X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

ট্যাক্স রিটার্ন প্রস্তুতকারী বিধিমালা ২০২৩ যে কারণে বাতিল করা জরুরি

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন
২৫ জুন ২০২৩, ১৫:৫৯আপডেট : ২৫ জুন ২০২৩, ১৫:৫৯

রাজস্ব, এনবিআর, কর-আইনজীবী শব্দগুলো অনেক পুরোনো। গল্প করা শুরু করলে কয়েকটি চাঁদনি রাত চলে যাবে ঠিকই, কিন্তু গল্প শেষ হবে কিনা, অজানা। এই শব্দগুলোর মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর ও পুরোনো। শুধু সম্পর্কই নয়, আত্মার সম্পর্ক। একটা আরেকটার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে আছে, যেন মুদ্রার এপিঠ ও পিঠ। বাস্তবিক অর্থে এই সম্পর্কটা এমন যেন কোনোটাই একা চলতে পারে না, একা চলতে গেলেই রাজস্ব নীতি বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ার অবস্থা।

রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে রাজস্ব কর্মকর্তাদের ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে কর-আইনজীবীদের কঠোর পরিশ্রম ও পেশাগত সম্পৃক্ততা। এই ব্যবস্থাপনাটা শুধু যে আমাদের দেশে বিরাজমান তা কিন্তু নয়। দেশের রাজস্ব আহরণের গতি বৃদ্ধি ও করদাতাদের আইনি সুরক্ষার জন্য প্রত্যেক উন্নত, স্বপ্লোন্নত দেশেই কর আইনজীবী রয়েছে, হয়তো পেশাগত নাম আলাদা হতে পারে। এই বিষয়ে বিশ্বের উন্নত দেশের মধ্যে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা উল্লেখ করার মতো উদাহরণ রয়েছে যুগ যুগ থেকে। আমেরিকায় একটি স্বাধীন ট্যাক্স ফাউন্ডেশন রয়েছে। যারা সাপ্তাহিক বুলেটিনের মাধ্যমে ট্যাক্স ব্যবস্থাপনার নানান দিকনির্দেশনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে, যার ফলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজ দেশের নাগরিক সমাজ, রাজস্ব বিভাগ ও করদাতা ও কর আইনজীবী সংশ্লিষ্ট সবার জন্য রাজস্ব জ্ঞানের পরিধির বিকাশ ঘটছে এবং একটা জবাবদিহির পরিবেশ বিরাজমান থাকছে।

আমরা উন্নত দেশের দিকে এগোচ্ছি। আমাদের ভিশনকে অর্জন করতে গেলে এগোতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। আমাদের বিপুল মানবসম্পদ আছে; কিন্তু সম্পদকে উপযুক্ত স্থানে ব্যবহার করতে পারছি না। কারণ, দক্ষতার যেমন ঘাটতি আছে, তেমনি আছে দেশপ্রেমের ঘাটতি। যখন যাকে যে দায়িত্ব প্রদান করা হয়, তখনই আমরা চেষ্টা করি নিজের আখের গোছাতে। এই মানসিকতাই আমাদের উৎসাহিত করছে, নিজের দেশের টাকা বিদেশে পাচার করতে, বিদেশে সেকেন্ড হোম তৈরি করতে, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে গুডবাই দিয়ে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা বিদেশে নিজের সন্তানকে পড়াশোনা করাতে, নিজের দায়িত্ব পালন না করে অন্যের দোষ দিয়ে যেনতেনভাবে সময়টাকে পার করতে। এই যখন আমরা বাস্তবতার মুখোমুখি,  তাই যেকোনও উদ্যোগ নিতে গেলে ব্যাপক গবেষণা দরকার বা দরকার প্রয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। তবে এই মুহূর্তে বুদ্ধিমানের কাজ হবে নতুন কিছু না করে পুরাতন ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করে কাজে লাগানো এবং ধীরে ধীরে নতুনের পথে অগ্রসর হওয়া।

বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা যেখানে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, ব্যবসা- বাণিজ্য যেখানে প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হচ্ছে নানাবিধ কঠিন বাস্তবতার। সার্বিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। যার কারণে রাষ্ট্রের জন্য রাজস্ব আয় বৃদ্ধির কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু রাজস্ব বৃদ্ধির কৌশলটা অর্জন করতে আমরা বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি। তা কাম্য নয়। আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত রাজস্ব বিভাগ পরিচালনার জন্য রয়েছে একদল দক্ষ কর্মকর্তা। তবু কেন যেন আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছি না। বরং লক্ষ্যমাত্রার অর্জন দূরে থাকুক, ঘাটতির গ্লানি দিন দিন ঘাড়ে উঠছে। বিষয়টি গুরুতর। খতিয়ে দেখাও জরুরি।

এই কঠিন পরিস্থিতিতে রাজস্ব বিভাগকে কোনও অনৈতিক চাপের কাছে মাথা নত না করে বাস্তবতার আলোকে এগোতে হবে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কিছু কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় তারা বাস্তবতা থেকে সরে যাচ্ছে। এর জন্য সরকার ও দেশের রাজস্ব কাঠামো হুমকির মুখোমুখি হবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। আমরা যারা ট্যাক্স দেই এবং যারা ট্যাক্স আদায়ে জড়িত তারা গর্বের সঙ্গে বলি আমাদের একটা রাজস্ব ভবন তৈরি হয়েছে। সব করদাতার গর্ব ঢাকার আগারগাঁওতে অবস্থিত এই রাজস্ব ভবন। কিন্তু করদাতারা হতাশ হয়েছে রাজস্ব ভবনের কর্মকর্তাদের আচরণ দেখে! তারা করদাতাদের রাজস্ব ভবনে অবাধে প্রবেশ করার পথ বন্ধ করে দিলেন!

প্রয়োজন ছাড়া কোনও লোক রাজস্ব ভবনে যায় না। যারা যান, তাদের মধ্যে কেউ নতুবা করদাতার সহায়তাকারী। এই দুই শ্রেণির মানুষ ছাড়া অন্য কোনও সাধারণ মানুষ রাজস্ব ভবন/এনবিআর ভবনে যায় না বা যাওয়ার প্রয়োজনও নেই। এমনিতেই কর অফিসের কথা শুনলে মানুষ রাস্তা মাপার চেষ্টা করে। এই জন্য দায়ী আমরাই। আমরা করদাতাদের সম্মান দিতে পারি না বলেই করদাতারা অফিসে আসেন না, অফিসকে এড়িয়ে চলেন। এই যখন পরিস্থিতি তখন এনবিআর দুটো কাজের উদ্যোগ নিলেন। যেমন–

১. বর্তমানে এনবিআরের আগারগাঁও অফিসের কর্মকর্তারা ডজন খানেক গার্ড ও কর্মচারী ব্যবহার করে ভবনের প্রবেশ গেটে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলেন। প্রবেশ করামাত্রই করদাতাদের নানা প্রশ্নে জর্জরিত করেন। তারপর অনুমতি প্রদান করেন। তাদের আচরণ দেখলে মনে হয় কোনও রাজার দরবারে দয়া ভিক্ষার জন্য করদাতারা এসেছেন। এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই নিন্দনীয় এবং তা প্রত্যাহার করার দাবি রাখলাম।

২. এনবিআর ওয়েবসাইটে একটি বিবিধমালা প্রকাশ করলো গেলো মে মাসে (এস.আর.ও নং ১৬৮/আইন/আয়কর/২০২৩, ২৩ মে ২০২৩ খ্রি.)। এই বিধিমালা মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো আয়কর রিটার্ন প্রস্তুত করার জন্য লাইসেন্স গ্রহণ করতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের করদাতার রিটার্ন প্রস্তুত করা ও জমা দেওয়ার লাইসেন্স দেওয়া হবে। একই সঙ্গে এই বিধিমালার মাধ্যমে কতিপয় ফার্মকে দায়িত্ব দেওয়া হবে লাইসেন্সধারীদের তদারকি করার জন্য। এই লাইসেন্সধারী ও তদারকি ফার্ম নির্দিষ্ট হারে কমিশন পাবেন। এই বিধিমালা কার্যকর হলে দেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অনিয়ম রাজস্ব বোর্ডের সব স্তরে বিরাজ করবে। যা ঠেকানো রাজস্ব বোর্ড তো দূরের কথা সরকারের পক্ষেও সম্ভব হবে না। কোনও একদল অসাধু ফার্ম বা দালালের পরামর্শে পড়ে রাজস্ব বোর্ড এত বড় ক্ষতিকর কাজে কী কারণে মনোযোগ দিলো তা বোধগম্য নয়। এই বিধিমালা বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ করছে এবং বিশিষ্ট আইনজীবী সংগঠনগুলো প্রতিবাদ করে আসছে।

যে কারণে এই বিধিমালাটি বাতিল করা জরুরি:

–  প্রস্তাবিত বিধিমালাতে ট্যাক্স রিটার্ন প্রস্তুতকারী (টিআরপি) সনদ প্রদান করা হলে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ধারা ১৭৪(২)-এফ-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে এবং একই ধারায় কর-আইনজীবী নিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে;

–  একশ্রেণির অসাধু লোকের উদ্ভব হবে যারা টিআরপি সনদধারীদের এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করবে এবং করদাতারা নানাভাবে হয়রানি করবে;

–  করদাতাদের মাঝে করভীতি আরও বাড়বে এবং নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে;

– কতিপয় ফার্ম তৈরি হবে, যারা অসাধুভাবে রিটার্ন প্রস্তুতির উদ্যোগ নেবে এবং কমিশন নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগবে। ফলে সরকারের রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি পাবে;

–  কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ফার্মের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করবে এবং সাধারণভাবে জমাকৃত রিটার্নও ফার্মের মাধ্যমে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করে কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়বে; ফলে সরকারের ব্যাপক রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে;  

– স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এনবিআরের পক্ষে কঠিন হবে; ফলে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে;

– টিআরপি ও কর-আইনজীবীদের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব তৈরি হবে; ফলে অনেক কর আইনজীবী পেশায় বিব্রতবোধ করবেন;

– সার্বিক দিক বিবেচনায় দেখা যায় যে, এই বিধিমালাটি অতিদ্রুত বাতিল করা জরুরি।

–  প্রস্তাবিত বিধিমালার বিকল্প হিসেবে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:

– কর-আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণ ও পেশাগত আচরণ বিধি পরিপালন করার জন্য ট্যাক্স কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা যেতে পারে;

– কর-আইনজীবীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান;

– কর-আইনজীবীদের নতুন করদাতা তৈরি ও কর আদায়ের জন্য কমিশন প্রদান করা যেতে পারে;

– সরাসরি করদাতা বৃদ্ধিতে কর আইনজীবীদের সম্পৃক্ত করা হলে বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক হারে করদাতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে;

– কর-আইনজীবীদের বিভিন্ন অঞ্চল ও এলাকায় ভাগ করে করদাতার সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে;

– সনদ প্রাপ্তদের আবশ্যিকভাবে পেশায় নিয়োজিত থাকার শর্ত দেওয়া; নতুবা সনদ বাতিল করার শর্ত দেওয়া; একইভাবে ইতোপূর্বে যারা সনদ নিয়েছেন; কিন্তু পেশায় নেই, তাদের সনদ বাতিল করা।

– জেলা/উপজেলাভিত্তিক ট্যাক্স বার করা এবং আইনজীবীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা;

– উপজেলা/জেলা পর্যায়ে কমপক্ষে ৫/১০ জন আইনজীবীর সনদ প্রদানের ব্যবস্থা করা;

এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই এনবিআর রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হবে।

লেখক: আয়কর আইনজীবী

[email protected]

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ