X
রবিবার, ১১ মে ২০২৫
২৮ বৈশাখ ১৪৩২

ডিজিটাল আইন কি অসাংবিধানিক?

আমীন আল রশীদ
২৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৩:৪৪আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৩:৪৪

বাকস্বাধীনতা নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার এবং বাংলাদেশের সংবিধান যেসব ধারাকে সংশোধন অযোগ্য বলে ঘোষণা (অনুচ্ছেদ ৭খ) করেছে, তার মধ্যে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ৩৯ অনুচ্ছেদ অন্যতম।

কিন্তু ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর থেকেই বলা হচ্ছে যে, এই আইন নাগরিকের বাকস্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করছে। তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক? সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ বলছে, ‘কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সাথে অসমঞ্জস্য হয়, তাহলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে।’ সুতরাং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোনও বিধান যদি সংবিধানের কোনও বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে আইনের ওই অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।

সংবিধানের ৩৯ (২) অনুচ্ছেদ বলছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা অধিকার দেওয়া হলো।

তার মানে একজন নাগরিক তার বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা পাবেন শর্তসাপেক্ষে। অর্থাৎ তিনি ততটুকু কথা বলা ও লেখার অধিকার পাবেন, যতটুকুতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়; বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট না করে; জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার পরিপন্থি না হয়; আদালত-অবমাননাকর না হয়; মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা না দেয়। অর্থাৎ বাকস্বাধীনতার বিষয়টি ‘অ্যাবসোলিউট’ নয়। যা খুশি তা বলা বা লেখা নয়। অন্যের অধিকারকে সম্মান করাই যে স্বাধীনতার মূল কথা, এই অনুচ্ছেদের স্পিরিট সেটিই।

অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন। কিন্তু আইনটি পাস হওয়ার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কোনও না কোনও সংবাদের দ্বারা সংক্ষুব্ধ হয়ে তৃতীয় কোনও ব্যক্তি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। প্রশ্ন হলো, একজন সাংবাদিকের রিপোর্ট কী করে ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের মধ্যে পড়ে এবং এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে কী করে এই আইনে মামলা হয়?

এই আইনের আরেকটি উদ্দেশ্য ডিজিটাল মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধ। কিন্তু এই আইনে এ পর্যন্ত পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধে কতগুলো মামলা হয়েছে আর ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া এবং অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে খবর প্রকাশ করার কথিত মানহানির অভিযোগে কতগুলো মামলা হয়েছে—তার একটি পরিসংখ্যান পাওয়া গেলে এই আইনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হবে।

অস্বীকার করা যাবে না, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কোনও নাগরিক যদি অসম্মানিত হন; সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্ত লঙ্ঘন করে কেউ যদি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কিছু লেখেন; কোনও নাগরিক যদি হয়রানি বা পর্নোগ্রাফির শিকার হন, তাহলে তার প্রতিকারের জন্য একটি আইনি কাঠামো আবশ্যক। তাছাড়া ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইস সহজলভ্য হওয়ায় পৃথিবী যেহেতু এখন প্রান্তিক মানুষেরও হাতের মুঠোয়; তিনি যেহেতু চাইলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় যা খুশি বলতে পারেন, লিখতে পারেন, দেখাতে পারেন; যেহেতু এখানে কোনও সম্পাদক বা গেটকিপার নেই—ফলে কেউ যদি সচেতনভাবেই অন্য কারও সম্পর্কে বিষোদ্গার করেন, হেয় করেন, গালিগালাজ করেন—তার আইনি প্রতিকারের জন্য আইন প্রয়োজন। সেই অর্থে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কিন্তু এর প্রয়োগ (মূলত অপপ্রয়োগ) জনবিরোধী।

বস্তুত ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পর্কে কোনও ধরনের সমালোচনা এমনকি রসিকতাও যে রাষ্ট্র সহ্য করবে না, এই আইন সেই বার্তাটি সুস্পষ্টভাবে দিয়েছে। অর্থাৎ উদ্দেশ্য হিসেবে যা-ই লেখা হোক না কেন, এরকম আইন মূলত রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোকেই শক্তিশালী করে। নাগরিকরা যাতে খোলামেলাভাবে কিছু লিখতে না পারে, ক্ষমতাবানদের সমালোচনা করতে না পারে, সেরকম একটি কুসুমাস্তীর্ণ পথ তৈরি করাই হয়তো এই আইনের অলিখিত উদ্দেশ্য।

আইনের কয়েকটি ধারায় অস্পষ্টতাও রয়েছে। যেমন ২১ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনও প্রকার প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালানো বা তাতে মদত দেওয়ার শাস্তি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।

এই ধারাটি নিয়ে সমালোচনার মূল কারণ, কোন কথাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তাতে মদত দেওয়া বলতে কী বুঝানো হবে—তা স্পষ্ট নয়। নয় বলেই যেকোনও সমালোচনা এমনকি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কোনও অ্যাকাডেমিক আলোচনাকেও প্রোপাগান্ডা বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

২৮ ধারায় বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করা বা উসকানি দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কোনও কিছু প্রকাশ বা প্রচার করা হলে পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

এই ধারাটি নিয়েও সমালোচনার মূল কারণ অস্পষ্টতা। অর্থাৎ ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতি বলতে কী বুঝাবে এবং কোন কথা বললে বা লিখলে এই অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হবে তা স্পষ্ট নয়। একটি ধর্মের কোটি কোটি অনুসারী থাকতে পারেন। সুতরাং কোনও একজন ব্যক্তির কোনও একটি কথার দ্বারা দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হলেই তিনি এই আইনের আলোকে মামলা করতে পারবেন মানে হলো, তিনি ওই ধর্মের অনুসারী কোটি মানুষের প্রতিনিধি—এটি বাস্তবসম্মত নয়। প্রশ্ন হলো কার অনুভূতিতে কে আঘাত করে?

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মূল দুর্বলতা এর সংজ্ঞায়। অর্থাৎ ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ বলতে কী বোঝানো হবে এবং এর ব্যাপ্তি কতটুকু—আইনে তা স্পষ্ট নয়। নয় বলেই যেকোনও নাগরিক যেকোনও সহনাগরিকের বিরুদ্ধে চাইলেই মামলা করতে পারেন এবং যেহেতু এটি অজামিনযোগ্য, ফলে পুলিশ কাউকে ধরলেই তার গন্তব্য কারাগার।

এরকম বাস্তবতায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনও এই ধারা দুটি বাতিলের সুপারিশ করেছে। কিন্তু আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, ধারা দুটি বাতিল করা হবে না। কারণ তিনি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার মর্যাদা রক্ষার বিষয়গুলোতে যেহেতু মানুষের আবেগ-অনুভূতি রয়েছে এবং এগুলো নিয়ে কটাক্ষ করে স্বাধীনতাবিরোধীরা একটা অরাজক পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করে থাকে, ফলে এই ধারা বাতিলের সুযোগ নেই। একইভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে বা উসকানির মাধ্যমে যাতে কেউ অস্থিরতা সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য ২৮ ধারা বাতিলেরও পক্ষে নন আইনমন্ত্রী। (প্রথম আলো, ০৬ এপ্রিল ২০২৩)।

তবে আইনের সংশোধন নয়, বরং পুরো আইনটি বাতিল চায় দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গত ১২ এপ্রিল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এই আইনকে ‘নিবর্তনমূলক’ উল্লেখ করে লিখেছে, এই আইনের অগ্রহণযোগ্যতা শুধু মৌলিক অধিকার পরিপন্থি অসংখ্য ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং আইনটির যথেচ্ছ অপব্যবহারের ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ তথা আপামর জনগণের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতার বিকাশ ঘটেছে, সেজন্য আইনটি পুরোপুরি বাতিল করা প্রয়োজন।

প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম অবশ্য মনে করেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের মাধ্যমে জামিনযোগ্য করা হলে এই আইনের অপব্যবহার অনেকাংশে কমে আসবে। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইনটির দরকার আছে বলে তিনি মনে করলেও এর ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন আছে বলে তিনি স্বীকার করেন। বলেন, এটি যারা প্রয়োগ করেন, তারা অপব্যবহার করেন। (সমকাল, ০৪ এপ্রিল ২০২৩)।

পরিশেষে, ‍শুধু ডিজিটাল আইনের আলোকে কৃত অপরাধকে জামিনযোগ্য করাই সমাধান নয়, বরং আইনের প্রয়োগে রাষ্ট্রের নিয়ত কতটা সহি, অর্থাৎ এই আইন দিয়ে সে আসলেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চায়, নাকি ভিন্ন মত ও যেকোনও সমালোচনা কঠোরভাবে দমন এবং তার মধ্য দিয়ে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়, যাতে কেউ প্রশংসার বাইরে গিয়ে কোনও ধরনের প্রশ্ন করার সাহস না করেন—সেটি আগে ঠিক করতে হবে।  

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরিতে জাপানের সহযোগিতা চেয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা
আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরিতে জাপানের সহযোগিতা চেয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা
শেয়ার মার্কেট সংস্কারে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার
শেয়ার মার্কেট সংস্কারে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার
ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ
ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ
‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য যা করা হচ্ছে সেটাকে রাজনীতি বলা যায় না’
‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য যা করা হচ্ছে সেটাকে রাজনীতি বলা যায় না’
সর্বশেষসর্বাধিক