X
রবিবার, ১১ মে ২০২৫
২৮ বৈশাখ ১৪৩২

ট্যাক্স বার কাউন্সিল গঠন এখন সময়ের দাবি

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন
২১ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:৩৭আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:৩৭

আজকের বিষয়বস্তু নিয়ে বলার আগে বিদ্যমান বার কাউন্সিল সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। আইন আদালতের বিষয়টি অনেক পুরনো, জটিল ও ঝামেলাযুক্ত। তাই এর প্রয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের তেমন কোনও আগ্রহ ছিল না। বর্তমানে সকল পেশা-শ্রেণির মানুষের কাছে আইন-আদালত পরিচিত একটি শব্দ।

পেশাজীবী হিসেবে যারা আইন জগতে প্রবেশ করেছেন, তারা সব সময় চেয়েছেন আইনের সুষম প্রয়োগ। আর আইনের এই সুষম প্রয়োগে মূল পক্ষ হচ্ছে বিচারক, অপরাধী ও প্রতিকার প্রার্থী। বিজ্ঞ বিচারকগণ আইন-বিচারের প্রারম্ভিক যুগেও চিন্তা করেছেন এক পক্ষীয় সিদ্ধান্ত দেওয়ার মধ্যে ত্রুটি থাকতে পারে। এছাড়া যিনি অপরাধ করেন তার মোটিভ/তার যৌক্তিক কারণ ব্যাখ্যা করা অনেক সময় অপরাধীর পক্ষে সম্ভব হয় না। একইভাবে বিচারপ্রার্থীর ক্ষেত্রেও হতে পারে। তাই বিচার প্রক্রিয়া উপরোক্ত তিন পক্ষ (বিচারক, অপরাধী ও প্রতিকারপ্রার্থী)কে সহযোগিতা করার জন্য তৃতীয় পক্ষকে সংযুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই তৃতীয় পক্ষের পরিচিতি হলো উকিল/অ্যাডভোকেট বা ব্যারিস্টার।

ইতিহাস থেকে জানা যায় সভ্যতার শুরু থেকেই আইনজগতে পরামর্শক বা সহযোগিতার ব্যবহার প্রচলন ছিল। মুসলিম শাসন ব্যবস্থায়ও আইন পেশার (ওকালতি) গুরুত্ব ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তখন মুফতিগণ বিচারকাজে বিজ্ঞ আদালতকে সহযোগিতা করতেন। ১৭০০ সালের গোড়ার দিকে আমেরিকার উপনিবেশযুক্ত রাজ্যগুলো আইন পেশায় শক্তিশালী ভূমিকায় আসতে শুরু করে। সে সময়ে ইংলিশ আইনে পারদর্শী আইনজীবীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং সম্মানের সঙ্গে তারা সারা দুনিয়াজুড়ে অভিজ্ঞতার কাতারে চলে আসে। এটা সম্ভব হয়েছে তাদের তখনকার রাষ্ট্রের সময়োপযোগী ভূমিকা  কার্যকর মনোযোগ এবং আইন পেশায় আগ্রহ, জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ ও উপযুক্ত পরিবেশ।

সময়ের বিবর্তনে অপরাধের ধরন যেমন নানারুপ ধারণ করছে, একইভাবে দুষ্টের দমন করার জন্য সরকারগুলো নতুন নতুন আইনের ও প্রবর্তন করেছে। নানা আইন নানা ধারা। এই বিপুল সংখ্যক আইনের ধারা বুঝা, মনে রাখা, বিচারকাজে সহযোগিতা করা একই ভাবে আইন পেশার উন্নতি ঘটানো সত্যিই এক চ্যালেঞ্জিং কাজ, মেধার বিষয়। এখন বিষয়ভিত্তিক পারদর্শী পেশাদার গড়ে উঠতে সহযোগিতা, মনোনিবেশ করা দরকার। এর প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে ব্যাপক। এটা এখন বাস্তবতা।

আইন পেশায় নিয়োজিত পেশাজীবীদের যোগ্যতা নির্ধারণ, পেশার মাননিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটা কর্তৃপক্ষ থাকার প্রয়োজনীয়তা সভ্যতার মধ্য যুগ থেকেই দেখা দেয়। মূলত এটাই ছিল বার কাউন্সিল গঠনের প্রারম্ভিক কাল। এরপর ধীরে ধীরে এই প্রক্রিয়ার উন্নতি লাভ করতে থাকে। ভারত বর্ষে প্রথম ১৯২৬ সালে ব্রিটিশ সরকার আইনজীবীদের পেশাগত মান বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে বার গঠনের উদ্যোগ নেয়।

ভারতে সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি, আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় বোর্ড মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত তাদের বার্ষিক সাধারণ সভায় সমগ্র ভারতের জন্য বারের প্রস্তাব দেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে অধ্যায়ন, আইন পেশার যোগ্যতা নির্ধারণসহ একটি প্রস্তাব উপস্থাপন ও অনুমোদন করে। অতপর ভারতে অ্যাডভোকেট অ্যাক্ট ১৯৬১ এর ৪ ধারা মোতাবেক দ্য ইনডিয়ান বার কাউন্সিল গঠন করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ৪৬ নং অধ্যাদেশ বলে ‘দ্য বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার’স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২’ গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশের আইন পেশায় নিয়োজিত আইনজীবীদের যোগ্যতার মূল্যায়ন ও পেশাগত মান নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে আসছে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল।

পূর্বেই বলেছি নানা আইন, নানা ধারা। এতসব আইনে সবাই পারদর্শী হওয়া কঠিন। এটা বাস্তবতা। বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের জন্য বিশেষ করে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের জন্য এখন পর্যন্ত যে আইনটি আছে তা হলো ‘আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪’। যুগের চাহিদা অনুযায়ী এনবিআর থেকে খসড়া আয়কর আইন-২০২২ প্রকাশ করেছে। কবে নাগাদ এই আইন বাস্তবায়নে আসবে তা বলা কঠিন। এই আইনের ধারা এবং কার্যকারিতা অন্য সব আইনের প্রয়োগ প্রক্রিয়া থেকে ভিন্ন ধর্মী। এখানে নিয়মিত প্র্যাকটিস না থাকলে মানসম্মত ও যৌক্তিকভাবে আইন প্রয়োগ করা কঠিন হয়!

আমাদের অনেকের ধারণা সাধারণত যোগ-বিয়োগ করে মিলিয়ে দিতে পারলেই আয়কর রিটার্ন হয়ে যায়। এটা সাময়িক বুঝ দেওয়ার জন্য হয়তো চলে। এনবিআরও মেনে নিচ্ছে। ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা অনেক উত্তম’। কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন, নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, নাগরিকদের রাজস্ব পরিশোধ ও আইনের প্রয়োগ করতে হলে বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত পেশাজীবীর অনেক বেশি দরকার। গুরুত্বও দেওয়ার এখনই সময়। বর্তমানে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ধারা ১৭৪(২)এফ এবং আয়কর বিধিমালার বিধি ৩৭ মোতাবেক আয়কর পেশাজীবী সনদ প্রদানের ক্ষমতা এনবিআরকে প্রদান করা হয়েছে।  

এই পেশাজীবী নির্বাচনে শিক্ষাগত যোগ্যতা পুননির্ধারণ করা প্রয়োজন। যে কোনও বিষয়ের প্রার্থী এই পেশায় না এনে বরং ব্যবসায় শাখায় অধ্যায়নরতদের সুযোগ দিলে যোগ্যতা সম্পন্ন পেশাজীবী তৈরি করা সম্ভব হবে। এর সাথে আইনে পড়াশোনা থাকলে অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এটা আমার সুপারিশ। 

বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় রাজস্ব আদায়ের কৌশল পরিবর্তন করা আবশ্যক। এই কৌশল পরিবর্তন শুধু নয়, বাস্তবায়নে নিতে হবে নানামুখী উদ্যোগ। এই উদ্যোগগুলোর মধ্যে পরিষেবা নাগরিকের হাতে যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমিন রাজস্ব আদায়ে যোগ্য নাগরিকদের সম্পৃক্ত করতে হবে।

এখনও করযোগ্য আয় আছে এমন বিপুল সংখ্যক নাগরিক সরকারকে ট্যাক্স দিতে চান না। নানাভাবে এড়িয়ে চলেন। বাধ্য হয়ে রিটার্ন জমা দিতে আসলেও অনেকে বলেন ‘এমনভাবে ক্যালকুলেশন দেখান, যাতে কর দিতে না হয়’। এই আবদার কী করে একজন নাগরিক করেন। বুঝতে কষ্ট হলেও পরিষ্কার। দোষটা একান্ত করদাতাকে না দিয়ে যদি আমাদের কর ব্যবস্থাপনার দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাচ্ছি, এই নাগরিককে কর দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে আমরা ব্যর্থ। কারণ আমরা শুধুই আইনের ভয় দেখাতে অভ্যস্ত। কিন্তু তাকে বুঝাতে পারছি না কেন কর দেবেন বা কর দেওয়া উচিত। কেন নাগরিক সচেতনতা তৈরি করতে পারছি না এমন প্রশ্নের উত্তর সরল। জনবলের অভাব। আসলে জনবল আছে। ব্যবহার করতে আমরা অভ্যস্ত নয় বা ব্যবহারের কৌশল প্রয়োগ করতে পারছি না। তাহলে এই কৌশল আইনের মধ্যে থেকেই সম্ভব। যে আইন এনবিআরকে আয়কর পেশাজীবী সনদ প্রদানের ক্ষমতা দিয়েছে, সেই আইনের মধ্যে এই সনদ প্রাপ্ত পেশাজীবীদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলেই জনবল সংকট অনেকটা কেটে যাবে। আয়কর পেশাজীবীদের রাজস্ব আদায়ে সম্পৃক্ত করার প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে।

যেমন:

১. প্রত্যেক সনদধারী আয়কর আইনজীবীকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা;

২. নিয়মিতভাবে পেশায় সম্পৃক্ত থাকার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা;

৩. নির্ধারিত এলাকা নির্বাচন করে দায়িত্ব দেওয়া;

৪. করদাতার সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে আয়কর আইনজীবীদের “কর পরিদর্শক” মর্যাদা প্রদান করা;

৫. নির্ধারিত আয়কর আদায়ের কমিশন প্রদান করা; বা শর্ত সাপেক্ষে মাসিক সম্মানী প্রদানের ব্যবস্থা করা;

৬. পেশায় নিয়োজিত আইনজীবীদের তালিকা এনবিআর এর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা;

৭. ট্যাক্স বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য পদ নিশ্চিত করা; 

ট্যাক্স বার কাউন্সিল কেন প্রয়োজন: উপরোক্ত আলোচনা এবং একজন আয়কর পেশাজীবী হিসেবে এই পেশার মান উন্নয়নের সরকারের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন মনে করছি। ভবিষ্যতের স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য আয়কর পেশাজীবী একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই পেশায় নিয়োজিত পেশাজীবীগণকে পেশাগতভাবে নিয়ন্ত্রণ, পেশাগত আচরণ পরিপালনে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার এখনই উপযুক্ত সময়। এছাড়া ব্যাপক পরিসরে নাগরিকদের আয়কর বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে না পারলে রাজস্ব আদায় কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে আদায় করা দূরহ হয়ে দাঁড়াবে। ২০২২-২৩ কর বর্ষে আয়করের চিত্র দেখে আমরা সত্যিই আশাহত হতে হয়েছে।

এনবিআর থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে ১ জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন জমা হয়েছে (প্রায়) ২৮ লাখ ৫০ হাজারটি। আয়কর আদায় হয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকা। যদিও বলা হয়েছে বিগত বছরের তুলনায় (%) বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু মোট জনসংখ্যার তুলনায় মাত্র ২৮ বা ২৯ লাখ রিটার্ন জমা ভালো সংবাদ বলা যায় না। ই-টিআইন ধারীর সংখ্যার অর্ধেকও রিটার্ন জমা দেননি। এখন পর্যন্ত টিআইএন ধারীর সংখ্যা ৮২ লাখেরও বেশি। 

এখানে “০” রিটার্ন (যাদের আয় করসীমার নিচে) জমার সংখ্যা বাদ দিলে করদাতার সংখ্যা আরও অনেক কমবে।

এই পরিস্থিতি উত্তোরণের জন্য কার্যকরভাবে একটি ট্যাক্স বার কাউন্সিল গঠন করে রাজস্ব আদায়ে অভিজ্ঞ পেশাদার আয়কর আইনজীবী তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। সরকারকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি ও নাগরিকদের মধ্যে কর-ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য প্রস্তাবটি বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।

লেখক: আয়কর আইনজীবী

[email protected]

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আমিরাতে সিঙ্গাপুরের গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে তাহসিনের ড্র
আমিরাতে সিঙ্গাপুরের গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে তাহসিনের ড্র
ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতাকে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ
ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতাকে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ
কিশোরগঞ্জে বজ্রাঘাতে তিন কৃষকের মৃত্যু
কিশোরগঞ্জে বজ্রাঘাতে তিন কৃষকের মৃত্যু
ছাত্রলীগের আরেক কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার
ছাত্রলীগের আরেক কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার
সর্বশেষসর্বাধিক