X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বড় পিরের উদার প্রগতিশীল মাদ্রাসা শিক্ষানীতি

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
১৩ নভেম্বর ২০২২, ১৮:৩৩আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২২, ১৮:৩৩

বড় পির খ্যাত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) ৪৭০ হিজরির রমজান মাসের প্রথম দিন পারস্যের তাবারিস্তানের জিলান নগরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিণত বয়েসে তিনি তার প্রতিভা, মেধা ও সাধনার দ্বারা বড় পির হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করলেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন বাগদাদে। তিনি তার মা উম্মুল খায়ের ফাতেমার কাছে আল-কোরআনের শিক্ষা গ্রহণ করেন। পিতা আবু সালেহ মুসা জঙ্গির কাছে জীবন সম্পর্কিত নানা বিষয়ে পাঠ নেন। শৈশবে পিতা ও মাতার কাছে ওই শিক্ষাগ্রহণ পরবর্তী জীবনে তাকে একজন উদার ও মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ওই শিক্ষা তাকে উদার ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনে উদ্দীপনা দেয়।

গভীর ধীশক্তি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও বিরল মেধার অধিকারী হওয়ায় আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) অল্প সময়ে অসাধারণ পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। ওই গুণের কারণে তিনি বাল্যকালেই খুব সহজে শিক্ষক ও সহপাঠীদের নজর কাড়তে সক্ষম হন। ফলে অল্প বয়সেই তিনি গুণিজনদের স্নেহশীল পাত্রে পরিণত হন। তার পিতার আর্থিক অবস্থা ভালো থাকায় তাকে বাল্যকালে অন্ন সংস্থানের জন্য চিন্তা করতে হয়নি। তিনি একনিষ্ঠ মনে পড়াশোনায় আত্মনিয়োগ করার সুযোগ পান। কিন্তু হঠাৎ পিতা আবু সালেহ মৃত্যুবরণ করলে তার পরিবার অর্থকষ্টে পড়ে। পরিবারে একমাত্র বৃদ্ধ মা ছাড়া অন্য কোনও সদস্য না থাকায় সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব কিশোর আবদুল কাদেরের ওপর অর্পিত হয়। ফলে তিনি তার পিতার রেখে যাওয়া জায়গা-জমি চাষ, ফলের বাগান ও গবাদিপশুর পরিচর্যায় আত্মনিয়োগ করেন। জ্ঞানের প্রতি গভীর টান থাকায় কিশোর আবদুল কাদেরের ওই সাংসারিক জীবন ভালো লাগেনি। তার মন আশা-নিরাশা ও সিদ্ধান্তহীনতার দ্বন্দ্বে জ্বলতে থাকে। জ্ঞানের সাধনায় নিজেকে আবারও নিযুক্ত করার জন্য তিনি উন্মুখ হয়ে পড়েন। ১৮ বছর বয়সে তিনি পাড়ি জমান তৎকালীন সময়ের জ্ঞানবিজ্ঞানের বাতিঘর খ্যাত বাগদাদ নগরীতে। পারস্যের জিলান নগর থেকে পাড়ি জমান বাগদাদে।

বাগদাদ পৌঁছে বড় পির হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) তখনকার বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ নিজামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ওই মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে তিনি বিজ্ঞান, ব্যাকরণ, হাদিস ও তাফসির শাস্ত্র, ফিকাহ, সাহিত্য, ভূগোল ও ইতিহাস অধ্যয়ন করেন। জগৎশ্রেষ্ঠ শিক্ষকরা নিজামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি প্রখর ধী-শক্তি, বিরল মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে অচিরেই শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্রে পরিণত হন। পড়াশোনায় অধিক মনোযোগের কারণে তাকে অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে হতো। তৎকালীন বাগদাদ নগরীতে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ায় তার পক্ষে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ বা উদার মানুষদের নিকট থেকে আর্থিক সহায়তা লাভও সম্ভব হয়নি। আর্থিক দুঃসময়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটানোর মধ্যে একদিন জিলনবাসী এক সফরকারীর মাধ্যমে তার মায়ের পাঠানো ৭টি স্বর্ণমুদ্রা পান। উদার হজরত আবদুল কাদের জিলানী নিজের আর্থিক দুরবস্থা থাকা সত্ত্বেও ওই স্বর্ণমুদ্রা থেকে পাঁচটি আগন্তুকের পথের খরচ হিসেবে প্রদান করে মাত্র দুটি স্বর্ণমুদ্রা নিজের কাছে রাখেন।

তিনি অর্থের চেয়ে জ্ঞানার্জনকে সর্বদা প্রাধান্য দিয়েছেন। ছাত্রজীবনে অধিক অর্থ জ্ঞান অর্জনের পথে বাধা হতে পারে সেই বিষয়টি তিনি ভালোভাবে বুঝতেন বলেই সর্বদা কষ্টের জীবনকে বেছে নিয়েছেন। অর্থ উপার্জনের বদলে জ্ঞান অর্জন ছিল তার জীবনের সাধনা। তাই দুঃখ, কষ্ট ও দৈন্যতায় পতিত হয়েও চূড়ান্ত ফলাফলে তিনি নিজামিয়া মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদের অধিকারী হন। পবিত্র আল-কোরআন, হাদিস, তাফসির, ফিকাহ, দর্শন, ভূগোল, সাহিত্য, ব্যাকরণ, রসায়ন ও ইতিহাস শাস্ত্রে তিনি বুৎপত্তি লাভ করেন। তখনকার উপর্যুক্ত বিষয়ে হজরত আবদুল কাদের জিলানীর (রহ.) সমকক্ষ অন্য কোনও পণ্ডিত ছিলেন না বললেই চলে। তার ওই বিরল প্রতিভা তৎকালীন বিশ্বে তাকে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করে। শিক্ষাগ্রহণ শেষে উচ্চপদে চাকরির নানা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের অর্জিত জ্ঞান অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার মানসে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।

তিনি নিজামিয়া মাদ্রাসার ছাত্র হলেও শিক্ষকতা শুরু করেন তখনকার আরও একটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কাদেরিয়া মাদ্রাসায়। হজরত আবদুল কাদের জিলানীর (রহ.) শিক্ষক শায়খ মুবারক উপর্যুক্ত কাদেরিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি অতিশয় বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। ফলে তার পক্ষে কাদেরিয়া মাদ্রাসা উপযুক্তভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই কাদেরিয়া মাদ্রাসার ছাত্রসংখ্যা ও অবকাঠামো বাড়ানো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে তিনি নিজামিয়া মাদ্রাসার খ্যাতিমান ছাত্র হজরত আবদুল কাদের জিলানীকে (রহ.) তার মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান। হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) শায়খ মুবারকের আমন্ত্রণ গ্রহণ এবং সানন্দচিত্তে কাদেরিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ওই মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে তিনি শিক্ষার্থীদের দুই বেলা শিক্ষা প্রদান করতেন। তিনি সকালে ফজরের নামাজ পড়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান শুরু করতেন। জোহরের নামাজের আগ পর্যন্ত ওই পাঠদান চলতো। এই সময়ে তিনি শিক্ষার্থীদের হাদিস, ন্যায়বিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব, উসুল ও সাহিত্য এবং ব্যাকরণের পাঠ দিতেন। জোহরের নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার গ্রহণ ও হালকা বিশ্রাম শেষে তিনি পুনরায় শিক্ষার্থীদের এশা পর্যন্ত পাঠদান করতেন। ওই সময়ে তিনি শিক্ষার্থীদের আল-কোরআন, অনুবাদশাস্ত্র, ফিকাহ ও তৌহিদ সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করতেন। হজরত আবদুল কাদের জিলানীর (রহ.) মতো তার ছাত্ররাও অগাধ পাণ্ডিত্য, মহৎ চরিত্র ও অনুসন্ধিৎসার জন্য প্রসিদ্ধ হয়। তার ছাত্রদের মধ্যে হজরত আবদুল্লাহ খাতেয়ানী, হজরত আলী ইবনে আবু বকর ইবনে ইদ্রিস, হজরত আবু মোহাম্মদ আবুল হাসান জাবারী প্রমুখ অন্যতম ছিলেন।

হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) অল্প সময়ে শিক্ষক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। তার খ্যাতি এত বিস্তৃত হয় যে অচিরেই বাগদাদে অবস্থিত ও শায়খ মুবারক প্রতিষ্ঠিত ওই মাদ্রাসাটি তার প্রতিষ্ঠাকালীন নামের বদলে হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) নামে কাদেরিয়া মাদ্রাসা হিসেবে দুনিয়াব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠে। তিনি সব ধর্মের, সব মতের, সব দেশের মানুষদের জন্য তার মাদ্রাসা খুলে দেন। পড়ার পরিবেশ ও কারিকুলাম তৈরি করেন। ফলে এশিয়া, ইউরোপ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে দলে দলে ছাত্ররা তার কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য কাদেরিয়া মাদ্রাসায় ভিড় জমায়। নতুন নতুন শিক্ষার্থীর আগমনের ফলে মাদ্রাসার গৃহ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় দাঁড়িয়ে দরছ গ্রহণ করা ছাত্রদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ছাত্ররা খোলামাঠ, অলিতে-গলিতে দাঁড়িয়ে, বৃক্ষছায়া ও বাসগৃহের ওপর বসে বড় পির হজরত আবদুল কাদের জিলানীর পাঠ গ্রহণ করতেন। এমতাবস্থায় কাদেরিয়া মাদ্রাসার পরিসর বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। বৃদ্ধ শায়খ মুবারকের পক্ষে ওই বৃহৎ কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করা অসম্ভব ছিল বিধায় হজরত আবদুল কাদের জিলানী শিক্ষকতার পাশাপাশি কাদেরিয়া মাদ্রাসার অবকাঠামো নির্মাণেও মনোযোগী হন। তিনি মাদ্রাসা সম্প্রসারণের জন্য সঙ্গতিসম্পন্ন ও শিক্ষাপ্রাণ মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাদের কাছে মাদ্রাসার সম্প্রসারণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে অবদান রাখার আহ্বান জানান। খ্যাতিমান শিক্ষক হজরত আবদুল কাদের জিলানীর আহ্বানে দলে দলে মানুষ সাড়া দেয়। অনেকে আর্থিকভাবে আবার কেউ কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে মাদ্রাসার সম্প্রসারণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে অবদান রাখেন। নারীরাও ওই উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে যুক্ত হন। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে কাদেরিয়া মাদ্রাসার জায়গা ও অবকাঠামো সমস্যার সমাধান হয়।

চারদিকে যখন হজরত আবদুল কাদের জিলানীর (রহ.) সুনাম ছড়িয়ে পড়ে তখন তিনি নিজ জন্মভূমি জিলানে ফিরে যাওয়ার মনস্থির করেন। তার বাগদাদ ত্যাগ করে জিলানে ফিরে যাওয়ার সংবাদ অবগত হয়ে বাগদাদবাসী রাস্তায় নেমে আসেন। তারা কোনোভাবেই হজরত আবদুল কাদের জিলানীকে (রহ.) বাগদাদ ত্যাগ করতে দিতে রাজি ছিল না। অন্যদিকে হজরত আবদুল কাদের জিলানীর (রহ.) শিক্ষক শায়খ মুবারকও তার প্রিয় ছাত্রকে ত্যাগ করতে রাজি নয়। ফলে তিনি হজরত আবদুল কাদের জিলানীকে (রহ.) বাগদাদ ত্যাগ করতে নিষেধ করেন। শিক্ষকের ওই আদেশ তিনি সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেন। ফলে তারপক্ষে আর বাগদাদ ত্যাগ করে জিলানে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এভাবে তিনি বাগদাদের সঙ্গে আমৃত্যু তার ভাগ্যকে জড়িয়ে ফেলেন।

অবশেষে  ৯১ বছর বয়সে ১১ রবিউস সানী ৫৬১ হিজরিতে এই বাগদাদ নগরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন আধ্যাত্মিক গুরুও। সেই কারণে তাকে সুফিদের উস্তাদ বলা হয়। তার ছাত্রদের পাশাপাশি সুফিরাও তাকে সমানভাবে সম্মান করতেন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেসি অনভিজ্ঞ বলেই আপত্তি ছিল মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংকের
জেসি অনভিজ্ঞ বলেই আপত্তি ছিল মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংকের
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ