার খুশি হবে। ভালো করতে গিয়ে তারা আসলে সরকারের ক্ষতিই করে ফেলেছে।

আমার এই বন্ধুটি কিন্তু আওয়ামী লীগের একটু বেশি বেশিই সমর্থক। তার মুখেও এরকম প্রতিক্রিয়া শুনে আমি মোটেই বিস্মিত হইনি। ক্ষমতা যখন খুব কেন্দ্রিভূত হয়ে পড়ে, ক্ষমতাসীনরা তখন নিজেদেরকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতে থাকে। মনে করতে থাকে- তাদের বুঝি কোনও ক্ষয় নেই, পতন নেই। আর তখনই সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্টের প্রতি একধরনের অবজ্ঞা জায়গা করে নেয় তাদের মনে। ময়মনসিংহে বিএনপির এই জনসভাকে কেন্দ্র ক্ষমতাসীনদের সেই মনোভাবই আরও একবার প্রকাশিত হয়েছে।

শনিবার ভোরে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশে কোনও বাস ছাড়েনি। অনেকে বাস টার্মিনালে গিয়ে গাড়ি না পেয়ে ফিরে গেছেন। কেন কোনও গাড়ি যাচ্ছে না– এমন প্রশ্নের জবাব দেওয়ারও কেউ ছিল না। পরে জানা গেছে, বাস মালিক সমিতির সিদ্ধান্তের কারণেই হয়েছিল এমনটা। বাস মালিক সমিতির নেতারা দারুনভাবে সরকারঘনিষ্ট। দ্রুতই এর প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যেতে টঙ্গি, গাজিপুর, মাওনা, ভালুকা, ত্রিশাল- সব জায়গাতেই সরকার দলীয় লোকেরা লাঠিসোটা হাতে রাস্তায় নেমে গেছে। বাস তো আগে থেকেই নেই, তার পরেও যারা ট্রাক বা মিনিট্রাকে করে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, তাদেরকে নামিয়ে হেনস্তা করেছে। রাস্তায় এতসব কর্মকাণ্ডে কোনও বাধাই দেয়নি স্থানীয় থানা পুলিশ। এরা সবাই হয়তো ভেবেছে– এরকমটি করলে সরকার হয়তো খুশি হবে।

আসলে কি তাই? এরকম অরাজকতায় সরকারের খুশি হওয়ার কি কোনই কারণ আছে? থাকতে পারে? যে কাজে সাধারণ মানুষ কষ্ট পাবে, ভোগান্তির মধ্যে পড়বে, তাতে সরকারের তো বিরক্ত হওয়ারই কথা। বিভাগীয় শহরে বিএনপি বা যে কোনও বিরোধী দল যদি একটা জনসভা করে, তাতে সরকারের কি পতন হয়ে যায়? বিএনপি একটা রাজনৈতিক দল, বেশ কয়েকবার এরা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। পপুলার ভোটের মাধ্যমেই তারা ক্ষমতায় গিয়েছিল। তাই দেশজুড়ে তাদের প্রচুর কর্মী সমর্থক থাকবে– এটাই স্বাভাবিক। আপনার পছন্দ হোক বা না হোক, তাদেরকে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় আপনি বাধা দিতে পারেন না। আপনি যত ক্ষমতাধরই হোন না কেন, আমাদের সংবিধান আপনাকে সে অধিকার দেয়নি। অথচ শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সারাটা দিন নানা অজুহাত আর অপব্যাখ্যার মাধ্যমে সেই কাজটিই করা হয়েছে। এটা ভালো হয়নি। এতে কোনও ভালো উদাহরণ সৃষ্টি হয়নি। বিএনপির সমাবেশ বন্ধ করা যায়নি। উপরন্তু বিরোধী দলের প্রতি জনগণের এক ধরনের সিমপ্যাথি তৈরি হয়েছে। মুর্খ বন্ধু যে কতটা বিপদজনক হতে পারে, এ ঘটনায় তা আরও একবার উপলব্ধি করা গেছে।

আমাদের জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। হয়তো একবছর দু’তিন মাসের মধ্যেই সেটা অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন মানেই সাধারণ মানুষের কাছে রাজনীতিবিদদের যাওয়া। গণতান্ত্রিক ধারার সৌন্দর্যটা এখানেই। অন্য সময় যে যাই করুন না কেন, অন্তত ভোটের সময় জনগণের কাছে যেতে হয়। তখন জনগণের নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হয়। তখন জনগণ যদি প্রশ্ন করে-  ২০২২ সালের ১৫ অক্টোবর কেন ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহরকে একটি অবরুদ্ধ জনপদে পরিণত করা হয়েছিল? কী জবাব দেবেন সরকারি দলের নেতারা? আমি করিনি, অন্যরা করেছে, প্রশাসন করেছে- এসব বলে কি পার পাওয়া যাবে? বরং তখন হয়তো উল্টো প্রশ্ন আসতে পারে, আপনারা তো ক্ষমতায় ছিলেন, আপনারা কেন ওদেরকে থামাতে পারলেন না?

সন্দেহ নেই, এসব বেশ কঠিন প্রশ্ন। তবে এটাও ঠিক, আপনি যদি জবাব দিতে না চান, যদি জবাব দেওয়ার প্রয়োজনই মনে না করেন, জনগণের কাছে জবাবদিহিতা ছাড়াই ক্ষমতায় যাওয়ার কোনও পথ আপনার জানা থাকে, তাহলে কোন সমস্যা নেই।      

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

   

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লিজেন্ডের ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশ সফরে জিম্বাবুয়ে
লিজেন্ডের ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশ সফরে জিম্বাবুয়ে
রাফাহ শহরে আবারও অভিযান চালাবে  ইসরায়েল?
রাফাহ শহরে আবারও অভিযান চালাবে ইসরায়েল?
রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে স্মরণ
রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে স্মরণ
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ