X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

‘বিবৃতিজীবী’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

আনিসুর রহমান
১০ এপ্রিল ২০২৩, ২১:০৩আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২৩, ১৮:৫২

একটি কথার পুনরাবৃত্তি করে বলে নিতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মেধাবীদের বিচরণক্ষেত্র। তবে প্রতিভাবানদের জন্যে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। মেধাবীরা রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে শুরু করে গোটা পৃথিবীটাই চালায়। আর প্রতিভাবানরা রাষ্ট্র সমাজ এবং এই পৃথিবীটাকেই পাল্টে দেওয়ার হিম্মত রাখেন। জগতে বিশ্ববিদ্যালয় ধারণা উদ্ভবের আগেও মেধাবী এবং প্রতিভাবানদের পদচারণা ছিল।

প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস আমাদের নালন্দা বিহারকে বিবেচনায় নিলে দুই হাজার বছরের কম। আর ইতালির বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বিবেচনায় নিলে এক হাজার বছরের মতো। তাই জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রথম এবং শেষ কথা না হলেও আধুনিক কার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থায় জ্ঞানচর্চার অপরিহার্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের সুযোগ অবারিত করা হয়।

এই তর্ক-বিতর্কের বেলাভূমিতে ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায় প্রতিভাবানরা ঢোকার সুযোগই পান না, অনেক সময় সেই সুযোগ নেন না, আবার নিলেও ছিটকে পড়েন। এরকম উদাহরণ আমাদের দেশে যেমন আছে, তেমন দুনিয়ার সব সমাজ এবং রাষ্ট্রে রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কথায় ফিরে আসি। বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুযায়ী জ্ঞান অর্জন, স্নাতক তৈরির এক একটা কারখানা বটে। তাই বলে এখানে কর্মরত মূল নিয়ামক শক্তি শিক্ষক নেতারা বা শিক্ষকদের সংগঠন ট্রেড ইউনিয়নের মেজাজে পরিচালিত হবে না। সারা দুনিয়ার সভ্য কার্যকর গণতান্ত্রিক সমাজে চলমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের এরকম ভূমিকায় দেখা যায় না।

হ্যাঁ, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মানবতার মোক্ষম প্রয়োজনে ব্যতিক্রম কিছু সময় আসে। সেরকম সময় যেমন আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সামনে এসেছিলেন স্বাধিকার আন্দোলনে। এমনকি ১৯৭৫-এর পরে অগণতান্ত্রিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়েও ছিলেন সোচ্চার। আর এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আসল কাজ ফেলে মুখিয়ে থাকবেন কখন কোন চত্বরে বা শহীদ মিনারে একটা বক্তৃতা দেবার সুযোগ পাবেন কিংবা দূরদর্শনের সামনে নিজের মুখচ্ছবি কিংবা কোনও অজুহাতে নিদেনপক্ষে নিজের নামটি খবরে জায়গা করে নেবেন– এটি কাম্য হতে পারে না। এরকম একটি অজুহাত হচ্ছে আমাদের দেশে হাল আমলে ঝেঁকে বসা বিবৃতি প্রবণতা কিংবা বিবৃতিজীবীগোষ্ঠীর খপ্পর।

এহেন একটি ঘটনা অতি সম্প্রতি ঘটেছে প্রথম আলোর একটি বিতর্কিত প্রতিবেদন এবং এই প্রতিবেদন ঘিরে পত্রিকাটির প্রতিবেদক এবং সম্পাদকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়েরকে কেন্দ্র করে। এই পর্যায়ে আমি বলে নিতে চাই, সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে ওই প্রতিবেদন ঘিরে ‘প্রথম আলো’র পূর্বাপর ভূমিকাকে সমর্থন করার সুযোগ নেই। একই সঙ্গে এর দোহাই দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকেও সমর্থন দেবার সঙ্গত কারণ নেই। গণমাধ্যমের গণতান্ত্রিক এবং পেশাদারত্বের বিকাশের জন্যে প্রেস কাউন্সিলকে তার নিজস্ব ভূমিকা পালনের সুযোগ দিতে হবে। সব যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়েই করে ফেলা যায় তাহলে প্রেস কাউন্সিল রাখার দরকারটা কী?

এখানে বলে নিই, প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের ২০০৭-২০০৮-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের পূর্বাপর আপত্তিকর অপেশাদার ভূমিকাকে অজুহাত হিসেবে নিয়ে অন্য ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে অতি উৎসাহীদের তড়িঘড়ি পদক্ষেপে দেশবিরোধীদের পালে হাওয়া জুড়ে দেয়, তাতে সরকারের কী লাভ হয়, আমি বুঝে পাই না।

হ্যাঁ, কোনও পত্রিকা গোষ্ঠীর সাংবাদিক বা সম্পাদকের অদৃশ্য কোনও অসৎ এবং অপেশাদার রাজনৈতিক অবস্থান এবং ভূমিকা যদি থেকে থাকে অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আনাই সঙ্গত। তবে তাও হতে হবে স্বচ্ছ জবাবদিহি এবং আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।

সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকার কথা না।  এই পর্যায়ে ‘আমার দেশ’র সম্পাদককে ঘিরে ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। আমার দেশ পত্রিকাটি ২০১৩ সালে অনেক কাল্পনিক প্রতিবেদন ছেপেছিল। এরকম ঘটনা ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেও। যখন বাসন্তীকে জাল পরিয়ে ভুয়া প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। তাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে সব সংস্থা যেমন, ঠিক গণমাধ্যম এবং এদের মোড়লরাও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না।

এবার বিবৃতিজীবী প্রসঙ্গে ফিরে আসি।  প্রথম আলো পত্রিকার আপত্তিকর প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে এর পক্ষে এবং বিপক্ষে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্ন ভিন্ন দল ও গোত্রের শিক্ষকদের বিবৃতি দেখে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, ওনাদের কি কোনও কাজ নেই?  ওনারা কি বিবৃতি দেওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকেন? এই বিবৃতিজীবীদের একটি দল সরকার সমর্থক, আরেক দল সরকারবিরোধী। হিসাবটাও খুব সোজা। প্রথম আলো নিয়ে যখন নানান ঘটনা চলছে তখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব ত্বরিতগতিতে প্রথম আলো’র পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করে মুখ খুলেছেন। বেশ! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মেরুকরণ রূপরেখা পরিষ্কার হয়ে গেলো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জ্ঞানচর্চার কারখানার সমজদার হয়ে এত সহজ মেরুকরণের জন্য ওত পেতে থাকলে জাতি হিসেবে আমাদের কপালে খারাপি আছে।

তবে হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অবশ্যই অবস্থান নিতে পারেন এই ঘটনা বা উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে। যেমন, সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও গবেষকগণ ইতোপূর্বে পরিচালিত প্রাসঙ্গিক গবেষণা কর্ম থেকে তুলনামূলক তথ্য-উপাত্ত এবং বিশ্লেষণ হাজির করতে পারতেন যার যার অবস্থান থেকে। সেখানে বিপরীতধর্মী উপাত্ত এবং বিশ্লেষণ নিয়ে গণমাধ্যম এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিমণ্ডলে সেমিনার কিংবা তর্ক বিতর্কের আয়োজন করতে পারতেন। একইভাবে আইন এবং অপরাধ বিজ্ঞানের শিক্ষক এবং গবেষকরাও অনুরূপ উদ্যোগ নিতে পারতেন এবং পারেন। কিন্তু ওনারা তা না করে অতি দ্রুত বিবৃতির দিকে ঝুঁকে পড়েন কেন?

এ যেন ‘বিবৃতিজীবী’র কাল আমাদের সামনে। এ প্রবণতায় যে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা না, একদল সুশীল, এনজিও ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, সংস্কৃতির মোড়ল এবং বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতিনির্ভর সমাজের পরজীবী গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। রুচির দুর্ভিক্ষ যদি থেকে থাকে, তাহলে আমাদের এসব জাতির বিশিষ্টদের বিবৃতিপ্রবণতার মধ্যেও আছে কিনা এটাও একটা প্রশ্ন বটে।

লেখক: বাঙালি-সুইডিশ কবি ও নাট্যকার, সুইডিশ লেখক সংঘের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
বঙ্গবন্ধু শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন: এমপি কাজী নাবিল
বঙ্গবন্ধু শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন: এমপি কাজী নাবিল
ত্যাগের মহিমায় স্বামী বিবেকানন্দ মানবসেবা করে গেছেন: মেয়র তাপস
ত্যাগের মহিমায় স্বামী বিবেকানন্দ মানবসেবা করে গেছেন: মেয়র তাপস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ