X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

অসম বাজেটের অসুষম আয়োজন

প্রণব মজুমদার
০৪ জুন ২০২৩, ১৮:৪২আপডেট : ০৪ জুন ২০২৩, ১৮:৪২

বেশ ক’বছর ধরেই আমাদের জাতীয় বাজেট অসম। সুষম বাজেট কোথায়? মধ্যবিত্ত ও সাধারণ ভোক্তার প্রতি সুষম আয়োজনের দলিল দেখি না বাজেটে। জাতীয় বাজেট ঘোষণার আগে পরে বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেন। সভা সেমিনার হয়। সুপারিশ আসে। পরামর্শ দেওয়া হয়। আমিও দেই। কিন্তু নীতি নির্ধারকগণ তা কানে নেন না। দিনে দিনে বাড়ছে দেনা, ঋণ, সুদ এবং গণদায়। মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির কষাঘাতে বেশ অসহায়। হৃদয়ের করুণ কান্নার শব্দও কেউ শুনে না।

জাতীয় বাজেট নিয়ে কথা বলেছি বেসরকারি একাধিক স্যাটেলাইট টেলিভিশনে। রাতের আয়োজনে একটি টিভি চ্যানেলের টকশোর বিষয় ছিল– এবারের বাজেট কতটা জনবান্ধব? চ্যানেলটির নিজস্ব ২টি প্রতিবেদন, সঞ্চালক, রাজস্ব বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতির অধ্যাপক এবং আমি ছিলাম তাতে। আলোচনা এবং বিজ্ঞাপন বিরতিতে অনেক কথাই অব্যক্ত থেকে গেছে আমাদের। নির্ধারিত ৪৫ মিনিটে ৪ জনের মতামত ও ফুটেজে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে আলোচনা করা কি যায়? স্বল্প সময়ের আলোচনায় আমাদের তিনজনের মন্তব্য ছিল প্রায় একই রকমের। অতিরিক্ত ঘাটতি বাজেট সত্যি আশঙ্কার। ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা সুচারুভাবে সম্পন্ন হবে কিনা তা এক বড় প্রশ্ন।

এবারের জাতীয় বাজেট ধনিক শ্রেণি ও দাতাবান্ধব। মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের অস্বস্তি আরও বাড়বে। অতি মুনাফালোভী সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ীর নির্দয় ও অমানবিক আচরণ এবং ক্রমবর্ধমান পণ্যের অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনায় এসব শ্রেণির জনগণের উপশমে কোনও ব্যবস্থা বাজেট দলিলে দৃশ্যমান নেই। চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে মোট ব্যয় ৮৩৭২১ কোটি টাকা বৃদ্ধি রাখা হয়েছে। বাজেটে প্রাক্কলিত বৈদেশিক ঋণ ১৩১০৯০ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) ২৫৮৫৮ কোটি টাকা কম ছিল। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সংশোধিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণ ছিল ১ রাখ ৪০ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে তা ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারকে ফি বছর অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণ বাড়াতে হচ্ছে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা এবার ৫ লাখ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ৭৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। এবারের বাজেটে মোট ঘাটতি ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। গত ১০ বছর ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না। ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আয়কর নিবন্ধনকারীকে আয় না হলেও ন্যূনতম ২ হাজার টাকা করে আয়কর দিতে হবে, যা কিনা ক্রমবর্ধমান বাজারে গোদের ওপর বিষফোঁড়া! পরোক্ষ কর অর্থাৎ মূল্য সংযোজন কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ১৯২ কোটি টাকা।

অর্থাৎ এবার ৪২ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা বেশি। বাজেটে মধ্য ও নিম্নবিত্ত ভাগ্য উন্নয়নের প্রতিফলন কোথায়? যে শিশুটি আজ জন্ম নেবে সেও ঋণগ্রস্ত দেশের আওতায় আসবে। বাংলাদেশের মাথাপিছু ঋণ তো রীতিমতো ভীতিকর। অর্থনৈতিক চাপের মুখে আমরা ঋণ নিয়েছি বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান, রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রতিবেদন থেকে এ পরিসংখ্যান জানা যায়। ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায় বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি মার্কিন ডলার = ১০৫ টাকা) বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা ঋণ বাবদ বাংলাদেশের কাছে পাবে প্রায় ৭ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। গত ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফ-এর কাছ থেকে শর্তযুক্ত ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড়ের সময় ১২৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আইএমএফ মনে করে বাংলাদেশের ঋণ এখনও ঝুঁকিসীমার মধ্যে রয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু ঋণ কত? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসাবে দেখা যায়, গত বছর এ সময় পর্যন্ত দেশের ১৬ কোটি ১৭ লাখের ওপরে জনসংখ্যার মাথাপিছু ঋণ ছিল ৯৫ হাজার ৬শ’ টাকা। প্রতি বছর ১০ হাজার টাকার ওপরে তা বাড়ে, সে হিসাবে বর্তমান সময়ে ২০২২ সালের শুমারি অনুযায়ী ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ৩০ হাজার (অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩) জনসংখ্যার মাথাপিছু ঋণ বর্তমানে ১ লাখ ১০ হাজার টাকার ওপরে। বিষয়টি উৎকণ্ঠার।

এ তো গেলো জাতীয় বাজেট, রাজস্ব আয়, ব্যয় ও ঋণের পরিসংখ্যান এবং উপাত্ত। এবার মূল বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ঢাকা শহরে বসবাসকারী মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন বেসরকারি শিক্ষিত চাকরিজীবীর যাপনের মাসিক হিসাব দেই। ২ সন্তানসহ ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিবারের মাসিক খরচ বর্তমানে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা। বাসা ভাড়া, সার্ভিস চার্জ ও ইউটিলিটি বিলসহ ২৫ হাজার, মাসিক বাজার ৩০ হাজার, শিক্ষা খরচ ২০ হাজার, চিকিৎসা খরচ ১০ হাজার, যাতায়াত ১০ হাজার এবং হাতে নগদ ৫ হাজার। বর্তমান শ্রম বাজারে উচ্চ শিক্ষিত এক চাকরিজীবীর বেতন গড়ে ৬০/৭০ হাজার টাকার বেশি নয়। প্রতি মাসে বাড়তি ৩০/৪০ হাজার টাকা আসবে কোথা থেকে? মধ্যবিত্ত পরিবারের এ চাকরিজীবীকে হয় একাধিক উপার্জনের দিকে ভাবতে হয়, না হলে গ্রামের বাড়ি বা আরেক সদস্যের রোজগার বা অন্য উৎসে যেতে হয়। বাজেটে এবার করমুক্ত আয়সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এমন কর্মজীবীর কথাই ধরি। এ শ্রেণির কারও আয় যদি মাসিক বেতন ৩০ হাজার টাকা হয়, তাহলে তাকে আয়কর দিতে হবে। আমার মতে, বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজারে করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ থাকা যুক্তিযুক্ত। আয় না করলেও আয়কর! এ আবার কেমন কথা? আয় হোক না হোক কর নিবন্ধনকারীকে প্রতি বছর ২ হাজার টাকা দিতে হবে। আয়কর রিটার্ন প্রমাণপত্র নিতে ২০০০ টাকা কর। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অধিকাংশ অশিক্ষিত এবং সহজ সরল সাধারণ মানুষ। কেউ কেউ ঠিকমত স্বাক্ষরটি পর্যন্ত দিতে পারে না। এসব মানুষের পক্ষে আয়কর বিভাগের নির্ধারিত ফরম পূরণ করে করা প্রদান করা দুঃসাধ্য বটে। এর জন্য দ্বারস্থ হতে হবে আয়কর বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কাছে। তখন ২০০০ টাকা প্রদান করতে গিয়ে তাকে আরও ‘কর’ দিতে হবে। দেখা যাবে ২ হাজার টাকা কর দিতে গিয়ে খরচ হবে আরও ৩ হাজার। নতুন করে কর আদায়ে বিড়ম্বনা যেমন সৃষ্টি হবে, তেমনি আদায়কারীদের অসদুপায়ের পথ তৈরি হবে।

২০০০ টাকা আয়কর দিতে সক্ষম আয়করদাতার সংখ্যা তেমন বড় নয়। সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর পথ এটা হতে পারে না। দেশে বড় বড় শিল্প গোষ্ঠী ও ব্যবসায়ীরা করযোগ্য আয়ের অধিকাংশ অর্থ বাঁচাতে হিসাববিদ ‘পোষেন’। তারা করযোগ্য আয়ের ৭০ শতাংশ দেয় কিনা সন্দেহ। দেখা গেছে করযোগ্য আয়ের অনাদায়ী ২০ শতাংশ বিশেষ ব্যবস্থায় আদায়কারীর পকেটে চলে যায়। ফলে করযোগ্য আয়দাতা ৫০ শতাংশ করমুক্তি পায় অনানুষ্ঠানিকভাবে। সরকার বঞ্চিত হন রাজস্ব থেকে। আর এ দায় পড়ে মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করজালে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সরকারকে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে দাতা সংস্থা ও উন্নত দেশগুলোর কাছে থেকে সহায়তা ও ঋণ দিতে হচ্ছে। তাদের ঋণ শর্ত পূরণ করতে গিয়ে সেবা খাতে বারবার মূল্য বাড়াতে গিয়ে দেশের মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের জীবন চরম দুর্দশায় মধ্যে উপনীত হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থাপনায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য দিতে গিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তাদের প্রতিনিয়ত। অভ্যন্তরীণ ঋণ মানে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ বৃদ্ধি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে ব্যাহত করবে। এতে কর্মসংস্থানের নতুন পথ তৈরি হবে না।  

অবকাঠামোগত উন্নয়নের স্রোতে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি। ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ায় মাথাপিছু আয় হবে সাড়ে ১২ হাজার মার্কিন ডলার। কিন্তু এ সম্ভাব্য অর্জনকে খেয়ে ফেলবে মাথাপিছু ঋণের বোঝা। তাই ঘাটতি বাজেটের ব্যয় ব্যবস্থাপনা সহনীয় পর্যায়ে রেখে মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের জন্য স্কিম বা প্রণোদনা থাকাটা বাঞ্ছনীয় মনে করছি। তাই অসম বাজেটের সুষম বণ্টন সাধারণ মানুষের যাপন কষ্ট নিবারণে সহায়ক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কৃষকের মুখে হাসি কপালে চিন্তার ভাঁজ
কৃষকের মুখে হাসি কপালে চিন্তার ভাঁজ
টিভিতে আজকের খেলা (৫ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৫ মে, ২০২৪)
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ