X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

করদাতার কাছের মানুষটা আসলে কে?  

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন
৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:৪৪আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:৪৪

আমাদের রাজস্ব আহরণের ইতিহাস পুরনো। আমরা ব্রিটিশ শাসনের পূর্বেও কোনও না কোনোভাবে এই ব্যবস্থার সাথে অভ্যস্ত। আইন-কানুন যা আছে বা নেই তার চেয়ে বড় কথা হলো– অভ্যস্ত হওয়ার ব্যাপার। এই দিক দিয়ে আমরা ‘সিনিয়র সিটিজেন’। পূর্ব পূরুষেরা কর দিতেন। আমরাও কর দিচ্ছি, নানাভাবে নানা নামে।

সর্বশেষ স্থানীয় সরকার করও দিচ্ছি, যা আবার অনেকের কাছে ‘চৌকিদারি ট্যাক্স’ নামে পরিচিত। তাই বলা যায়, হঠাৎ করে এই কর ব্যবস্থা আমাদের ওপর অর্পিত হয়নি। বিপুল সংখ্যক করযোগ্য নাগরিক থাকা সত্ত্বেও করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে না; তাহলে প্রশ্ন আসে– সমস্যা কোথায়?

আয়কর আইনের শতবছর অতিক্রম হয়েছে। ১৮শ’ সালের গোড়ার দিকে ভারতবর্ষে এই কর ব্যবস্থাপনাকে আইনি কাঠামোতে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। ধীরে ধীরে তা এসে ১৯২২ সালে চূড়ান্ত রূপ নেয়। মূলত ১৯২২ সালে এই আইনকে নানাভাবে অনুবাদ করে পাকিস্তান ভারত অতঃপর বাংলাদেশে ব্যবহার হচ্ছে অদ্যাবধি। সময় পেরিয়ে গেছে অনেক দূর! সর্বশেষ ব্রিটিশ আইনটিরও বয়স শত বছর পার হয়ে গেলো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সময়োপযোগী একটি আয়কর আইন তৈরি হয়নি এখনও। খুব সম্প্রতি নতুন আইনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; কিন্তু অগ্রগতি কোথায় যেন আটকে যায়; তা সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের অজানা।

আমরা করদাতাগণ আশায় বুক বেঁধেছিলাম ২০২২ সালে রাজস্ববোর্ড কর্তৃক একটি খসড়া আয়কর আইন প্রকাশ করে। পূর্বের ন্যায় প্রায় একই ধারায় অনুবাদ ছাড়া তেমন নতুন সংযোজন নেই আইনটিতেও। জানি না করদাতাদের জন্য সংশোধনিতে কোনও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কিনা।

ধরেই নিলাম, নতুন আইন পাস হলো; ডিজিটাল করা হলো। এতে কি করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে? নাকি রাজস্ব আদায় যে হারে বৃদ্ধি হওয়ার তা হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর মনের জোর দিয়ে কেউ বলতে পারছেন না। এর কারণ কী? মূলত কারণ হলো আমাদের কর আদায় পদ্ধতিতে পরিবর্তন হচ্ছে না। এমনিতেই করদাতাদের মধ্যে ব্যাপক করভীতি কাজ করছে। যারা কর দিচ্ছেন; তাদের কষ্টের কথাগুলো নেতিবাচকভাবে তুলে ধরেন অন্যদের কাছে। এই কারণে নতুন করদাতারা কর অফিসকে এড়িয়ে যেতে চান। কর অফিসের কোনও কর্মকর্তার নাম শুনলেই করদাতারা গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করেন।

তাহলে এই বিপুল সংখ্যক নাগরিকদের মধ্যে যারা করযোগ্য আয় আছে তাদের করনেটে আনতে হলে কৌশলটা কী হতে পারে। এই বিষয়ে আমার একটা অবজারভেশন আছে। তা হলো– কর অফিসের দায়িত্ববানদেরকে করদাতা নিজের লোক বা আপন লোক মনে করে না। তারা মনে করেন সত্য কথা বললে এখানে কোনও একটা ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। তাই হয় তথ্যগোপন করেন, নতুবা এড়িয়ে চলেন।

তাহলে করদাতার আপন মানুষটা কে? মানুষ যখন ডাক্তারের কাছে যায়, সকল রোগের কথা খুলে বলার পরামর্শ দেওয়া হয়; রোগের ইতিহাস না জানলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ত্রুটি হতে পারে। একইভাবে একজন করদাতার আয়ের সকল উৎস ও ব্যয়ের খাত সম্পর্কে না জানলে সঠিকভাবে আয়কর নির্ণয় করা কঠিন। এই কাজটি করার জন্য করদাতার কাছের উপযুক্ত মানুষটি হলো একজন আয়কর আইনজীবী। একজন আইনজীবীর কাছে করদাতা যতটা সহজে নিজের তথ্য প্রকাশ করতে চাইবেন, অন্য ব্যক্তির কাছে তা করবেন না; এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু করদাতার অবস্থানগত পরিধির বিবেচনায় আয়কর আইনজীবীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। যারা আয়কর আইনজীবীর পেশায় আছেন এদের সংখ্যা আনুমানিক ১০ হাজার এর মধ্যে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ পেশাজীবীর অবস্থানই ঢাকায়। বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও উপজেলা শহরে অবস্থানরত করদাতার কাছের মানুষের সংখ্যার তুলনায় এতটাই কম যে, করদাতা মনের কথাগুলো খুলে বলার মানুষ পাচ্ছেন না। প্রতি বছর করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার একটাই অন্যতম কারণ।

এই ক্ষেত্রে করদাতার আপন মানুষ সৃষ্টির জন্য এনবিআরের কাছে এই সুপারিশ করা যেতে পারে: যেমন–

১. করভীতি দূর করার জন্য ব্যাপক হারে ইতিবাচক মেসেজ প্রচার করার উদ্যোগ নেওয়া; যাতে করে নাগরিকরা কর দিলে কোনও প্রকার ঝামেলায় পড়বেন না; তা নিশ্চিত করা;

২. কর অফিসের সুপারভাইজার, পেশকার ও অন্যান্য কর্মীদের করদাতা বান্ধব পরিবেশ তৈরি করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা;

৩. আয়কর পেশাজীবীর পেশায় আগ্রহীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি আইন বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান বিষয়ে ডিগ্রীধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া;

৪. এই পেশায় আগ্রহীদের যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা; সনদ ছাড়া এই পেশায় প্রবেশ করতে না দেওয়া;

৫. জেলা বা উপজেলায় কমপক্ষে ১০ বছর অনুশীলনে থাকার ব্যবস্থাপনা করা; এতে সমগ্র দেশের করদাতাগণ সেবা পেতে সহজ হবে ও বেকারত্ব দূর করতে সহায়ক হবে;

৬. সনদ প্রাপ্ত সকল আইনজীবীকে ১ মাসের একটি বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করা; যাতে করে পুরো পেশাগত বিষয়টি তাদের জানা হয়;

৭. সনদের জন্য আবেদন ও প্রশিক্ষণ ফি রাজস্ব বোর্ড থেকে বহন করা;

৮. প্রস্তাবিত নতুন ট্যাক্স আইনে ‘ট্যাক্স কাউন্সিল’ গঠন করার দাবিটি গুরুত্বসহকারে প্রতিস্থাপন করা;

৯. আয়কর আইনজীবীদের জন্য আচারণ বিধি প্রণয়ন করা; তা পরিপালনের জন্য ট্যাক্স কাউন্সিলকে দায়িত্ব দেওয়া;

১০. সনদ প্রাপ্তদের আবশ্যিকভাবে পেশায় নিয়োজিত থাকার শর্ত দেওয়া; নতুবা সনদ বাতিল করার শর্ত দেওয়া; একইভাবে ইতোপূর্বে যারা সনদ নিয়েছেন; কিন্তু পেশায় নেই, তাদের সনদ বালিত করা;

১১. জেলা বা উপজেলা ভিত্তিক ট্যাক্স বার করা এবং আইনজীবীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা;

১২. প্রত্যেক সার্কেলে আইনজীবীদের বসার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় সোফা/টেবিল, চেয়ার দিয়ে বসার ব্যবস্থা রাখা;

১৩. জেলা বা উপজেলা কর অফিসের সমন্বয়ে ট্যাক্স বারের সদস্যরা যৌথভাবে জরিপ পরিচালনার সুযোগ তৈরি করা; যার ফলে সংশ্লিষ্ট কর্ম এলাকার করযোগ্য সকল নাগরিক করনেটের আওতায় আনতে সহায়ক হবে;

১৪. উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে কমপক্ষে ৫/১০ জন আইনজীবীর সনদ প্রদানের ব্যবস্থা করা; 

এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আসা জরুরি যে, সরকার করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে আগ্রহী কিনা। সরকার চাইলে ন্যূনতম করদাতা থেকে শুরু করে কোটি টাকার করদাতাও করনেটে আসতে বাধ্য। সরকারের ৮ম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশের ভিশন বাস্তবায়নের জন্য করযোগ্য সকল নাগরিকদের করজালে সম্পৃক্ত করা যেমন জরুরি, তেমনি রাজস্ব বৃদ্ধি করাও আবশ্যক।

লেখক: আয়কর আইনজীবী

[email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ