X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্রের যে আচরণ শঙ্কা জাগানিয়া

মো. জাকির হোসেন
১১ জুন ২০২৩, ১৬:৪৫আপডেট : ১১ জুন ২০২৩, ১৮:৩২

অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যাসহ অনেকেই জোরেশোরে বলছেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এটি কি রাজনীতির কৌশল, না এর কোনও ভিত্তি রয়েছে? আমি তাদের বলি, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই ষড়যন্ত্র চলছে। ৫২ বছর বয়সী ষড়যন্ত্র এখন অনেক বেশি পরিণত ও বিপজ্জনক। বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের দেশীয় দোসর ছাড়াও বেশ কয়েকটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা রয়েছে আর প্রায় সবগুলোর সঙ্গে কোনও না কোনোভাবে পাকিস্তান জড়িত।

’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধস জয় পেলেও যুক্তরাষ্ট্র সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষ নিয়েছিল। তার মানে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রকে পায়ে দলে স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিল। এখানেই শেষ নয়, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি জান্তাকে অস্ত্র, অর্থ দিয়ে বাঙালি গণহত্যায় সহযোগিতা করেছিল। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের পরাজিত করে বাংলাদেশ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন যুক্তরাষ্ট্র খন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। মোশতাক প্রচার করে শেখ সাহেবকে জীবিত পেতে হলে স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি পরিত্যাগ করতে হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে যেকোনও ধরনের আপসের বিনিময়ে হলেও বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষা করতে প্রস্তুত তারা। অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষাই ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও মোশতাকের লক্ষ্য। পাকিস্তানের সংহতি রক্ষায় মোশতাক ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ প্রযোজনার ষড়যন্ত্র জানাজানি হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্র এই ষড়যন্ত্র প্রকল্প থেকে পিছু হটে। কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নতুন চাল শুরু করে।

বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্র ’৭১-এর ৪ ও ৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির জন্য পরপর দুটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। দুটি প্রস্তাবেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োগ করে। এদিকে ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। অন্যদিকে, ৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন ডেকে ১০৪-১১ ভোটে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস করিয়ে নেয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত এ প্রস্তাবের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের দ্রুত বিজয় অর্জনের দিকে মনোযোগ দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে সপ্তম নৌবহর প্রেরণের হুমকি দেয়। ৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম উপকূলে অবস্থিত সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেন। বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর সর্বাত্মক পতন রোধের জন্য নৌ, বিমান ও স্থল তৎপরতার সম্ভাব্য মিশন দেওয়া হয় সপ্তম নৌবহরকে। সপ্তম নৌবহরের টাস্কফোর্সে ৫ হাজার সৈন্যসহ ৭৫টি জঙ্গি বিমান ও পাঁচটি হেলিকপ্টার ছিল। তা ছাড়া মিসাইল ও ডেস্ট্রয়ারসহ ২৫টি অ্যাসল্ট হেলিকপ্টার ওই ফোর্সে সংযোজন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ মোকাবিলায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পাঁচটি সাবমেরিনসহ ১৬টি নৌ-যুদ্ধজাহাজ বঙ্গোপসাগরে ও তার আশপাশে মোতায়েন করে। যুক্তরাষ্ট্র অনুধাবন করে, পাকিস্তানের সংহতি রক্ষায় সামরিক হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে আর কোনও উপায় নেই। কিন্তু তার জন্য চীনের সরাসরি সামরিক সংশ্লিষ্টতা ছিল মার্কিনিদের জন্য অত্যাবশ্যক। কিন্তু ১২ ডিসেম্বরের শেষ প্রহরে চীন জানিয়ে দেয় তারা সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপে যাবে না। তবে জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে সব রকম সমর্থন দেবে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র-চীন মিলে ১৩ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে আবারও যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতে তৃতীয়বারের মতো ভেটো দেয়।

চীন সামরিক পদক্ষেপ থেকে পিছিয়ে যাওয়ায় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অনড় অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহরকে চূড়ান্ত নির্দেশ দেওয়া থেকে বিরত থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা অব্যাহত থাকে। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অস্থিতিশীল ও উৎখাত করতে যুক্তরাষ্ট্র নানা কলাকৌশল প্রয়োগ করতে থাকে। সুযোগ পেয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে খাদ্যাস্ত্র প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ তখন খাদ্যে স্বনির্ভর ছিল না। ঘাটতি পূরণের জন্য তখন প্রতিবছর বিদেশ থেকে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টন খাদ্য আমদানি করতে হতো। তদুপরি বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ‘পোড়া মাটি নীতি’র যুদ্ধ কৌশলের অংশ হিসাবে মজুত খাদ্যশস্য সব নষ্ট করে দেয়। অন্যদিকে, যুদ্ধ চলাকালে অনেক কৃষক জমি চাষ করতে পারেনি। ফলে ফসল হয়নি। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার কোনও রকমে পরিস্থিতি সামাল দেন। এ ক্ষেত্রে তখন প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারত অনেক সহায়তা করেছিল। কিন্তু ’৭৪ সালে খাদ্য সংকট আরও বাড়তে থাকে। ভারতেও তখন খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তাই ভারত থেকে বাড়তি কোনও সাহায্য আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। উপরন্তু দেশে আঘাত হানে ভয়াবহ বন্যা। দেশের একটি বিরাট অংশ পানির নিচে তলিয়ে যায়। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খাদ্য অস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। যে অসৎ প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যকে বাঙালিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করেছে তা ন্যক্কারজনক। ১৯৭৩ সালে সিনাই যুদ্ধ ও তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমারা তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা উল্টে দেওয়ার জন্য নানা আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। বিশেষভাবে মার্কিন খাদ্য সাহায্যের ওপর অধিকতর নির্ভরশীল গরিব স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে মার্কিন প্রশাসন তেলের দাম কমানোর ব্যাপারে ওপেকের ওপর চাপ সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করতে চায়। বাংলাদেশ অনুধাবন করে যুক্তরাষ্ট্রের দাবার ঘুঁটি হলে তা ওপেক সদস্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে, যা বাংলাদেশের জন্য ভয়ানক ক্ষতির কারণ হবে। কারণ, বাংলাদেশ তখন ইরান, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের সঙ্গে যোগাযোগ করছিল সুবিধাজনক হারে তাদের ঋণদানের প্রবাহ বাড়ানোর জন্য ও বিলম্বিত দায় পরিশোধের ভিত্তিতে জ্বালানি ক্রয়ের জন্য। ওপেক দেশের সঙ্গে বিভেদ সৃষ্টির পাশ্চাত্য কৌশলের সঙ্গে বাংলাদেশ নিজেকে জড়িত করতে অনিচ্ছুক হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘খাদ্যের রাজনীতি’র ভয়ংকর অস্ত্রের আশ্রয় নেয়। ১৯৭৩ সালে ভালো আমন ফসল হওয়ায় ১৯৭৪ সালের শুরুতে চালের দাম পড়ে যায়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান মজুতদারি, ফাটকাবাজি ও আমদানি ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা এবং ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যা খাদ্য সংকটকে ত্বরান্বিত করে। ১৯৭৩-৭৪ সালে খাদ্য বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ২২ লাখ টন ধরেছিল।

১৯৭৩ সালের ১ আগস্ট ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে আলোচনাকালে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এ হিসাব পেশ করেছিলেন। ওই বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে তিন লাখ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দের জন্য তিনি আবেদনও জানিয়েছিলেন। এরপর ১৯৭৩ সালের ৩০ আগস্ট বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম ও মার্কিন সাহায্য সংস্থার সহকারী প্রশাসক মরিস উইলিয়ামসের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নূরুল ইসলাম জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য সাহায্যের কথা তোলেন। তিনি বলেন, বিশ্বে উচ্চ খাদ্যমূল্যের জন্য বাংলাদেশকে নগদ মূল্যে খাদ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা অর্ধেক করতে হয়েছে। তাই তিনি মার্কিন পিএল-৪৮০-এর অধীনে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম ও ২০ হাজার টন ভোজ্যতেল বরাদ্দ এবং দ্রুত পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানান। ১৯৭৪ সালের ৯ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্য ও সয়াবিন তেলের জরুরি প্রয়োজনীয়তার তাগিদ দেন। তিনি আরও জানান, চড়া দামে বিশ্ববাজার থেকে ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করার ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় নিঃশেষিত। বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে, এটা বুঝতে পেরে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য দায়ী ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত ত্যাগ করার জন্য চাপ দেন। এদিকে সরকারের গুদামে খাদ্য মজুতের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমে একসময় নেমে আসে মাত্র ৫৬ হাজার টনে। প্রবল মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে ভয়াবহ বন্যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। ঠিক তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার শেষ তুরুপের তাসটি প্রয়োগ করে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টার ১৯৭৪ সালের ২৯ মে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে নিজে যেচে এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। সভায় ডেভিড বোস্টার বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশন কিউবার কাছে কয়েক মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৪০ লাখ পাটের থলে বিক্রির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে মর্মে সংবাদের প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বোস্টার ড. কামাল হোসেনকে জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস প্রণীত আইন অনুযায়ী যেসব দেশ কিউবা ও উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে বাণিজ্য করছে তাদের জন্য পিএল ৪৮০-এর অধীন খাদ্য সাহায্য নিষিদ্ধ।

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর চেষ্টা করে– এক. কিউবার কাছে পটের থলে বিক্রি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। মাত্র ৪০ লাখ চটের থলে ৫০ লাখ ডলারের বিনিময়ে রফতানি করা হবে। এটা কোনও দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য চুক্তির অংশ নয়। তদুপরি, বাংলাদেশ যখন কিউবার সঙ্গে চুক্তি করে তখন জানা ছিল না যে তা পিএল ৪৮০ চুক্তির শর্তবিরোধী।

দুই. বাংলাদেশের অন্যতম রফতানি পণ্য হলো কাঁচা পাট। পাটের বৈশ্বিক বাজার ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছিল। এমন অবস্থায়, কোনও দেশে পাট কিংবা পাটজাত পণ্য রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় সংকটে পড়বে। যার মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ও ব্যালেন্স অব পেমেন্টে।

তিন. বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যুক্তি তুলে ধরে যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে কিউবায় গাড়ি রফতানির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মতো বাংলাদেশের জন্যও যেন বিশেষ অনুমতি নিয়ে চটের ব্যাগ রফতানির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কোনও যুক্তি কিংবা অনুরোধই গ্রহণ করেনি। অথচ ওই সময়ে মিসর কিউবার কাছে তুলা রফতানি করা সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালের ৭ জুন পিএল ৪৮০-এর অধীনে যুক্তরাষ্ট্র মিসরকে ১ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। আর ওই বছরেরই ১২ সেপ্টেম্বর পিএল ৪৮০-এর বিধানকে শিথিল করে যুক্তরাষ্ট্র মিসরকে ১৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের এক লাখ টন গম প্রদানের ব্যবস্থা করেছিল। বাংলাদেশের সব অনুরোধ উপেক্ষা করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত দ্বিতীয়বার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করলে তার পরিণামের কথা উল্লেখ করেন। এরপর রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক পত্র দিয়ে বাংলাদেশকে জানানো হয়, পিএল ৪৮০-এর অধীনে সহায়তা পেতে হলে বাংলাদেশকে এই মর্মে লিখিত কিংবা মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে বাংলাদেশ সরকার কিউবায় কোনও পণ্য রফতানি করবে না। রাষ্ট্রদূতের চিঠি বাংলাদেশকে এক ভয়ংকর সংকটের মুখে ঠেলে দেয়। একদিকে কিউবার সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ও রফতানি চুক্তি, আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি ও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের চোখ রাঙানি।

আসন্ন দুর্ভিক্ষের কথা বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক সংঘর্ষে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং প্রধানমন্ত্রী একটি বৈঠকে মিলিত হয়ে ১৯৭৪ সালের ১০ জুলাই সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্ত নেন যে বাংলাদেশ সরকার মার্কিন সরকারকে তাদের আকাঙ্ক্ষিত প্রতিশ্রুতি প্রদান করবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও চাল পাঠাতে অহেতুক বিলম্ব করতে থাকে। অজুহাত হিসেবে খাড়া করে উদ্ভট এক যুক্তি। তারা বলে, কিউবায় চলতি মৌসুমে যে ৪০ লাখ চটের থলে পাঠানো শুরু হয়েছিল সেটার সরবরাহ পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত চাল পাঠানো হবে না। সুতরাং ১৯৭৪-এর অক্টোবর পর্যন্ত চাল পাঠানো স্থগিত করে। অবশেষে চুক্তি করার প্রায় এক বছর পর ৪ অক্টোবর ১৯৭৪ সালে পিএল ৪৮০-এর অধীনে চাল পাঠানোর জন্য আমেরিকা সবুজ সংকেত দেয়। কিন্তু এর মাঝে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। দুর্ভিক্ষের কারণে মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র কেবল সরকারি সাহায্য প্রদানেই টালবাহানা করেনি; বরং আরও যে ক্ষতিটি করেছিল তা হলো, বাংলাদেশের সংকটজনক আর্থিক পরিস্থিতির কথা তারা বাণিজ্যিক ঋণদাতাদের কাছে প্রকাশ করে দেয়। ফলে ১৯৭৪ সালে ঋণচুক্তির অধীনে মার্কিন খাদ্যশস্য রফতানিকারকদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য সরবরাহ সংক্রান্ত দুটো চুক্তি বাতিল করে দেওয়া হয়। কারণ, বাংলাদেশের ঋণ গ্রহণের যোগ্যতা সম্পর্কে তাদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়।

মার্কিন খাদ্যশস্য রফতানিকারকরা মার্কিন সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। এটি সহজেই অনুমেয়, চুক্তি বাতিলেও যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল। নানা গড়িমসি শেষে খাদ্যশস্য সরবরাহ করলেও যুক্তরাষ্ট্র ২০ হাজার টন ভোজ্যতেল সরবরাহ বন্ধ রাখে। অথচ এ ভোজ্যতেল দেওয়ার চুক্তি হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। ভোজ্যতেল সরবরাহ বন্ধ করার ফলে সয়াবিন তেলের দাম মণপ্রতি ২৭১ থেকে ৫১৮ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। সয়াবিনের সংকটে সরিষার তেলের দামও মণপ্রতি ৫৪৪ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৪৪১ টাকা দাঁড়ায়। কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্স, নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ পত্রিকায় (১৯৭৬ সালের জানুয়ারি সংখ্যা) এমা রথচাইল্ড ‘ফুড পলিটিকস’ শিরোনামের এক প্রবন্ধ লিখেন। ওই প্রবন্ধে তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের জন্য সরাসরি মার্কিন সরকারকেই দায়ী করেন। বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে মানুষ হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রের বোধোদয় হবে এমনটি ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আরও মর্মান্তিক। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন। মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার এরিক হিচিন্স তাঁর ‘ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ গ্রন্থে মুজিব হত্যায় কিসিঞ্জারকে দায়ী করেন। পুলিৎজার বিজয়ী মার্কিন সাংবাদিক সেইম্যুর হার্শ তাঁর ‘প্রাইস অব পাওয়ার’ গ্রন্থেও মার্কিন প্রশাসনকে অভিযুক্ত করেন। জান্নিকি অ্যারেন্স ভারতের ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে লেখেন, ‘সপরিবারে মুজিব হত্যা প্রায় নিশ্চিতভাবেই সিআইর সহায়তায় ঘটেছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ড. পামেলা কে গিলবার্ট তাঁর ‘ইমাজিনড লন্ডনস’ বইয়ে লিখেছেনে, ‘সিআইএ মুজিব হত্যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রতিক্রিয়াশীল বাঙালিদের ব্যবহার করেছিল।’

মার্কিন দলিলপত্র সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৯৭২ থেকে খুনি ফারুক নিয়মিতভাবে মার্কিন মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। এমনকি ১৯৭৪ সালে তিনি মার্কিনিদের কাছে তার অভ্যুত্থান পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুল্টজ তার ‘বাংলাদেশ: দ্যা আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ গ্রন্থে লিখেছেন, ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ’র স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অর্থাৎ মুজিব হত্যার দিন পর্যন্ত চক্রান্তকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিল। ফিলিপ স্বীকার করেন, ‘তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্রে খবর পাঠান, তখনও (ঢাকায়) অভ্যুত্থান চলছিল।’ মুজিব হত্যার রাতে মার্কিন দূতাবাস সারা রাত কর্মব্যস্ত ছিল। দূতাবাসের উচ্চপদস্থ অফিসারদের অধিকাংশই সেদিন অফিসে রাত কাটিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশে টানা দেড় দশক প্রকাশ্যে কিংবা ছদ্মবেশে সামরিকতন্ত্র চলেছে; বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না মর্মে সভ্যতা ও মানবাধিকারবিরোধী কালো আইন করা হয়েছে; জেলখানার অভ্যন্তরে নিরস্ত্র, নিরপরাধ চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে; সশস্ত্র বাহিনীর শত শত সদস্যকে প্রহসনের বিচারে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে, সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত গ্রেনেড দিয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলকে নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়েছে; রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদ উত্থানের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে; ভয়ংকর সংখ্যালঘু নির্যাতন-হত্যা-ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেই সময় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বেদনা প্রকাশ করতে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি ঘোষণা করেনি, কংগ্রেসম্যানরা এতটা উদ্বেগাক্রান্ত হননি। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে ২০ হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে; অথচ বাইডেন তাকে গণতন্ত্র সম্মেলনে অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং দুতার্তে অংশগ্রহণও করেছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, নির্বাচন, সভা-সমাবেশ ও মত প্রকাশে সীমাবদ্ধতা নেই, এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু কম্বোডিয়ায় জুলাই মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে সব বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ কিংবা অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।

কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে কোনও নিষেধাজ্ঞা কিংবা ভিসানীতি নেই। কম্বোডিয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানো। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব এক ভয়ংকর সংকটের মুখে। কিন্তু, সেসব ছাপিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন হচ্ছে হোয়াইট হাউজে, যা অস্বাভাবিক। আর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সব শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে দূতাবাসকে কখনও নির্বাচন কমিশন কিংবা সমান্তরাল সরকার হিসেবে উপস্থাপন করছেন। মুখে মানবাধিকারের কথা বললেও সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনিকে বছরের পর বছর আশ্রয় দিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে এসব সত্যিই ভয়ের। যুক্তরাষ্ট্রের দৌড়ঝাঁপে যারা উল্লসিত তাদের উদ্দেশে ছোট মুখে একটি বড় কথা বলি, বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়ে অতীতে কোনও দেশই জনগণের স্বার্থ সুরক্ষায় সফল হতে পারেনি।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

 
 
/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সৌদি আরব পৌঁছেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সৌদি আরব পৌঁছেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
ভারতকে নিয়েই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির খসড়া সূচি করেছে পাকিস্তান
ভারতকে নিয়েই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির খসড়া সূচি করেছে পাকিস্তান
ছয় দিনের সফর শেষে দেশে ফিরলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফর শেষে দেশে ফিরলেন প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ