আলোচিত ইউটিউবার হিরো আলম প্রসঙ্গে অনেক দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা কথা দেখা যাচ্ছে। হিরো আলম যেহেতু কম পড়ালেখা জানা এবং কিছুটা ‘বোকাসোকা’ লোক, অতএব তিনি এমপি হলে কম দুর্নীতি করবেন। লুটপাট করে বিদেশে টাকা পাচার করবেন না ইত্যাদি।
এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। আপনি আপনার আশপাশে তাকিয়ে দেখুন, অসংখ্য অশিক্ষিত বা কম পড়ালেখা জানা লোকও দুর্নীতির জাহাজ। আবার অসংখ্য শিক্ষিত মানুষ আছেন যারা জীবনে দুই টাকার দুর্নীতিও করেননি। এরকম মানুষ রাজনীতি, প্রশাসন, গণমাধ্যম সর্বত্র আছেন।
এই সময়ের বাংলাদেশে জীবিতদের মধ্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষদের একটি তালিকা করা হলে সেখানে আশা করি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নাম আসবে। তিনি অত্যন্ত শিক্ষিত একজন মানুষ। আমরা তাঁকে একজন আপাদমস্তক সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত মানুষ হিসেবেই চিনি। এমনকি এই বিশ্বাসও আমাদের (অন্তত আমার) আছে যে স্যারকে যদি অবারিত সুযোগ ও দায়মুক্তির নির্ভয় দেওয়া হয়, তারপরও তিনি কোনও ধরনের দুর্নীতি করে অবৈধ পথে টাকা কামানোর সুযোগ গ্রহণ করবেন না। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নামটি লিখছি কারণ ২৩ জুন তিনি ৮৮ বছরে পা দিচ্ছেন। স্যারকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
আমাদের আশপাশে তাকালে কম পড়ালেখা করা এমনকি কলেজের চৌকাঠ না মাড়ানো অনেক লোককে দেখতে পাবো, যারা শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন, করছেন। শিক্ষিত হলেও তারা একই কাজ করতেন। সুতরাং কম শিক্ষিত মানেই কম দুর্নীতিগ্রস্ত, আর বেশি শিক্ষিত মানে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত—বিষয়টা এত সরল নয়।
বর্তমান জাতীয় সংসদে যে সাড়ে তিনশ’ এমপি আছেন, সারা দেশে যত সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, জেলা পরিষদ ও উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আছেন—সেখানে প্রচুর শিক্ষিত মানুষ যেমন আছেন, তেমনি কম পড়ালেখা জানা এমনকি মাধ্যমিকের গণ্ডি না পেরোনো জনপ্রতিনিধিও আছেন। তার অর্থ কি এই যে যারা কম পড়ালেখা জানা জনপ্রতিনিধি তারা শিক্ষিত জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত? আবার শিক্ষিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কি দুর্নীতিবাজ নেই? বিষয়টা সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়। বরং কে কীভাবে বেড়ে উঠেছেন, কার মূল্যবোধ নৈতিকতার ভিত কত শক্ত—তার ওপর নির্ভর করে তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত হবেন কি হবেন না।
আমাদের মধ্যে একটা খুব সাধারণ ধারণা প্রচলিত আছে, গ্রামের মানুষ খুব সহজ সরল আর নাগরিক বা শহুরে মানুষ অনেক বেশি জটিল ও স্বার্থপর। এটিও সবসময় সঠিক নয়।
বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে আমাদের একজন প্রিয় শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পরে পেনশনের টাকা দিয়ে কলেজেরই পেছনে একটি জায়গা কিনে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করতে শুরু করলেন। স্যারের পৈতৃক বাড়ি বরিশালের পার্শ্ববর্তী একটি জেলায়। ওই এলাকায় তাদের পরিবারটি বেশ সম্ভ্রান্ত হিসেবে পরিচিত। সেখানে তাদের বিপুল জায়গা-জমিও আছে। স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কেন অবসরের পরে গ্রামের বাড়িতে নিজের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে না থেকে বরিশাল শহরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন? স্যার বললেন, ‘গ্রামের মানুষ সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণা নেই।’
এই একটি বাক্যে বুঝে নিয়েছি স্যার কী বলছেন। সুতরাং গ্রাম মানেই একটা সহজ সরল জায়গা—বিষয়টা এতটা সরল নয়। আবার নগর ও শহরে বসবাসকারী মানুষের মধ্য প্রচুর মানবিক ও পরোপকারী মানুষের দেখা পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি লেখক খান রবিউল আলম একটি জাতীয় দৈনিকে রাজধানীর নবোদয় কাঁচাবাজারের দুজন অতি সাধারণ ব্যবসায়ীর যে মানবিকতার গল্প লিখেছেন, সেটি যেকোনও সংবেদনশীল মানুষের চোখে জল এনে দেবে। অথচ ওই দুই সাধারণ মানুষ পুরোদস্তুর শহরবাসী। পক্ষান্তরে গ্রামের অনেক জটিল ও কুটিল ব্যবসায়ীর কথাও আমরা জানি। সুতরাং স্থান বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর সবসময় মানুষের নীতি-নৈতিকতা নির্ভর নাও করতে পারে। সবসময় মানুষের খুব কমন পারসেপশন বা সাধারণ ধারণা সঠিক নাও হতে পারে। এটা পুরোপুরি নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর। যিনি সৎ তিনি পুলিশ অফিসার হলেও সৎ থাকবেন। যিনি অসৎ তিনি মসজিদের ইমাম হলেও কোনও না কোনোভাবে দুই নম্বরি করবেন। কিন্তু দুর্নীতি করার অবারিত সুযোগ পাওয়ার পরেও যিনি দুর্নীতি করলেন না, তিনিই প্রকৃত সৎ। তাতে তার পড়ালেখা যা-ই হোক। তার অবস্থান গ্রাম বা শহর যেখানেই হোক।
তবে এটা অস্বীকার করার উপায় যে নেই দুর্নীতি আমাদের মজ্জাগত। দুর্নীতির এতটাই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়ে গেছে যে এখন কোনও সরকারি কর্মকর্তা ঘুষ না খেয়ে আন্তরিকভাবে নাগরিককে সেবা দিলে সেটিই বড় খবর। কোনও কর্মকর্তা প্রতিদিন সঠিক সময়ে তার অফিসে আসেন এবং হাসিমুখে মানুষকে সার্ভিস দেন, এটিই সংবাদ শিরোনাম। অথচ এটিই তার কাজ। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে এখন যে কর্মকর্তারা ঘুষ নেন না, তারা সংখ্যালঘু। তাদের পরিচয় তারা বোকা, তারা দুর্বল।
বস্তুত অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির ডালপালা এতটা বিস্তৃত হয়েছে যে এখন ওই স্বাভাবিক কাজকর্মগুলোও মানুষের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। ঘুষ না খাওয়াটাই এখন অস্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আবার শিক্ষিত লোকদের অনেকেই কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি লুটপাট করে বিদেশে পাচার করেন বলে মানুষের মনে এই ধারণাও তৈরি হয়েছে যে কম শিক্ষিত লোকেরা বোধহয় এসব দুর্নীতির ফাঁকফোকর জানেন না, ফলে তারা দায়িত্বশীল পদে গেলে এই ধরনের দুর্নীতি কমে আসবে। এটি আসলে একটি পারসেপশন। বাস্তবতা হলো, যিনি দুর্নীতি করতে চান বা দুর্নীতির সুযোগ খোঁজেন, তিনি শিক্ষিত হোন আর অশিক্ষিত—তিনি পথ বের করে ফেলেন।
এ বছর জানুয়ারির শেষদিকে প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০২২ শীর্ষক প্রতিবেদনে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। আগের বছর ছিল ১৩। অর্থাৎ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের আরও একধাপ অবনমন হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, একটা সময় বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নও হতো।
শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত দেশ পৃথিবীতে আছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু দুর্নীতি সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা সম্ভব হয় যদি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে। বলা হয়, যেসব কারণে বাংলাদেশে দুর্নীতির সূচকে উন্নতি করতে পারছে না, তার মধ্যে রয়েছে সরকার ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগের প্রয়োগ ও চর্চার ঘাটতি। সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে জবাবদিহির ঘাটতিও এর একটি বড় কারণ।
যদিও বাংলাদেশে দুর্নীতির চিত্র কেমন—সেটি বোঝার জন্য টিআইয়ের সূচকের দিকে তাকানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ, দেশের প্রতিটি খাতে, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে এবং দুর্নীতি নিয়ে সাধারণ মানুষ এমনকি রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও যে ধারণা পোষণ করেন; যে ধরনের কথাবার্তা বলেন—সেদিকে খেয়াল করলেই বোঝা যায়। টিআইয়ের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হলো, নাকি অবস্থান ১২ কিংবা ১৩—সেটিও খুব বড় বিষয় নয়।
সরকারের তরফে বরাবরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীল নীতির কথা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কোথাও যে দুর্নীতি কমেছে বা বন্ধ হয়েছে, সেটি দৃশ্যমান নয়। কোনও একটি প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত করা গেছে, এমন কথা সরকারও সম্ভবত জোর গলায় বলতে পারবে না। সুতরাং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা কী; তিনি গ্রামে নাকি শহরে বসবাস করেন, তার চেয়ে বড় কথা সাধারণ মানুষ কীভাবে দুর্নীতির ভিকটিম হচ্ছে এবং সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনবান্ধব ও দুর্নীতিমুক্ত করতে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে কিনা?
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।