X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোর গ্যাং কেন এত বেপরোয়া?

রেজানুর রহমান
১২ জুন ২০২৩, ১৫:৪০আপডেট : ১২ জুন ২০২৩, ১৫:৪০
রাস্তা কাঁপিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে গেলো একটি মোটরসাইকেল। আরোহী ও চালক মিলে তিন জন কিশোর বসে আছে মোটরসাইকেলে। তিন জনই উদভ্রান্ত, দুর্বিনীত, বেপরোয়া। মাথার চুলের কাটিংয়ে অদ্ভুত স্টাইল। পরনের পোশাকও দেখতে ভয়ংকর। মোটরসাইকেলে আনন্দ-উল্লাস করতে করতে চলে গেলো তারা। যেন বিরাট কোনও অর্জন করে ঘরে ফিরছে। আদতে ‘অর্জন-টর্জন’ কিছু না। রাস্তা কাঁপিয়ে উদ্দাম গতিতে মোটরসাইকেল চালানো তাদের অভ্যাস। এভাবেই এলাকায় তারা সাধারণ মানুষকে ভয় দেখায়। আতঙ্ক সৃষ্টি করে। দৈবাৎ কেউ প্রতিবাদ করলে অথবা তাদের সুপরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করলে তার বা তাদের নিস্তার নেই। চরম নাজেহাল হতে হয়। মিরপুরে এরকম তিন জন কিশোরের মোটরসাইকেল থামিয়ে মৃদু ভর্ৎসনা করতে গিয়ে চরম নাজেহাল হয়েছেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তার সামনে দিয়ে অশোভন ভঙ্গিতে তিন জন কিশোর মোটরসাইকেলে চেপে চলে যাচ্ছিল। ভদ্রলোক বিরক্ত ভঙ্গিতে চিৎকার দিয়ে তাদের থামানোর চেষ্টা করেন। মোটরসাইকেল থামে না। প্রচণ্ড গর্জন তুলে সামনের দিকে চলে যায়। ভদ্রলোক যারপরনাই ক্ষুব্ধ হন। নিজেকে অনেক প্রশ্ন করেন। উত্তর খুঁজে পান না। হঠাৎ দেখেন মোটরসাইকেলটি দুর্বিনীত গতিতে ফিরে এসে তার সামনে দাঁড়াল। একটু হলে ভদ্রলোককে চাপা দিতো। মোটরসাইকেলের চালকের কণ্ঠে অশ্লীল সংলাপ। এই যে …… আপনার সমস্যা কি? ভদ্রলোক যারপরনাই অপমান বোধ করলেন। এতটুকু ছেলে। তার মুখ টিপলে হয়তো মায়ের বুকের দুধ বেরিয়ে আসবে। অথচ তার ব্যবহার ও মুখের ভাষা এত কদর্য? ভদ্রলোক ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, এই ছেলে ভদ্রভাবে কথা বলো... আমাকে তুমি চেন?

চালক ছেলেটি আরও দুর্বিনীত ভঙ্গিতে বললো, চাচা মিয়া চোখ নামায়া কথা বলেন। আপনারে চিনি। খুব ভালো করে চিনি। আপনার একটা মাইয়া আছে না। স্কুলে পড়ে। তারেও ভালো কইর‌্যা চিনি। আজাইর‌্যা আমাদের সাথে লাগতে আইসেন না। আপনার মেয়ে কিন্তু ঝামেলায় পড়বো।

ছেলেটির কথায় রাগে মাথায় রক্ত উঠে এসেছে ভদ্রলোকের। আরও বেশি রেগে উঠলেন। বললেন, এই ছেলে ভদ্রভাবে কথা বলো। তোমার নাম কী? তুমি কোথায় থাকো? তোমার নামে আমি থানায় কমপ্লিন করবো।

ভদ্রলোকের কথা শুনে এবার মোটরসাইকেলে বসা তিন জন কিশোরই একসঙ্গে চিৎকার দিয়ে ওঠে। পেছনে যে ছেলেটি বসেছিল সে মোটরসাইকেল থেকে নেমে ভদ্রলোকের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে। চিৎকার দিয়ে শাসায়, আপনি কিন্তু বহুত ত্যাড়ামি করতেছেন। থানায় যাইবেন? যান... আপনার কত পাওয়ার আমরাও দেখতে চাই... বলেই ভদ্রলোকের পাঞ্জাবির কলার ছেড়ে দিয়ে অগ্নিমূর্তি দেখিয়ে মোটরসাইকেলে চেপে তিন কিশোর চলে যায়। ততক্ষণে ঘটনাস্থলে অনেক মানুষ জমা হয়ে গেছে। সবাই ভয়ার্ত চেহারায় অনেকটা নিজেকে আড়াল করার ভঙ্গিতে ঘটনা দেখছিল। মোটরসাইকেলটি চলে যাওয়ার পর সবাই কে কতটা সাহসী তা প্রমাণের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে। ভদ্রলোককে সান্ত্বনা জানানোর মানুষজনের অভাব হয় না। এখনই একটা প্রতিবাদ মিছিল বের করার জন্য উপস্থিত সবাইকে উসকে দেবার চেষ্টা করে। ভদ্রলোক কারও কথায় কান না দিয়ে একা হেঁটে বাড়ির দিকে চলে যান। বিবেকের তাড়নায় স্থানীয় থানায় অভিযোগ করেন। কোনও লাভ হয় না। থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বয়ং অসহায় সংলাপ শোনান তাকে। ‘এসব বেয়াদব ছেলেদের বিরুদ্ধে কীভাবে ব্যবস্থা নিবো বলেন? ধরেন কাউকে থানায় ধরে নিয়ে এলাম। ব্যস শুরু হবে তদবিরের পর তদবির। স্থানীয় নেতারা ফোন করতে শুরু করবেন। ফলে অপরাধী জেনেও আমরা অপরাধীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হই।’

মূলত এই তদবিরবাজদের কারণেই দেশের সর্বত্র কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই তদবিরবাজরা মূলত এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। মিছিল মিটিংয়ে মানুষের সংখ্যা বাড়ানোর কাজে কিশোরদের ব্যবহার করেন তারা। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মিছিলের অগ্রভাগে কিশোরদের দেখা যায়। তারা স্লোগান দেয়, যুদ্ধংদেহী ভঙ্গিতে রাস্তার গাড়ি সরিয়ে দেয়, সাধারণ পথচারীকে হুমকি ধমকি দেয়। হুমকি, ধমকি দেওয়ার কাজে যে কিশোরের ভূমিকা স্থানীয় নেতার নজর কাড়ে তাকেই তিনি বা তারা কাছে টেনে নেন। গড়ে তোলেন কিশোর গ্যাং। যাদের প্রথম কাজ হলো এলাকায় অবৈধভাবে চাঁদা তোলা আর মিছিলে নেতৃত্বে দেওয়া। নেতাদের আশীর্বাদ পেয়ে কিশোর গ্যাং সদস্যরা ধরাকে শরা জ্ঞান ভেবে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করে। তারা ছিনতাই কাজে লিপ্ত হয়। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে একসময় একই এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দল, উপদল সৃষ্টি হয়। প্রভাব বলয় অক্ষুণ্ন রাখতে অনেকে খুনির ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়। ঢাকার উত্তরায় কিশোর আদনানকে হত্যার নির্মমতা এখনও এলাকার মানুষকে আতঙ্কে রেখেছে। ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের খেলার মাঠে আদনানকে প্রথমে পিটিয়ে ও পরে কুপিয়ে হত্যা করে এলাকারই একদল কিশোর সন্ত্রাসী।

আতঙ্কজনক হলেও সত্য, শুধু রাজধানী ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ৫২টি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। খোদ ডিএমপি এই তথ্য প্রকাশ করেছে। ডিএমপির তথ্য অনুসারে রমনা জোনে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ৭। মিরপুরে ১৩, তেজগাঁওয়ে ৭, উত্তরায় ৬, ওয়ারীতে ৬, গুলশানে ৭, মতিঝিলে ৪ এবং লালবাগে ২টি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। তথ্য অনুযায়ী ঢাকা শহরের মোট ৫২টি কিশোর গ্যাংয়ে প্রায় ৭শ’ সদস্য রয়েছে। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য স্কুলে যায় না। আবার কেউ স্কুলের ছাত্র হলেও স্কুলের প্রতি কোনও মনোযোগ নেই। তাদের মূল কাজ স্থানীয় নেতার পরামর্শ মানা, মিছিলে লোক জড়ো করা, স্লোগান দেওয়া, রাস্তায় মিছিল যাওয়ার সময় ভয়ভীতি দেখিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করা। এটা হলো তাদের প্রকাশ্য দায়িত্ব। এছাড়াও তারা এলাকায় ছিনতাই করা, চাঁদাবাজিতে লিপ্ত থাকা, মেয়েদের স্কুলের সামনে আড্ডা দেওয়া এবং মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার কাজটি বেশ গর্বের সঙ্গে করে। এরা বড়দের সম্মান করে না। বরং প্রকাশ্যে বড়দের অর্থাৎ বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে তুই তোকারি করে গালাগাল দেয়। অসম্মান করে। ফলে সম্মানহানির ভয়ে বড়রা তাদের বিরুদ্ধে কখনও উচ্চবাচ্য করে না।

ঢাকার মিরপুরে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা বেশি। এই এলাকায় প্রায় ১৩টি কিশোর গ্যাংয়ের অধীনে মোট ১৭২ জন কিশোর সক্রিয় রয়েছে। তাদের অনেকেই স্কুলে যায় না। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, স্থানীয় নেতার নির্দেশে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা তাদের মূল কাজ। মেয়েদের স্কুলের সামনে তারা জটলা করে। পথে প্রকাশ্যে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। প্রতিটি কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছে এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক কোনও নেতা। তারা কিশোর গ্যাংয়ের প্রতিটি সদস্যদের কাছে ‘বড় ভাই’ অথবা নেতা হিসেবে পরিচিত। ‘ভাই’ বড়ই মধুর শব্দ। ‘ভাই’ মানে নিরাপত্তার প্রতীক। ভাই সঙ্গে আছে মানেই কোনও বিপদের আশঙ্কা নাই। সঠিক পথের দিশা খুঁজে দিবে ভাই। অথচ কিশোর গ্যাংয়ের ‘ভাই’ ভাইকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়।

প্রিয় পাঠক, কী ভয়ংকর তথ্য নিয়ে বসে আছে পুলিশের নির্ধারিত বিভাগ। ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী শুধু ঢাকা শহরেই ৭শ’ জন কিশোর অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আছে। তাদের অনেকেই স্কুলে যায় না। স্কুলে যাওয়ার প্রয়োজনও মনে করে না। ৭শ’ সংখ্যাটি কিন্তু উদ্বেগজনক। প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরাই এই কিশোরদের অন্ধকার জগতে ঠেলে দিচ্ছেন। তারা কি একবারও ভেবেছেন এই প্রবণতার ভবিষ্যৎ কী? আজকে যে কোমলমতি কিশোরকে চাঁদাবাজি, খুন, রাহাজানি করার ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছে কাল সে আপনার অথবা আপনাদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরবে কিনা, বেয়াদবি করবে কিনা তার কি কোনও নিশ্চয়তা আছে? সবচেয়ে বড় কথা কিশোর গ্যাং সচল থাকা মানেই ভবিষ্যতের চাঁদাবাজ, খুনি তৈরি হওয়া। আমরা কি সেটাই চাইছি?

এই যে ৭শ’ জন কিশোরের কথা বলা হলো, ৭শ’টি পরিবার থেকে উঠে এসেছে তারা। এই পরিবারগুলোর ভূমিকা কী? খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে অনেক পরিবারের প্রধান ব্যক্তি অর্থাৎ বাবা-মা জানেন তাদের সন্তান কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এ নিয়ে তাদের কেউ কেউ নাকি গর্বও করেন। কারণ, ছোট ছেলে সংসারে টাকার জোগান দেয়। এটাই বা কম কীসে? কিন্তু তারা যে নিজের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছেন সেটা হয়তো বুঝতে পারছেন না।

আজকের লেখায় আবারও সেই অনুরোধটি করি। প্রিয় অভিভাবকবৃন্দ– আপনারা কি জানেন প্রতিদিন আপনার সন্তান কোথায় যায়? কার সঙ্গে মেশে? তার বন্ধু কারা? প্লিজ খোঁজ নিন। শুভকামনা সবার জন্য।      


লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ