X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা কি শুধুই আনুষ্ঠানিক হয়ে যাচ্ছি!

রেজানুর রহমান
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:০৭আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:০৭

আমরা কি খুব বেশি আনুষ্ঠানিক হয়ে যাচ্ছি? মাতৃভাষার জন্য মায়া দেখাতে হবে, সে জন্য আছে ফেব্রুয়ারি মাস। গোটা ফেব্রুয়ারিতে আমরা মাতৃভাষার জন্য এতটাই মায়া ও ভালোবাসা দেখাবো, মনে হবে দেশে মাতৃভাষা বাংলার আর কোনও অমর্যাদা হবে না। অথচ ফেব্রুয়ারি শেষ হতে না হতেই মাতৃভাষা বাংলাকে বেমালুম ভুলে যাবো। সাধারণ একটা সিদ্ধান্ত হয়েছিল, দেশে কোনও প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড শুধু ইংরেজিতে লেখা যাবে না। বাংলায় বড় করে সাইনবোর্ড অথবা নামফলক লিখতে হবে। পাশে অর্থাৎ বাংলার নিচে ছোট করে ইংরেজিতে সাইনবোর্ড অথবা নামফলক লেখা যাবে। কিন্তু সারা দেশে ঘটছে উল্টোটা।

সাইনবোর্ডে বাংলা নেই। থাকলেও ইংরেজি ওপরে বেশ বড় করে লেখা। আর বাংলা ইংরেজির নিচে, ছোট করে দায়সারাভাবে স্থান পায়। ঢাকা শহরের প্রতিটি রাস্তায় সাইনবোর্ড আর নামফলকে ইংরেজি ভাষারই রাজত্ব। ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকায় দেখলাম সাইনবোর্ডে বাংলা ভাষার কোনও অস্তিত্বই নেই। ধানমন্ডির একটি রাস্তার পাশাপাশি দুটি সুউচ্চ ভবনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের নাম বড় বড় করে শুধু ইংরেজিতেই লেখা হয়েছে। দেশের সর্বাধিক প্রচারিত একটি দৈনিকে এ ব্যাপারে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর ভেবেছিলাম এবার বোধকরি কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে। না, কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

ফেব্রুয়ারির পর আসবে মার্চ মাস। স্বাধীনতার মাস। আমরা এবার অনেক বেশি দেশপ্রেমিক হবো। নাটকের মঞ্চ জেগে উঠবে। স্বাধীনতাভিত্তিক নাটকের মঞ্চায়ন হবে জোরেশোরে। স্বাধীনতাভিত্তিক চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী বাড়বে। স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে অনেক আলোচনা হবে। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অনেক কথা হবে। তাদের সম্মান জানানোর নানা প্রক্রিয়া চলবে। মার্চ মাস যেতে না যেতেই আমরা বেমালুম স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা ভুলে যাবো। স্বাধীনতাভিত্তিক গল্পের নাটক, সিনেমা আর মঞ্চস্থ অথবা প্রদর্শনের ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে না।

মার্চের আগে ফেব্রুয়ারি মাসের কথাটা আরেকটু বলি। ভাষার জন্য মায়া ছড়াতে আমরা একুশে বইমেলায় যাবো দলবেঁধে। আগে ছিল শুধু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা। এখন বইমেলা চলে গেছে সামনের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বইমেলা এখন শুধু বড় নয়, অনেক বিশাল। একদিনে বইমেলা ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। বইমেলায় প্রতিদিন হাজার-হাজার মানুষ আসছেন। শুক্র, শনি ছুটির দিনে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। হায়রে ভিড়। কিন্তু বইয়ের মেলায় বইয়ের বিক্রি কেমন? মেলা মানেই দলবেঁধে আড্ডা, নানা অনুষ্ঠান আর কেনাকাটা। বইমেলায় দলবেঁধে আড্ডা হচ্ছে ঠিকই। সেলফি তোলার হিড়িক সর্বত্র। ‘আমি এখন বইমেলায়....’ গর্ব করে ফেসবুকে এ কথা জানিয়ে দেন অনেকে। আড্ডা দেন, অনুষ্ঠান দেখেন, খাবারের দোকানে ভিড় করেন। সেই তুলনায় বইয়ের বিক্রি কি হয়? বইয়ের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা দেখান কতজন? তবু ভালো বইয়ের জন্য একটা মাস আলোচনা হয়। অনেকেই বই কিনেন। বইমেলা শেষ। বইপড়ার কথা আর কারও মনে থাকে না। এমনও হয় যারা বই কিনেন মেলা থেকে তারা বই বাসায় নিয়ে এসে আলমারিতে সাজিয়ে রাখেন, অনেকে বইয়ের পাতাও উল্টে-পাল্টে দেখেন না। তাহলে কেন বইমেলায় যাই? উত্তর– সবাই যায়, আমিও যাই। না গেলে স্ট্যাটাস থাকে না। তাহলে বই কিনি না কেন? সহজ উত্তর– সবাই কিনে না, আমিও কিনি না। তার মানে আমরা বেশি বেশি আনুষ্ঠানিক হয়ে যাচ্ছি? এই প্রশ্নের কোনও সহজ উত্তর নেই।

আবার মার্চ মাসে আসি। মার্চে আছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আমরা এবার অনেক বেশি নারীবান্ধব হয়ে যাবো। নারীর মর্যাদায় রক্ষায় অনেক বেশি সোচ্চার হবো। নারীর মর্যাদা নিয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হবে। নারীর জন্য সংবর্ধনার নানান আয়োজন থাকবে। দেখে মনে হবে হ্যাঁ, এবার সত্যিকার অর্থে দেশের নারীরা যথাযোগ্য মর্যাদা পেতে যাচ্ছে। মার্চ যেতে না যেতেই আমরা অনেকেই নারীর মর্যাদার কথা আবার বেমালুম ভুলে যাবো, ভুলে যাই। এই আনুষ্ঠানিকতার মানে কী?

প্রতি বছর পহেলা ফাল্গুন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালনের জন্য আমরা যারপরনাই মরিয়া হয়ে উঠি। আর কেউ না হোক, তরুণ-তরুণীরা এই দিনটির কথা ভোলেন না। ভালোবাসা দিবসে সবাই ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে এতটাই আন্তরিক ভূমিকা দেখাতে শুরু করেন যে দেখে মনে হবে ভালোবাসার মহাসমুদ্রে ভাসছে দেশ। ১৪ ফেব্রুয়ারি শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, সারা দেশে ভালোবাসার উৎসব হয়েছে। ১০ টাকার গোলাপ ফুল ৬০-৭০ টাকায় কিনতে গিয়ে কাউকে তর্ক করতে দেখিনি। ৬০-৭০ টাকার একটি ফুল খোপায় গুঁজে মাত্র কয়েক ঘণ্টা রাখার পর অনেকেই তা ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। এই দৃশ্য দেখে বারবারই একটা কথাই মনে পড়েছে, যৌক্তিকভাবে চালের দাম বাড়লেও আমরা তা মেনে নিতে পারি না। অথচ ১০ টাকার ফুল কিনলাম ৬০-৭০ টাকায়। ভালোবাসার জন্য একটা দিনে কতই না হইচই করলাম। পরের দিনই ভালোবাসা উধাও। তাহলে এমন আনুষ্ঠানিকতার মানে কী?

অনেকেই হয়তো আমার বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, জন্মদিন একটি বিশেষ দিন। আপনি দিনটি পালন করতেই পারেন। মাতৃভাষার জন্যও আপনি একটি মাসকে গুরুত্ব দিতে পারেন। তাই বলে বছরের বাকি ১১ মাস মাতৃভাষাকে ভুলে থাকবো? বই পড়ুন। বই পড়ার উৎসাহ বাড়াতে বইমেলা হতেই পারে। তার মানে এই নয় বইমেলায় এসে প্রমাণ করতে চাচ্ছি আমি অনেক বইপ্রেমী। বইমেলা শেষ, বইয়ের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। চক্ষু লজ্জার খাতিরে বইমেলা থেকে বই কিনে বাসায় এনে আলমারিতে রাখলাম। তারপর আর কোনও খোঁজ নেই। এমন আনুষ্ঠানিকতারই বা প্রয়োজন কী?

কে না জানে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা এখনও কতটা অবহেলিত। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি মন্তব্য তুলে ধরতে চাই। তিনি বলেছেন, মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে মূলত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু মাতৃভাষা বাংলা এখনও প্রকৃত মর্যাদা পায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষাবিদ বললেন, আমাদের অনেক সৌভাগ্য যে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বইমেলা হয়। বইমেলার কারণে মাতৃভাষার আলোচনাও গুরুত্ব পায়। একুশে বইমেলা না থাকলে আমরা হয়তো মাতৃভাষা বাংলাকে অনেক আগেই গুরুত্বহীন করে তুলতাম।

এ কথা সত্য, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শুধু মাতৃভাষা বাংলাকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা বেশি দূর যেতে পারবো না। আর তাই বিদেশি ভাষা বিশেষ করে ইংরেজির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া সময়েরই দাবি। তাই বলে বাংলাকে ভুলে? এমনও দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ কোনও আলোচনা সভা চলছে। শ্রোতা দর্শক সবাই বাঙালি। অথচ আলোচনা চলছে ইংরেজি ভাষায়। এই প্রবণতা কেন? এ ধরনের অনেক প্রশ্নের সন্তোষজনক সমাধান জরুরি। আরও জরুরি আমরা যেন শুধু আনুষ্ঠানিক না হয়ে যাই।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো। 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ