X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

মনেও আগুন জ্বলছে

প্রণব মজুমদার
১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:৪৭আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:৪৭

আগুন লেগেছে। সে আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে! সম্পদ এবং মনে। সম্পদের আগুন নেভানোর দমকল বাহিনীর সদস্যরা আছেন। কিন্তু মনের আগুন নেভাবে কে? সামনে ঈদ। সবার মধ্যে যখন উৎসবের আমেজ তখন লাগলো আগুন বঙ্গবাজারে। বাণিজ্যে আগুন, সম্পদে আগুন এবং সে আগুনের তাপ হৃদয়েও।

ঠিক মাত্র ১০ দিন পর আবারও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এবার রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেটে। একই ঘটনা বারবার ঘটলে তাকে কি দুর্ঘটনা বলা যায়? অনেকেই নিউমার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে রহস্যময় বলছেন। তাদের প্রশ্ন, অগ্নিকাণ্ড কি দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা?

ভোরে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড নাশকতা কিনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, বড় বড় মার্কেটে আগুন লাগা সন্দেহজনক। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ দেশ। শান্তিপূর্ণ দেশে একের পর এক বড় বড় মার্কেটে আগুন লাগছে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এটা আসলেই সন্দেহের বিষয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন– রহস্যজনক। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা আগুনে নাশকতার তদন্ত শুরু করেছেন। পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডে নাশকতার প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অল্প সময়ের ব্যবধানে পর পর বেশ ক’টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কেন এমন ঘটনা বারবার ঘটছে? ৪ এপ্রিল আগুন লেগেছে রাজধানীর বঙ্গবাজারে, ১১ এপ্রিল চকবাজারে, ১৩ এপ্রিল নবাবপুরে এবং ১৫ এপ্রিল নিউ মার্কেটে। বিস্ময়! ১৫ দিনে মহানগরের ৪টি বড় অগ্নিকাণ্ড নাশকতা না দুর্ঘটনা? নাশকতা বা দুর্ঘটনা যাই হোক ক্ষতি কিন্তু সব জনগণের ও দেশের। দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলালউদ্দিন বলেছেন, বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। নিউ সুপার মার্কেটে ১২শ’ দোকানের মধ্যে ২৫০টি দোকান পুড়ে গেছে।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এ মার্কেটে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ একশ’ কোটি টাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্ত কমিটির হিসাবে বঙ্গবাজারের আগুনে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৮৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হয়তো এ মার্কেটের ক্ষেত্রেও তদন্ত কমিটি গঠন করে ক্ষতির হিসাব প্রকাশ করবে।

আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে রাজধানীর বঙ্গবাজার ও সুপার নিউ মার্কেটের প্রায় ৫২৫০টি দোকান। যে দুর্ঘটনা একই সমান্তরাল রেখায় বারবার ঘটতে থাকে, তাকে আর দুর্ঘটনা বলা যায় না। সেটা ঘটে কারও প্ররোচনায় অথবা অবহেলায় কিংবা প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিগত কারণে। সব সক্ষমতা থাকার পরও কোথাও না কোথাও একটা ঘাটতি নিশ্চয় রয়েছে। সেই ঘাটতির ফুটো দিয়ে আগুন লাগছে বারবার।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নেভাতে রীতিমত ক্লান্ত! ঈদুল ফিতরের আগে জামাকাপড় পুড়ে যাওয়ায় যেভাবে ব্যবসায়ীরা বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন, তার প্রভাব শুধু ঈদকেন্দ্রিক পোশাক ব্যবসায়েই নয়, গোটা অর্থনীতিতেই পড়বে।

আগুন নিজে নিজে নেভে না, সে কি আপনা-আপনি জ্বলতে পারে এসব বচন ও প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবার জানা। এরপরও আমরা আগুনের কাছে এত অসহায় কেন? অনেকে বলছেন, বঙ্গবাজারের আগুন অবশ্যম্ভাবী ছিল। ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ব্যবসা করে গেছেন। শুধু মুনাফার দিকেই ছিল তাদের গভীর মনোযোগ, অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা তারা নেননি। বারবার সতর্ক করার পরও বঙ্গবাজার কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক কমিটির নির্দেশনা মানেনি।

দিনে দিনে আগুন লাগার ঊর্ধ্বমুখী ঝুঁকির সঙ্গে তাল রেখে বাড়েনি আগুন প্রতিরোধের সক্ষমতা। আমাদের অজান্তে আগুন লাগানোর দায়িত্ব আমরা নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে আগুন নেভানোর দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছি ফায়ার সার্ভিস নামের প্রতিষ্ঠানকে। ফায়ার সার্ভিসের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা প্রাণ হারাচ্ছেন, পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছেন, আহত হয়ে কাতরাচ্ছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। এরপরও মানুষ তাদেরই দুষছে। আক্রান্ত হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস অফিস, আগুন নেভানোর গাড়ি। অগ্নিকাণ্ডে প্রতিবারই ধ্বংস হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।

প্রতিবারই আগুনের কারণ নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। কিন্তু উন্মোচিত হয়নি রহস্য। বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটসহ সব অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত কাজ কিছু বিষয় মাথায় রেখে পরিচালিত হওয়া উচিত। যেমন, বহুতল ভবন নির্মাণে কারা লাভবান হবেন, জায়গাটির বরাদ্দ পেতে কারা দীর্ঘদিন ধরে তৎপর- এসব খতিয়ে দেখা দরকার।

সম্পদে আগুন লাগে বা লাগানো হয় সেটা নাশকতা বা দুর্ঘটনা যাই হোক, সব জনগণের ক্ষতি তা আবারও বলছি। যার সম্পদ ও সম্বল পুড়ে ছাই হয়ে গেলো তার আহাজারি, গগনবিদারী আর্তনাদ কে শোনে? কে করবে তার ক্ষতিপূরণ। সরকার তো জনগণের কর নিয়ে পরিচালিত হয়। তাহলে ক্ষতি তো আমজনতারই! শুধু সরকারের মুখাপেক্ষী থাকলেই সমস্যার সমাধান হয় না। এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পূর্ব পরিকল্পনা ও বোঝাপড়া।

সমস্যাসংকুল আমাদের দেশে ঘাটতি বিচিত্র কিছু নয়। জনবলের একটা বড় ঘাটতি পূরণ করা যায় সমাজভিত্তিক আগুন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলে। সমাজভিত্তিক আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দেশকে অগ্নিদুর্ঘটনা সচেতন সমাজ গড়তেও সাহায্য করবে।

বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডের পর আমরা দেখেছি সত্যিকারের জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনকে এগিয়ে আসতে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনে আর্থিক সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা। অন্য স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কাছে তা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। দেশে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে কাজ করছে ১০২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। লাইফ ও নন-লাইফ মিলিয়ে ৮১টি বিমা কোম্পানি। দেশের অধিকাংশ ব্যাংক বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর ফাউন্ডেশন রয়েছে। সব দুর্যোগে এরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। এগিয়ে আসতে পারে এনজিও ও বণিক সমিতি। দোকান মালিক সমিতিগুলো অগ্নিনিরাপত্তায় আলাদা তহবিল গঠন করতে পারে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গোষ্ঠী অগ্নি বিমা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। অবৈধ সংযোগ, ত্রুটিপূর্ণ পরিবেশ বর্জন এবং অগ্নিনিরাপত্তার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা সর্বোপরি পরম্পরের প্রতি সহযোগী মনোভাবই অগ্নিকাণ্ড রোধ এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী সমাধান বলে মনে করছি। ভাবতে হবে দেশটা আমাদের সবার। নাশকতা ও দুর্ঘটনায় সবারই ক্ষতি। তাই ক্ষতিগ্রস্ত মনের আগুন নেভাতে হবে নিজেকেই পূর্ব সতর্কীকরণ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক

[email protected]

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ