X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

সম্বোধনের রাজনীতি

জোবাইদা নাসরীন
২৭ মার্চ ২০২৩, ২০:১২আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৩, ২০:১২

জেলা প্রশাসককে ‘স্যার’ ডাকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশ কয়েক দিন ধরেই সরব। বেশিরভাগেরই এই প্রজাতন্ত্রের সেবকদের ‘স্যার’ সম্বোধনের বিপক্ষে। যুক্তি আসছে নানা ধরনের। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, কর্মকর্তাদের জনগণকেই ‘স্যার’ ডাকার কথা। কারণ, তারা জনগণের সেবক। কেউ কেউ বলছেন– ‘স্যার’ এটি ব্রিটিশ ‘উপাধি’। কারও যুক্তি এগুলো ঔপনিবেশিক সম্বোধন, এগুলো থেকে আমাদের বের হতে হবে। আবার অনেকেই বলছেন, শিক্ষকদের ছাড়া কাউকেই ‘স্যার’ বলা যায় না। এতেও উদাহরণ হাজির করছেন অনেকেই। অথচ দেশের বাইরে তো শিক্ষকদের ‘স্যার’ ডাকা হয় না। তাহলে এখানে কেন হবে? কেউ কেউ আবার কষ্ট করে ঘাঁটছেন দলিল-দস্তাবেজ, খুঁজে দেখার চেষ্টা করছেন সেখানে প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের ‘স্যার’ বলার জন্য কোনও বিধিবিধান আছে কিনা?

যে ঘটনা নিয়ে এত আলাপ, বাহাস, সেই ঘটনাটি ঘটেছে বাংলাদেশের উত্তরের জেলা রংপুরে। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, সেখানকার ডিসি তাকে ‘স্যার’ বলার জন্য বাধ্য করেছেন। তিনি ও তার মেয়ে সেটির প্রতিবাদ করেছেন। সেই প্রতিবাদের চিত্রও ফেসবুকের বরাতে আমাদের অনেকেরই নজরে এসেছে। এর আগেও এই ধরনের বিষয় নিয়ে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম হয়েছিল। তবে এবারের বিষয়টি একটু ভিন্ন ধরনের। কারণ, সেই ডিসি একজন নারী। তিনিই আপত্তি তুলেছেন তাকে ‘আপা’ বলে সম্বোধন করায়। ডিসির বক্তব্য অনুযায়ী তিনি লিঙ্গীয় বিষয়টির ওপরই গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কারণ, তিনি  হয়তো মনে করেছেন নারী বলেই তাকে যোগ্য সম্মান দেওয়া হচ্ছে না।

এখানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ হিসাব-নিকাশ আছে। এখানে ক্ষমতা চর্চা যেমন আছে, তেমনি আছে এক ধরনের দোনামোনার ছাপ। কে কাকে স্যার/ ম্যাডাম বলবে সেটারও একটি রাজনীতি রয়েছে। আমার মনে পড়ে প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময়ও আমরা নারী শিক্ষকদের ‘আপা’ এবং ‘দিদি’ ডাকতাম, কিন্তু পুরুষ শিক্ষকদের তো স্যার বলতাম। হাইস্কুল পর্যন্ত এমন চল ছিল। কলেজে ঢাকায় পড়তে এসে নারী শিক্ষকরা ম্যাডাম আর পুরুষ শিক্ষকরা স্যার হয়ে গেলেন। বিশ্ববিদ্যালয়েও নারী শিক্ষকদের ম্যাডাম এবং পুরুষ শিক্ষকদের স্যার ডেকেছি। তবে এখন অনেক শিক্ষার্থী পুরুষ শিক্ষকদের স্যার, নারী শিক্ষককে ‘ম্যাম’ এবং ‘মিস’ সম্বোধন করেন। এই পরিবর্তনের কারণও জানা নেই। হতে পারে ইংরেজি মাধ্যমের প্রভাব নারী শিক্ষকদের সম্বোধন করা হয়। তবে অনেক শিক্ষার্থী অনেক সময় নারী শিক্ষকদের আপা ডাকেন, যদিও পুরুষ শিক্ষকদের বেলায় স্যারই ডাকেন।

তবে ইংল্যান্ডে দেখেছি অপরিচিত কাউকে ‘স্যার’/‘ম্যাম’  বলছেন, কিন্তু পরিচিত হলেই নাম ধরে ডাকেন। সেখানে শিক্ষক কিংবা ঊর্ধ্বতন, অধস্তনতার কোনও সম্পর্ক নেই। তবে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে স্যার ডাকারই চল। ওনারা বলেন এটি লিঙ্গনিরপেক্ষ সম্বোধন। তবে সেখানে ওনারা একে-অপরকে একবার স্যার ডেকেই ক্ষান্ত হন না। স্যার, স্যার, জি স্যার, স্যার, স্যার বলে মুখে ফেনা তুলে আনুগত্য প্রকাশ করেন। অনেকেই এই স্যার স্যার বলার সময় চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে কথা বলেন ( যদিও টেলিফোনে অপরজন তাকে দেখার সুযোগ নেই)। শুধু স্যার বলেই ক্ষান্ত নয়, এ দেশে এই ‘স্যার’ ব্যাপক সামাজিক অনুবাদ আছে। স্যার যতই বয়স কম হোক না কেন, বয়স্ক অধস্তন কর্মকর্তা তার সামনে বসতে পারেন না, তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, কিংবা তাকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়াতে হয়।

এটি এককভাবে প্রকাশ্য আনুগত্য এবং তোষামোদের চর্চা। এমনকি আমাদের ব্যাচের দুই জন দুই বছর বিসিএসে যোগদান করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সঙ্গে পড়লেও এখন একজন আরেকজনের স্যার। এবং পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেদের ব্যাচের একটি অনুষ্ঠানেও দেখলাম সেটির প্রভাব।

তবে পুরুষদের স্যার বলার রেওয়াজ আমাদের যতটা আছে, নারীকে স্যার বা ম্যাডাম বলার রেওয়াজ নেই। ভাববেন না আমি সেগুলো চর্চার জন্য ওকালতি করছি। বরং নারীদের ‘ভাবি’ বা ‘আপা’ বলার চলই বেশি। কারণ, ধরেই নেওয়া হয় নারীরা ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলার মতো কাজ করেন না। তবে স্যারের স্ত্রীদের ম্যাডাম বলার চল এ দেশে জারি রয়েছে।

তবে এই সম্বোধনও কিন্তু রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়। আবার কেউ কেউ এটির সঙ্গে রাজনীতি আভাস দেখেন। একদিন একজন নারী শিক্ষক জানালেন, ‘আমাকে আপা বলবে, ম্যাডাম ডাক শুনলেই একজন রাজনীতিবিদের কথা মনে হয়, যাকে সবাই ম্যাডাম বলে ডাকেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সবাই ‘আপা’ ডাকেন। তাই আমাকেও আপা ডাকবে। আমিও সবারই আপা হতে চাই।’ তবে লক্ষ করুন, আওয়ামী লীগ সমর্থন করলেও এবং জনগণের সেবক হলেও এই আমলারা কেউ শেখ মুজিবের মতো ‘মুজিব ভাই’ হতে চান না। তারা ভাই বা আপা শুনতে পছন্দ করেন না। তখন তারা যে ক্ষমতায় বড় সেটি বজায় রাখতেই সচেষ্ট থাকেন। আবার অনেকের কাছেই আপা ডাকা আপত্তিকর, আপা ডাকার মধ্যে তার চাকরির পদবির ‘ভার’ হয়তো ঠিকমতো বোঝা যায় না। অর্থাৎ তার ক্ষমতা ঠিকভাবে ঠাহর করা যায় না। তাই তার মনে হতে পারে ‘আপা’ ডাকটি কাছের হওয়ার মতো যুক্তি তার ক্ষমতাকে একভাবে দূরে রাখে এবং অন্যদিকে একই পদের পুরুষ সহকর্মীর ক্ষমতার সামাজিক ভিত্তিকেই সামনে আনে ‘স্যার’ সম্বোধন।  

এটিকে কি আমরা লিঙ্গীয় জায়গা থেকে ‘ব্যাটাগিরি’ হিসেবে দেখবো? নাকি স্যার কিংবা ম্যাডাম না বললে তার পদকে ছোট করা হয়েছে সেটি হিসেবে দেখবো? কিংবা নারীকে ‘আপা’ বলা যায় সেভাবে দেখবো? নাকি এটি পেশাগত ক্ষমতার জায়গা থেকে দেখবো? সমস্যাটা ক্ষমতা চর্চার রাজনীতির। তাই কে কাকে কীভাবে সম্বোধন করবে সেটি আসলেই রাজনৈতিক মানদণ্ড নির্ধারিত হয়। আর এই রাজনীতি একেবারে এই ক্ষমতা চর্চার রাজনীতি।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দলবল নিয়ে উঠান বৈঠকে ফাঁকা গুলি ছোড়ার অভিযোগ বদির বিরুদ্ধে
দলবল নিয়ে উঠান বৈঠকে ফাঁকা গুলি ছোড়ার অভিযোগ বদির বিরুদ্ধে
লাইনে দাঁড়িয়ে ১০ টাকার টিকিট কেটে চোখ পরীক্ষা করালেন প্রধানমন্ত্রী
লাইনে দাঁড়িয়ে ১০ টাকার টিকিট কেটে চোখ পরীক্ষা করালেন প্রধানমন্ত্রী
স্বজনদের প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন ওবায়দুল কাদের
স্বজনদের প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন ওবায়দুল কাদের
দুর্নীতির দায়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটারকে ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা
দুর্নীতির দায়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটারকে ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ