X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নববর্ষের হাসিতে আলো ফুটুক

রেজানুর রহমান
১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১০:২৭আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১০:২৮

আকাশ পথে সৈয়দপুর থেকে ঢাকায় আসছি। উড়ো জাহাজের একটি সিটও খালি নেই। আগে ভাবা হতো উড়োজাহাজ সবার জন্য নয়। এখন সে ধারণা পাল্টে গেছে। আমার সামনে, পেছনে, ডানে বাঁয়ে নানা কিসিমের যাত্রী। আমার ঠিক সামনের সিটে বাবার সঙ্গে পাশাপাশি সিটে বসেছে একটি শিশু। ঠিক পেছনে মায়ের সাথে আরেকজন শিশু বসে আছে। আমার পাশের সিটে কালো বোরখা পরা একজন নারীর কোলে ৮/৯ মাসের একটি মেয়ে শিশু। তার পাশের সিটে একজন কিশোরীর কোলে তার ছোট্ট ভাই। অর্থাৎ বুঝা গেলো তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তিনি ঢাকায় ফিরছেন। তার ঠিক পেছনের সিটে এক দম্পতি বসেছেন। তাদের সঙ্গেও একজন কিশোর আছে। এই দম্পতিকে দেখে মনে হচ্ছে গ্রামের অতি সাধারণ মানুষ। হয়তো প্রথমবারের মতো উড়োজাহাজে চড়েছেন। ভয়-সংকোচ, নিজেকে, নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা তাদের।

লক্ষ্য করলাম, সামনে, পেছনে, ডানে বায়ে যাত্রীদের মধ্যে সংস্কৃতিগত ভাবনা ও আচরণ গত পার্থক্য সীমাহীন। আমার পেছনের সিটের মা তার ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলছেন। ছোট্ট মেয়েটিও ইংরেজিতে বেশ সাবলীল। ধারণাই করা যায় ছোট্ট মেয়েটি ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। তাদের বামের সিটে গ্রামের অতি সাধারণ যে পরিবারটি বসেছেন তাদের ১০/১২ বছরের ছেলেটি অবাক হয়ে মাঝে মাঝেই আড় চোখে ইংরেজি বলা মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে। অবাক বিস্ময় তার চোখে-মুখে। ওই পরিবারের সামনে অর্থাৎ আমার বামে বোরখা পরা মায়ের ছেলে-মেয়েরা সবাই পোশাকের পর্দায়। দেখেই বোঝা যায় তাদের সাংস্কৃতিক ভাবনায় পর্দার আড়াল আছে। ওই মহিলার ডান পাশে অর্থাৎ আমার ঠিক সামনে বাবার সঙ্গে যে ছেলেটি বসেছে তাদের আচার-আচরণে বাঙালিয়ানা স্পষ্ট। ছেলেটি বাবাকে নানা কথা জিজ্ঞেস করছে।

বাবা, আমরা এবার পহেলা বৈশাখে মিছিল দেখতে যাবো না।

ছেলেটি বর্ষবরণের মিছিলের কথা বলছে। বাবা বললেন, এবার মিছিল হবে কিনা জানি না। এবার তো রোজার মাস।

ছেলেটির অবাক জিজ্ঞাসা– রোজার মাস তো কি হয়েছে? একই সময়ে পাশের বোরখা পরা মহিলাটি তার মেয়েকে ধমক দিয়ে বলছেন, আদব লেহাজের সাথে বসে থাক। বোরখা টানো...

আমার পেছনে বসা ছোট্ট মেয়েটি তার মায়ের সঙ্গে নববর্ষ নিয়ে ইংরেজিতেই কথা বলছে। তাদের বামের সিটে বসা গ্রামের সাধারণ পরিবারটির চোখে-মুখে এখনও ভয়, শঙ্কা ও আড়ষ্টতা লক্ষ্য করলাম। বিশেষ করে তাদের ছেলেটি যেন একটু বিব্রত। পরিবেশের সঙ্গে মোটেই খাপ খাওয়াতে পারছে না।

প্রিয় পাঠক, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন আজ। শুভ দিন। আনন্দের এই দিনে এই লেখাটির শুরুটা নিয়ে আমি যেন একটু দ্বিধাগ্রস্ত। লিখব বাংলা নববর্ষ নিয়ে। সেখানে আকাশ পাতালের বর্ণনা কেন? উড়োজাহাজই বা এলো কেন? উত্তরটা সহজ। আকাশে উড়োজাহাজে পাশাপাশি বসা এই মানুষগুলোর আচার-আচরণ, প্রকাশ ভঙ্গি দেখেই আমি দ্বিধাগ্রস্থ। বাংলা নববর্ষ, বাঙালিয়ানা, সেই ঐতিহ্যকে আদৌ কি আমরা গুরুত্ব দেই বা দিচ্ছি? নাকি আমরা আনুষ্ঠানিক হয়ে যাচ্ছি? পহেলা বৈশাখে বাঙালি হতে হবে? ফেব্রুয়ারিতে ভাষার মাসে বাংলা ভাষার প্রতি আন্তরিকতা দেখাতে হবে। ডিসেম্বর আর মার্চ মাসে অতিমাত্রায় দেশপ্রেমিক হতে হবে। বছরের বাকি সময়ে ভুলে যাবো সব কিছু? ভুলে যাবো বাঙালিয়ানা, ভুলে যাবো প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা। ভুলে যাবো বাংলাদেশের গান-জারি সারি, ভাটিয়ালি... ভুলে যাবো বাংলা খাবারের ঐতিহ্য। ভুলে যাবো আত্মীয়তা, পারিবারিক বন্ধনের কথা?

উড়োজাহাজে বসে যে পরিবারগুলোকে দেখলাম মূলত তারাই আমাদের আশপাশের মানুষ। এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ভাবুন তো একবার। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষার মাধ্যমে বিস্তর ব্যবধান। ইংরেজি আর বাংলা মিডিয়ামের পড়াশুনায় বিস্তর ফারাক। বাংলা মিডিয়ামের ছেলে মেয়েরা ইংরেজি মিডিয়ামের ছেলে মেয়েদের দেখলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মাদ্রাসার ছেলে মেয়েদের দেখে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের ছেলে মেয়েরা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। মাদ্রাসার ছেলে মেয়েরাও সন্দেহের চোখে তাকায়। সবার সাংস্কৃতিক ভাবনাও এক নয়। মাদ্রাসায় পহেলা বৈশাখ পালনকে ভালো চোখে দেখা হয় না। বাংলা মাধ্যমের ছেলে মেয়েরা পহেলা বৈশাখ পালন করে অনেক আন্তরিকাতার সাথে। আর ইংরেজি মাধ্যমের ছেলে মেয়েরা (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) পহেলা বৈশাখ ইংরেজি স্টাইলে পালনের অভিনয় করে। এটাই বাস্তবতা। সেকারণে আমি একটু শঙ্কিত। রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানিকতায় অনেক কাটছাট করা হয়েছে। সময় বিবেচনায় এটা সমর্থন যোগ্য। কিন্তু আমরা কি সত্যিকার অর্থে নিজেদের সাংস্কৃতিক এতিহ্য রক্ষায় আন্তরিক?

এবার যেন নীরবে নিভৃতে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস চলে গেলো। এক সময় দেখতাম ১৬ ডিসেম্বর ২৬ মার্চে দেশের ঘরে ঘরে জাতীয় পতাকা উড়তো। এবার সেভাবে উড়েনি। প্রসঙ্গ তুলতেই আমার এক বন্ধু বললেন, পবিত্র রমজান মাস বলেই হয়তো সেভাবে উচ্ছ্বাস-আবেগ প্রকাশ পায়নি? বন্ধুর সঙ্গে একমত হতে পারিনি। অতীতে দেখেছি রমজান মাসে বিশ্বকাপ ফুটবল উৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ভিন্ন দেশের পতাকা উড়েছে। তখন তো পবিত্র রমজান মাস বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আসলে সব কিছু নির্ভর করে আবেগ আর আন্তরিকতার ওপর। আমি তোমাকে ভালেবাাসি এটা শুধু অন্তরে থাকলে কাজের কাজ হবে না। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হয়। ভালোবাসার মানুষকে কথাটা বলতে হয়। তেমনই দেশকে অনেক ভালোবাসি একথা বুকে চেপে রাখলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ জরুরি। ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ দেশের এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে মাতৃভূমির প্রতি ভক্তি পালনের পারিবারিক উদ্যোগ থাকলে ছেলে মেয়েরাও দেশের প্রতি ভক্তি ছড়াবে। সেই উদ্যোগ কি আদৌ আছে?

পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ পালন নিয়ে আমাদের ধর্মীয় গুরুদের মধ্যে কিছুটা মতভেদ আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক বক্তা পহেলা বৈশাখ পালনকে গুনাহ’র পর্যায়ে দাঁড় করান। তাদের প্রতি আমরা বিনীত প্রশ্ন– বাঙালির একটি নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। গান-বাজনা, বিজয় শোভাযাত্রা, জারি-সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী গান, নাচ আমাদের সংস্কৃতির উজ্জ্বল অধ্যায়। হাজার বছরের এই সংস্কৃতি আমরা ভুলে যাবো? আদৌ কি সেটা সম্ভব? যুগের প্রয়োজনে সংস্কৃতিও বদলায়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দোর্দন্ড প্রতাপের এই সময়ে আমাদের সংস্কৃতির নানা উপকরণ বেশ হুমকির সম্মুখীন। নাচ, গান, হুমকির সম্মুখীন। নাটক, সিনেমা হুমকির সম্মুখীন। খাবারের সংস্কৃতিও হুমকির মুখে। এধরনের পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে বদলাতে হয়। নিজেকে নিজেদেরকে আধুনিক করে গড়ে তুলতে হয়। সেই চেষ্টা আমরা কে কতটুকু করছি সেটাই প্রশ্ন।

তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি গোটা বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তাই বলে গড্ডালিকা প্রবাহে আমরা গা ভাসিয়ে দিব এটাও ঠিক নয়। আমাদেরও বদল প্রয়োজন। শিক্ষা, সাহিত্য সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, আচার-আচরণ, সবক্ষেত্রেই বদলটা জরুরি। সেটা অবশ্যই নিজস্ব সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়েই হতে হবে।

বাংলা নতুন বছরে নতুন উদ্দীপনায় শুরু হোক সবার কর্ম পরিকল্পনা। এবার ঈদের আনন্দে বাংলা নববর্ষ পালিত হচ্ছে। একদিকে নববর্ষ অন্যদিকে পবিত্র ঈদ। একসাথে ডাবল আনন্দ। আসুন সকলে সমবেত হই। প্রথমে পরিবার তারপর রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনায় যার যার অবস্থান থেকে যথাসাধ্য কিছু করার চেষ্টা করি। ঈদে যেন দুঃস্থ, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াই। অসহায়ের মুখে হাসি ফুটুক। আলো, আনন্দে ভরে যাক গোটা দেশ, গোটা পৃথিবী। শুভ নববর্ষ ১৪৩০। সবার জন্য অনেক শুভ কামনা। 

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।  

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ম্যানসিটিকে আরও পেছনে ফেললো আর্সেনাল
ম্যানসিটিকে আরও পেছনে ফেললো আর্সেনাল
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
‘গরমে’ শ্রেণিকক্ষে অজ্ঞান দুই শিক্ষার্থী
‘গরমে’ শ্রেণিকক্ষে অজ্ঞান দুই শিক্ষার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ