X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিষিদ্ধ ‘পুস্তকাকীয়’!

আহসান কবির
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২০:১৩আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২০:১৭

বইমেলা যে দেশেই হোক মানুষের আনন্দ বা বই কেনার অনুভূতি হয়তো একই। কিন্তু গত অর্ধশতাব্দী ধরে বইমেলা শুরু হলেই দুটো প্রশ্ন আলোচনায় আসে। প্রথম প্রশ্নটা হচ্ছে, বইমেলায় যত মানুষ আসে তার কয়ভাগ বই কেনে? কেউ কেউ অবশ্য মাতম করে বলেন, এই সংখ্যা একভাগেরও কম। আমরা প্রশ্ন বা উত্তরে না গিয়ে বরং একটা গল্প শুনি। গল্পটা পাশের দেশের।

বইমেলা চলছে। মেলার এক কোণে চাদর বিছিয়ে বাচ্চাকাচ্চা মিলিয়ে আট জনের একটা পরিবার টিফিন ক্যারিয়ার খুলে লুচি আর আলুর দম খাচ্ছে। ব্যাপারটা লেখক কাম সাংবাদিক দুলেন্দ্র ভৌমিকের চোখে পড়লো। তিনি পরিবারের বয়স্ক সদস্যের কাছে জানতে চাইলেন– তা দাদা কোথা থেকে এসেছেন? বয়স্ক সদস্য জানালেন দত্ত পাড়া থেকে। দুলেন্দ্র আবারও জানতে চাইলেন– তো দাদা মেলা থেকে আজ কী বই কিনলেন? বয়স্ক সদস্য খানিকটা অবাক হয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন– কেমন প্রশ্ন করলেন মশাই? আপনারা চিড়িয়াখানায় গেলে কি বানর, গাধা কিংবা হাতি কিনে আনেন?

ছোটকালে স্কুল স্পোর্টসে শেখানো হতো– পুরস্কার পাওয়া বড় কথা নয়, অংশগ্রহণই আসল। হয়তো তেমনি বইমেলাতে বই কেনা বড় কথা নয়, মেলায় ঘুরতে আসাই আসল। ফুচকা, চটপটি, কফি, লুচি বা আলুর দম (যদিও মেলায় পাওয়া যায় না) খেতে হলেও বইমেলা ঘুরে আসুন। বইমেলা ঘোরা শেষে নতুন বই হাতে দ্বিতীয় প্রশ্নটা নিয়ে ভাবুন। প্রশ্নটা হচ্ছে বই নিষিদ্ধ করা হয় কেন? প্রিয় পাঠক, এটা নিয়ে ভাবতে বলা হচ্ছে। দয়া করে উত্তর খুঁজতে যাবেন না।

নিষিদ্ধ জিনিসটা আমাদের এক ধরনের ঐতিহ্য। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও ‘নিষিদ্ধ’ ছিলেন। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল ‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক কবিতাটি। ‘যুগবাণী’ দিয়ে তার বইয়ের নিষিদ্ধ যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯২৪ সালে ‘বিষের বাঁশি’ আর ‘ভাঙার গান’ নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার। এরপর নিষিদ্ধ করা হয় ‘প্রলয় শিখা’ এবং ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামের বই দুটোকে। ব্রিটিশরা নজরুলকে দেখতে পারতো না। নিষিদ্ধ না করা হলেও ‘সঞ্চিতা’, ‘সর্বহারা’, ‘রুদ্রমঙ্গল’ আর ‘অগ্নিবীণা’র জন্য কবি নজরুল ব্রিটিশদের রোষানলে পড়েছিলেন। জেলও খেটেছেন নজরুল ইসলাম। ব্রিটিশরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল যে ক্ষমতার জোরে বই নিষিদ্ধ করা যায়, কিন্তু চেতনা নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয় না। কোনও দেশের কোনও ক্ষমতাসীন সরকারই নাকি এটা বুঝতে চায় না।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বই নিষিদ্ধ করার ঘটনা আছে। আবার ভিনদেশি লেখকের বই এ দেশে নিষিদ্ধ করার রেওয়াজও আছে। স্বাধীনতার পর একটা কবিতা লিখে দাউদ হায়দার বিপদে পড়েছিলেন। কবিতাটি ছাপা হয়েছিল দৈনিক সংবাদে। নিরাপত্তার জন্য প্রথমে তাকে নেওয়া হয়েছিল পুলিশ কাস্টডিতে, এরপর সরাসরি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিমানে। দাউদ হায়দারের আর দেশে ফেরা হয়নি।

এ দেশের মানুষ ‘নিষিদ্ধ’ বই সম্পর্কে ভালোমতো অনুভব করেছিল ১৯৮৮ সালে। এ বছর প্রকাশিত হয়েছিল সালমান রুশদীর ‘স্যাটানিক ভার্সেস’। ইরান, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ আরও কিছু মুসলিম দেশে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। অভিযোগ ওঠে সালমান রুশদীর এই বইতে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননা করা হয়েছে।

ইরানের প্রয়াত ইমাম খোমেনি রুশদীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন, তার মাথার দামও বেঁধে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে রুশদীর ওপরে আক্রমণ হলেও তিনি এখনও বেঁচে আছেন।

নিষিদ্ধ বিদেশি লেখক সালমান রুশদীর মতো বাংলাদেশি নিষিদ্ধ লেখক তসলিমা নাসরিনও তুমুল আলোচিত হন। ১৯৯৩ সালে তার ‘লজ্জা’ উপন্যাস নিষিদ্ধ হয় এবং তসলিমা নাসরিন নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন। তারও মাথার দাম ঘোষণা করা হয়েছিল। এখনও নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। পাকিস্তানের একনায়ক জেনারেল জিয়াউল হক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশের এক বিখ্যাত কবি লিখেছিলেন– গণতন্ত্রের জন্য মাঝে মাঝে এমন বিমান দুর্ঘটনার দরকার হয় অথবা একটা বিমান দুর্ঘটনা কখনও-সখনও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পারে। নিষিদ্ধ বইয়ের জন্য নির্বাসিত মানুষদের নিয়ে এমন কথা বলার কোনও অবকাশ নেই। যারা নির্বাসিত কিংবা বিবিধ কারণে বিদেশে থাকতে বাধ্য হন, বাংলাদেশটা সবসময় তাদের হৃদয়ে থাকে।

১৯৯৫ সালে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ বইটি এবং পাঁচ বছর পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। ‘পাক সার জামিন সাদ বাদ’ বইটিও তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়, অনেক জনপ্রিয় লেখকও হুমায়ুন আজাদের এই বইয়ের সমালোচনায় মুখর হন। ২০০৪-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে ফেরার পথে তার ওপর হামলা হয়। সে যাত্রায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও পরে মারা যান। মৌলবাদী জঙ্গিদের আক্রমণে ২০১৫-এর ফেব্রুয়ারিতে নিহত হন লেখক অভিজিৎ রায় ও একই বছরের অক্টোবরে হত্যা করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে। অভিজিৎ রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটাও আলোচিত হয়েছিল।

আমেরিকা, ইংল্যান্ড কিংবা রাশিয়াতেও এমন নিষিদ্ধের ঘটনা আছে। ‘এভরিবডি ইজ ইক্যুয়াল বাট সামবডি ইজ মোর ইক্যুয়াল খ্যাত উপন্যাস জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ নিষিদ্ধ ছিল রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায়। ডেভিড হার্বার্ড লরেন্স ‘লেডি চ্যাটার্লিজ’ লাভার লিখেছিলেন ১৯২৮ সালে, ১৯৩০-এ তিনি মারা যান। অশ্লীলতার দায়ে বহুদিন নিষিদ্ধ ছিল এই বই, যা এক মামলার কারণে রদ হয় ১৯৫৯-এর পর। এর আগে বরিস পাস্তারনাকের ‘ডক্টর জিভাগো’ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল রাশিয়ায়। ১৯৫৮ সালে আলেকজান্ডার ক্যাম্পবেলের সাইন্স ফিকশন ‘দ্য হার্ট অব দ্য ইন্ডিয়া’ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ভারতে। ‘বিবর’, ‘রাতভর বৃষ্টি’ কিংবা ‘প্রজাপতি’র মতো বইগুলোও ছিল আলোচনার তালিকায়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও যৌনতার দায়ে জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ নিষিদ্ধ ছিল আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে। টেড ডাও’র ‘ইন টু দ্য রিভার’ নিউজিল্যান্ডে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ২০১২-তে।

‘নিষিদ্ধ’ শব্দের ভেতরেই এক ধরনের আকর্ষণ আছে। যখন এ দেশের হলগুলোতে এক টিকিটে দুই ইংরেজি ছবি চলতো তখন হলে নিষিদ্ধ ছিল ছোটরা। কিন্তু কিশোররা নাকি সেসব ছবি বেশি দেখতো। যখন পত্রিকার স্টলগুলোতে পত্রিকা ও বই তুমুল বিক্রি হতো তখনও সেলফের নিচে বা চাদরের তলেও একধরনের বই পাওয়া যেতো, সাধারণভাবে যা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সেসব বইও পাওয়া যেতো টাকার বিনিময়ে। এখন নিষিদ্ধ বই অনলাইনে কেনাকাটা করা যায়। বলা হয়ে থাকে এখন পিডিএফ-এর যুগ। বই-পুস্তক নিষিদ্ধ করে কি শেষমেশ কোনও লাভ হয়? নাকি নিষিদ্ধ বইটার বিক্রি কয়েকগুণ বাড়ে?

আমরা বরং সিরিয়াসলি নিষিদ্ধ জিনিস নিয়ে না ভেবে দুই একটা ঘটনা শুনে বিদায় নিই। দয়া করে কেউ কিছু মনে নেবেন না। হয়তো সব গল্প সবার জন্য নয়।

এক. বারো বছরের রহিম বাদশা গেলো চব্বিশ বছর বয়সী রূপবানের কাছে। রূপবানকে একটা গোলাপ দিয়ে বললো– ভালোবাসি, আই লাভ ইউ রূপবান। রূপবান আলতো করে রহিম বাদশাকে চড় মারার পর বললো– তুমি এখনও শিশু! ভালোবাসা তোমার জন্য নিষিদ্ধ।

দুই. রহিম বাদশা বড় হচ্ছে। খেলাধুলা খুব পছন্দ করে। বিকেল হলে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলে। গেমস টিচার খেলার ফাঁকে বই পড়েন। কোনোদিন পড়েন আরজ আলী মাতুব্বরের বই, কোনোদিন পড়েন জেমস জয়েস। একদিন পড়ছিলেন লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার। রহিম বাদশা এসে বললো– স্যার এই বইটা আমারে একটু পড়তে দেবেন?

স্যার বই বন্ধ করে বললেন– আচ্ছা রহিম, তুমি বা তোমরা যখন ফুটবল খেলো তখন কি আমি খেলা থামানোর নির্দেশ দিয়ে বলি– তোমাদের বলটা আমাকে একটু খেলতে দেবে?

খেলা, পড়া কিংবা দেখাই আসল। প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকলে আপনার কাজ আপনি করবেনই। কোনও কিছুতেই দমানো যাবে না।

‘নিষিদ্ধ’ করা তাই এ কালের এক ‘ফাচুকি’ পদ্ধতি। জানালাটা খোলা থাক সবসময়। মুক্ত কিছু বাতাস থাকুক সবার জন্য।

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভ্যাটেই মিলবে রাজস্ব, অথচ ভ্যাট বাড়াতে অনীহা
ভ্যাটেই মিলবে রাজস্ব, অথচ ভ্যাট বাড়াতে অনীহা
বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে
গ্লোবাল স্কিলস ফোরামে বক্তারাবাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
তীব্র গরমে পানি চাইতে চাইতেই ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু
তীব্র গরমে পানি চাইতে চাইতেই ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ