X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতিতে পাল্টা ‘লু হাওয়া’!

প্রভাষ আমিন
১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১৯:১১আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১৯:১১

আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের কথা শুনলে মনে হয় আন্দোলন, সংগ্রাম, সমাবেশ, ভোট, নির্বাচন– এগুলো আসলে ‘বাত কি বাত’। বাংলাদেশে ক্ষমতায় কে যাবে, কে থাকবে; তা আসলে বাংলাদেশে নির্ধারণ হয় না। কখনও প্রণব মুখার্জি, কখনও সুজাতা মেহতা, কখনও মার্কিন রাষ্ট্রদূত, কখনও ব্রিটিশ হাইকমিশনার, কখনও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কখনও ডোনাল্ড লু’রাই নাকি ঠিক করে বাংলাদেশের ক্ষমতায় কারা থাকবে। পশ্চিমা ডিপ্লোম্যাটরা বাংলাদেশে ভিআইপি মর্যাদা পান। গণমাধ্যমও কম যায় না। পশ্চিমা ডিপ্লোম্যাটদের সব কথাই নিউজ হয়। আমরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জানতে চাই বিদেশিদের কাছে। ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণে কিনা জানি না, আমরা যেন আমাদের গণতন্ত্র তাদের কাছে ‘লিজ’ দিয়ে রেখেছি। এই কাজে কেউ কারও চেয়ে কম নয়। এখন বিএনপি বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে। বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগও দিয়েছে। ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’।

বিএনপির নানামুখী চেষ্টা সত্ত্বেও টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি তাই বুঝে গেছে, নিজেদের সক্ষমতায় তারা আওয়ামী লীগকে সরাতে পারবে না। তাই তারা এখন তাকিয়ে আছে বিদেশিদের দিকে। ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারত এবং চীনও বাংলাদেশকে নিজ নিজ বলয়ে রাখতে চাইবে। তাই তারাও তাদের মতো চেষ্টা চালায়।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিলে বিরোধী শিবিরে উল্লাসের ঢেউ বয়ে যায়। তাদের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছিল, ক্ষমতায় আসাটা বুঝি সময়ের ব্যাপার মাত্র। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করার মতো দেশের ভাবমূর্তিকে ধুলায় লুটিয়ে হলেও ক্ষমতায় যেতে তৈরি ছিলেন কেউ কেউ। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, এটা যেমন ঠিক; আবার এই নিষেধাজ্ঞার কারণেই বাংলাদেশে ডালভাত হয়ে যাওয়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়েছে। ‘দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তবে তো দাগই ভালো’ এই বিজ্ঞাপনের মতো, মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় আমিও স্বস্তি পেয়েছি। এই নিষেধাজ্ঞা অনেক মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ– গুম-খুন; গত এক বছরে তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

তবে তখন থেকেই সরকারবিরোধীরা বলছিলেন, আরও বড় নিষেধাজ্ঞা আসছে। ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আরও বড় নিষেধাজ্ঞা আসছে এই আশায়, বিএনপি ঢাকায় গণসমাবেশ ডেকেছিল। দেশের বাইরে বসে যারা প্রতিদিন ইউটিউবে রাজা-উজির মানে, আর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখেন; তারা ১০ ডিসেম্বর সরকার পতন অবশ্যম্ভাবী বলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি- নতুন কোনও নিষেধাজ্ঞা আসেনি, সরকারের পতনও ঘটেনি।

১০ ডিসেম্বরের পর আবার ১৪ ডিসেম্বর নতুন করে আশায় বুক বাঁধে বিরোধীরা। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস রাজধানীর শাহীনবাগে গুম হওয়া এক বিএনপি নেতার বাসায় গেলে সেখানে ‘মায়ের কান্না’ একটি সংগঠন তাতে স্মারকলিপি দিতে যায়। দ্রুত ঘটনাস্থল ছেড়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন পিটার হাস। তখন বাংলাদেশের মন্ত্রীরাও বেশ গরম ছিলেন। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন সরকারের মন্ত্রীরা। মার্কিনিদের ‘মাতব্বরি’ নিয়েও অসন্তুষ্ট ছিলেন খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীও। আর সেই টানাপোড়েনের আগুনে আলু পুড়ে খেতে চেয়েছিল বিএনপি। তাই মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র সফর নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রীতিমতো লু হাওয়া বয়ে যায়। আগে থেকেই চলছিল নানান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সফর শেষ হওয়ার পরও যা থামেনি। ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সরকারকে কঠিন বার্তা দিয়ে যাবে, এমন আশায় যারা বুক বেঁধেছিলেন, তাদের আশার গুড়ে বালি পড়েছে। ডোনাল্ড লু দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে নেপাল-শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে নাক গলানোর রেকর্ড আছে তার। পাকিস্তানের ইমরান খান তো তার পতনের জন্য ডোনাল্ড লু’কে দায়ী করেছিলেন। সেই লু বর্তমান সরকারকে বিদায়ী বার্তা দেবে, এমন আশায় যারা বসেছিলেন, তাদের হতাশ হতে হয়েছে।

ডোনাল্ড লু’র সফরের আগের আলোচনা আর পরের আলোচনা আকাশ-পাতাল তফাত। বলা যায় সম্পর্কের ইউটার্ন হয়েছে। দুদিনের সফরে ডোনাল্ড লু ব্যস্ত সময় কাটালেও সেখানে বিএনপি বা অন্য কোনও বিরোধী দলের ঠাঁই ছিল না। নিরেট সরকারি সফর।

সফরে ডোনাল্ড লু বরং সরকারের জন্য ইতিবাচক বার্তাই দিয়ে গেছেন। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ক্ষমতা তো আর ডোনাল্ড লু’র নেই। তবে র‌্যাবের কর্মকাণ্ডের অসামান্য উন্নতির প্রশংসা করেছেন তিনি। জিএসপি চালু হলে সবার আগে বাংলাদেশ পাবে বলেও আশ্বাস ছিল তার কণ্ঠে। আগামী নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়েও তিনি সরকার এবং সুশীল সমাজের সঙ্গে কথা বলেছেন। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কিনা, তা নিয়ে তার জিজ্ঞাসা ছিল। নির্বাচনের সময় সরকারের ভূমিকা, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিয়েও জানতে চেয়েছেন তিনি। সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। তার মানে বিরোধী দলের মূল দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসার কোনও সম্ভাবনা যে নেই, সেই বার্তা দিয়েছে সরকার। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বার্তা দিয়েছে।

অনেকে যেমনটি ভেবেছিলেন, ডোনাল্ড লু এসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘লু হাওয়া’ বইয়ে দেবেন; তাদের জন্য তার সফরটি হতাশারই ছিল। হাওয়া বয়েছে, তবে তা উল্টোদিকে। ডোনাল্ড লু’র সফর সরকারকে আরও আত্মবিশ্বাসী করেছে। বাংলাদেশ সরকারের সুরও নরম। তারা বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বার্তা দিচ্ছেন। আপাতত বিরোধী পক্ষকে অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ