X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

সেরা দশে বাংলাদেশ

মোস্তফা হোসেইন
১৩ জুন ২০২৩, ১৯:১৩আপডেট : ১৩ জুন ২০২৩, ১৯:১৩
দুপুরের তপ্ত রোদ, বিদ্যুৎবিহীন ঘর, রীতিমতো দোজখের মতো মনে হচ্ছিল গ্রামের বাড়িতে। বিকাল হতেই নস্টালজিক হয়ে পড়ি। বাড়ির দক্ষিণে খালপাড় (এখন সুদৃশ্য পাকা রাস্তা ) দিয়ে হাঁটছি পশ্চিমে। খালের দুই পাড়ে এক ইঞ্চি ফসলি জমি নেই। সব বাড়ি। সুন্দর সুন্দর ইমারত, রাজপ্রাসাদ যেন। রীতিমতো চোখ ঝলসে যাওয়ার মতো।

প্রবাসী কর্মীরা এসব বাড়ির মালিক। থমকে দাঁড়াতে হলো একসময়ের বিশাল ধানের মাঠের দিকে তাকিয়ে। দক্ষিণ দিক থেকে বাড়িগুলো যাচ্ছে উত্তরে, উত্তর দিক থেকে আসছে দক্ষিণে। ছোট হয়ে গেছে ফসলের মাঠ। সন্দেহ হয়, পুরো মাঠ বাড়ির দখলে যেতে হয়তো বছর কুড়ি লাগতে পারে। জানতে চাইলাম সঙ্গী প্রতিবেশীর কাছে– এরপর খাদ্য পাবে কোথায়?

জবাব আসে– কিনে আনবে?

কিনবে কোথা থেকে? সব জায়গাতেই তো এভাবে ফসলি জমি কমছে। উৎপাদন করবে কোথায়?

জবাব পাওয়া গেলো– আসলে আল্লাহই ব্যবস্থা করবেন। এই যে সুন্দর সুন্দর বাড়িগুলো দেখছেন, বাড়িগুলোর একজনও উপোষ নেই। ৫০ বছর আগে এই গ্রামে যে মানুষ ছিল এখন তার অন্তত তিনগুণ হয়েছে। আর ফসলের মাঠের কথা তো আপনিই বললেন। কিন্তু ৫০ বছর আগে এক-তৃতীয়াংশ মানুষের আহার জোগানো যেত না। কিন্তু এখন? কেউ না খেয়ে থাকে না। সবই আল্লাহ ব্যবস্থা করে দেন।

একসময় খালপাড় ছিল বৃক্ষহীন। সেই খালপাড়ে গাছে গাছে ছেয়ে আছে। সবই ফলের গাছ। প্রচুর কাঁঠাল গাছ, ধরেছেও কমবেশি। সবই আল্লাহই দিয়েছেন।

আসলেও ভাবার মতো। পুরো গ্রামে হয়তো একসময় ৬-৭ হাজার মানুষও ছিল না। কিন্তু সেই মানুষগুলোই তিন বেলা খাবার জোগাড় করতে পারতো না। আর এখন গ্রামের জনসংখ্যা নিশ্চিতভাবে অন্তত ২৫ হাজার। এত বেশি জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে কৃষি জমি কমতে কমতে আশঙ্কাজনক অবস্থায়। সেখানে কৃষি উৎপাদন কী পরিমাণ বাড়লে মানুষগুলো খেয়ে-পরে থাকতে পারে? এটাও অবাক হওয়ার মতোই।

এর পেছনের জাদুটা আসলে কী? খাদ্য ঘাটতির এলাকা এখন খাদ্য উদ্বৃত্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে। ফলমূল মাছেরও প্রয়োজনীয় উৎপাদন বেড়েছে। বলতে হবে এর পেছনের মূলশক্তি হচ্ছে আমাদের পরিশ্রমী কৃষক সমাজ। আর তাদের পথ দেখানোর কাজটি করেছেন আমাদের কৃষিবিজ্ঞানী ও সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো।

আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের কৃতিত্ব আজকে স্বীকৃত। তারই একটি সংবাদ প্রকাশ হয়েছে ১০ জুন বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকায়। শিরোনাম ছিল এফএওর উৎপাদনের হিসাব/২২ কৃষিপণ্যে শীর্ষ দশে বাংলাদেশ। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী চাল, মসুর ডাল, আলু, পেঁয়াজ, চায়ের মতো পণ্য যেমন রয়েছে তেমনি অনেক ফলও আছে। গত দশ বছরে আরও যুক্ত হয়েছে কুমড়া, ফুলকপি ও সমজাতীয় সবজির মতো কিছু পণ্যের নামও। সামগ্রিকভাবে কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর মধ্যে ১৪তম স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

অগ্রগতির পরিসংখ্যানও ঈর্ষণীয়। ২০০১ সালে ১১টি পণ্য উৎপাদনে বিশ্বের সেরা দশে অবস্থান ছিল বাংলাদেশের। ২০১১ সালে এসে সেটি দাঁড়ায় ১৭টিতে। ২০২১ সালে এসে সেই সংখ্যা এখন ২২টিতে দাঁড়িয়েছে। এফএও বাংলাদেশের ৬৮ ধরনের কৃষিপণ্যকে তাদের তালিকাভুক্ত করেছে। অথচ বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে ছোট একটি দেশ। চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কম। এদিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৪তম। এত অল্প জায়গায় অধিক ফলনের হিসাব করলে হয়তো বিশ্বে প্রথম স্থান লাভ করতে পারে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়নই কি সর্বাধিক? এগিয়ে যাওয়ার চিত্রটা আসলে কতটা? এটা কি শুধু বাংলাদেশের ভেতরেই দৃষ্টিগ্রাহ্য? কীভাবেই বা খাদ্য ও কৃষিপণ্যের এই ঈর্ষণীয় উৎপাদন বৃদ্ধি হলো? নানা প্রশ্ন আসতেই পারে।

আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের অবদান এক্ষেত্রে বিশাল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাফল্যও চমকপ্রদ। একমাত্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রায় ৫০০ প্রকল্প কাজ চলছে কৃষি গবেষণায় (কয়েক বছর আগের হিসাব)। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা নিরলস কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে। বিদেশি বিজ্ঞানী এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। সামগ্রিক গবেষণার পেছনে বাংলাদেশের সরকারেরও সহযোগিতা আছে। শত কোটি টাকার বাজেট প্রদান তারই প্রমাণ বহন করে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও অবদান রাখছে বেশ। এর একটি বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট। তারা ইতোমধ্যে ধান, পাট, গম, ডাল, তেলবীজ, সবজি ও মসলা জাতীয় শস্যের ১৮টি ফসলের উচ্চ ফলনশীল এবং উন্নত গুণাবলিসম্পন্ন ১১৯টি জাত উদ্ভাবন করেছেন। তাদের গবেষণালব্ধ দিকনির্দেশনা পৌঁছে দেওয়া এবং তৃণমূল পর্যায়ে উন্নত চাষাবাদে সহযোগিতা করছে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কিছু পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে ২০-৪৫% পর্যন্ত। যে কারণে আজকে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়নে বিশ্বের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে।

কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে বাংলাদেশে। এই বিপ্লবে বড় ভূমিকা পালন করছে কৃষিতে আধুনিক যান্ত্রিকীকরণের কাজও। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যান্ত্রিকীকরণের বিষয়টি এসেছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে কৃষি শ্রমিকের ঘাটতির বিষয়টি। গ্রামীণ কৃষক পরিবারের অধিকাংশ তরুণ এখন বিদেশে অবস্থান করছেন। তারা রেমিট্যান্স আসার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখলেও দেশের চিরায়ত কৃষি ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকের ঘাটতি হয়ে গেছে তাদের দেশত্যাগের কারণে। সেদিকটি খেয়াল করে সরকারি আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে দেশে কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন আমদানি কৃষি খাতে একটি বৈপ্লবিক উদ্যোগ হিসেবে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন ব্যবহার বিষয়ক একটি ভিডিওচিত্র দেখে নিশ্চিত হলাম, আজকে কৃষি খাতে বাংলাদেশের দিক পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। আগে যেখানে আমাদের কৃষি বলতে নিরক্ষর এবং স্বল্প আয়ের মানুষের সস্তা শ্রমের সমাহার মনে করা হতো, আজকে সেই পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ভিডিওতে দেখলাম যশোরের কয়েক তরুণ চুয়াডাঙ্গায় ধান কাটতে গেছে। প্যান্ট-শার্ট পরা স্মার্ট যুবকদের একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স কমপ্লিট করে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ধান কাটা, মাড়াই এবং সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে। স্পষ্টত প্রমাণ হচ্ছে, চাষি বলতে যারা একসময় নাক সিটকাতো, সেই দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। গেঁয়ো, নিরক্ষর বলে যাদের নাক সিটকানো হতো সেই যুবকেরা আজকে বাংলাদেশের অগ্রগতির চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছেন বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। আর সেই বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমেই শিক্ষিত তরুণদের জীবিকার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। একসময় নিরক্ষর যুবকেরা যে কাজটি করতেন, আজকে শিক্ষিত তরুণেরা সেই কাজটিকেই বেছে নিচ্ছেন নিজেদের প্রয়োজনে। আর ফল পাচ্ছে আমাদের কৃষক, আমাদের দেশের অর্থনীতি। এমন দেশটিতে মাত্র ২২টি কৃষিপণ্যই নয়, ৬৮টি কৃষিপণ্যই হতে পারে বিশ্বের সেরা দশের একেকটি।

তবে প্রতিটি সাফল্যের সঙ্গে কিছু সমস্যাও থাকে। শুরুতে আমার গ্রামের কথা বলছিলাম, শেষও করতে চাই সেই গ্রামেরই একটি অবস্থা বর্ণনা করে। কৃষি বিভাগের অনুপ্রেরণা পেয়ে আমাদের গ্রামের দুই কৃষক গত বছর কচুর লতি চাষ করেন। কৃষি বিভাগের লোকজন নিয়মিত তত্ত্বাবধান, পরামর্শ, কিছু সার দিয়েও সহযোগিতা করে তাদের। একইভাবে বিনামূল্যে লতির গাছ অর্থাৎ কচুগাছের চারাও প্রদান করেন। আমাদের এলাকায় সম্পূর্ণ নতুন এই সবজি। আগ্রহ নিয়ে তারা চাষ করেন। ফলনও হয় প্রচুর। একসময় তারা স্থানীয় বাজারগুলোতে সরবরাহ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন। কারণ, তাদের উৎপাদিত লতি বাজারের চাহিদার কয়েকগুণ। কিন্তু তাদের পক্ষে সেই লতি শহরে সরবরাহ করার সুযোগ ছিল না। বিপাকে পড়ে যান কৃষক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তাদের বাজারজাত করার খরচ সম্পর্কে। একজন চাষি জানালেন, একজন কৃষি শ্রমিক দৈনিক ১ মণের বেশি লতি কাটতে পারেন না। ওই শ্রমিকের মজুরি দিতে হয়েছে ৪০০ টাকা। বাজারে নিয়ে যেতে ভ্যান ভাড়া দিতে হয়েছে ১০০ টাকা। কিন্তু বাজারে গিয়ে তারা দাম ১০ টাকা কেজিও পাচ্ছিলেন না। ফলে লতির বাম্পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাম্পার লোকসানও হয়ে যায়। এক মণ লতি তোলার জন্য যে খরচ তাও তারা ঘরে আনতে পারছিলেন না।

এ বছর আর তারা লতির চাষ করেননি। এটা একটা উদাহরণ। নতুন পদ্ধতি কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে কৃষিপণ্যের বিপণনের দিকেও নজর দিতে হবে। ওই সময়ই স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, জেলা পর্যায়ে কৃষি বিপণনের একটি দফতর আছে। যেখানে জনবল মাত্র ২ জন। হয়তো কৃষি বিপণনে এমন পরিস্থিতি হয়নি, যে কারণে তাদের শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। বিষয়গুলো গুরুত্বসহ এখন ভাবতে হবে।

সম্প্রতি গ্রামে গিয়ে দেখলাম, রাস্তার পাশে এবং বিভিন্ন বাড়িতে এত বেশি কাঁঠাল গাছ নতুনভাবে ফল দেওয়া শুরু করেছে, যা রীতিমতো অবাক করার মতো। গত বছর আমার বাগানের কাঁঠাল বিক্রি করতে পারিনি খুবই কম মূল্য হওয়ায়। মনে হয় এবারও একই অবস্থা হবে। নতুন অনেক কিছুই আসছে কিন্তু বিপণন ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। গ্রামের কৃষকদের পক্ষে শহরে নিয়ে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করা সম্ভব নয়। যেমনি এই মুহূর্তে তারা গরুর দুধ নিয়ে বিপাকে পড়ে আছে। ৯০০ টাকা বস্তার ভুসি এখন এক বছরে দাম বেড়ে হয়েছে ২২০০ টাকা। কিন্তু তাদের দুধ বিক্রি করতে হয় ৫০ টাকা লিটার। এতে তাদের উৎপাদন ব্যয় মিটানো সম্ভব হচ্ছে না। অথচ এই দুধ শহরে বিক্রি করতে পারলে তারা লোকসান পুষিয়ে নিতে পারতেন।

তাই শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি করলেই হবে না। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে উৎপাদনকারী দুটো পয়সা যেন পায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। না হলে সেই লতি চাষের মতো অবস্থা হবে। কৃষি উৎপাদনের ফল ঘরে আনতে হলে সামগ্রিক বিষয়গুলোকে নিয়েও ভাবতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও শিশুসাহিত্যিক।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শ্রমিক লীগের জনসভা শুরু
শ্রমিক লীগের জনসভা শুরু
ভারতের জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আ.লীগকে আমন্ত্রণ বিজেপির
ভারতের জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আ.লীগকে আমন্ত্রণ বিজেপির
আনসার আল ইসলামের সদস্য গ্রেফতার
আনসার আল ইসলামের সদস্য গ্রেফতার
ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় সদর দফতরে হামলার দাবি রাশিয়ার
ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় সদর দফতরে হামলার দাবি রাশিয়ার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ