X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

চারপাশে যা চলছে তা সবই ‘স্বাভাবিক'!

স্বদেশ রায়
১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬:৫৩আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬:৫৩

সম্প্রতি একটি চলচ্চিত্রে  সুরকার এর আর রহমান কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান ‘কারার ওই লৌহ কপাটে'র সুর পরিবর্তন করেছেন। তার সুরারোপের ফলে যে গান হয়েছে, তাতে আধুনিক যন্ত্রের অনেক স্পন্দন আছে। সংগীতও একটি হয়েছে। কিন্তু নজরুলের সেই কারার ওই লৌহ কপাট গানটিকে তার ভেতর খুঁজে পাওয়া যায়নি। নজরুলের সুর যেমন ওই শব্দের প্রতিটি বর্ণে বর্ণে প্রাণের স্পন্দন জাগিয়ে দেয়, যা চিরকালের যেকোনও লৌহ কপাট ভেঙে ফেলার স্পন্দন। আর এ স্পন্দন একজন মানুষ যখন সত্যি অর্থে মানুষ হয়ে ওঠে তখনই তার বুকে জন্মায়; আমাদের এই ভারত উপমহাদেশে ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের বাইরে হাজার হাজার বছরে যে ক'জন মানুষ জন্মেছেন নজরুল তাদের একজন। যিনি কখনও বলেননি আমি অমুক ধর্মের, অমুক গোত্রের বা অমুক বর্ণের। তিনি নিজেকে সবসময়ই মানুষ হিসেবে জানতেন। আর লৌহ কপাট আসে মানুষের জন্যে- কোনও ধর্ম, বর্ণ বা গোত্রের জন্যে নয়- কারণ, তারা তো অন্য আরেকটি বিধি'র বা সমাজের কপাটে বাস করতে অভ্যস্ত- তাদের কাছে রাষ্ট্রীয় কপাট খুব বড় কিছু নয়। তাই নজরুলের জীবনবোধ থেকে যে লৌহ কপাট ভাঙার সুর জন্মাবে- অন্য সাধারণ কারও কাছে তা আশা করার কোনও কারণ নেই এবং তাদের পক্ষে এটা সম্ভবও নয়।

এ আর রহমান এর আগে আরও দুটো গানের সুর বদলেছেন। তা নিয়ে আমি অন্তত কারও কোনও প্রতিবাদ করতে শুনিনি বা দেখেনি। একটি বঙ্কিমের লেখা ‘বন্দে মাতরম', অপরটি রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণ মন অধিনায়ক'। এবং এ প্রতিবাদ না করায়ও আশ্চর্য হবার কোনও কারণ নেই। কারণ বন্দে মাতরম গানটি তৎকালীন ভারতবাসী আজকের ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোর মানুষকে একটি নতুন ধর্ম দিয়েছিল। সে ধর্ম হলো মাতৃভূমিকে বন্দনা করা। মাতৃভূমিকে মায়ের স্থানে প্রতিস্থাপন করা। হয়তো এ ধারা আরও বাড়তো। কিন্তু ক্ষমতালোভী, চতুর রাজনীতিকদের প্রতারণার কাছে যখন দেশ উদ্ধার বা দেশের মানুষের মুক্তি'র চাহিদা বন্দি হয়ে গেলো, তখন ধীরে ধীরে দেশের মানুষের কিছু অংশের প্রাণে যে মানবসত্তা জেগে উঠেছিল, তার মৃত্যু ঘটতে শুরু করে। আর যেসব তরুণ প্রাণ তাদের হৃদয়ে মায়ের স্থানের পাশাপাশি দেশমাতাকে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন তাদের সহজে কপাটে পুরতে পারে মানুষের শত্রুরা। আর শুধু বিদেশি নয়, দেশের ভেতরই রাজনীতিকের নামে যখন মানুষের শত্রু বেড়ে উঠছে সেই সময়েই কিন্তু এ কপাট ভাঙার গান লেখা ও সুর দেওয়া মানুষ নজরুলের।

এই বন্দে মাতরমে‌র পরে ও নজরুলের কপাট ভাঙা গান লেখার আগে এই ভারত উপমহাদেশে জন্মানো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ মানুষ রবীন্দ্রনাথ ‘জনগণ মন অধিনায়ক' গানটি লিখেছিলেন। গানটি তাঁকে লিখতে বলা হয়েছিল ব্রিটিশের সম্রাট পঞ্চম জর্জের ভারত আগমন উপলক্ষে । সারা রাত বসে তিনি গানটি লিখে সকালে  যা বলেছিলেন তা ছিল এমনই– যে গান লিখতে বলা হয়েছিল তা হলো না। গান হয়ে গেলো ভারতবর্ষ ও তার মানুষের উদ্দেশ্য এক নিবেদন।

অর্থাৎ বন্দে মাতরম, জনগণ মন অধিনায়ক ও কারার ওই লৌহ কপাট তিনটি গানই মানুষের জন্যে লেখা ও মানুষের জন্যে সুরারোপ করা। আর যখন এই মানুষের মৃত্যু ঘটে যায়, মানুষের স্থানে ধর্ম ও বর্ণ বা বর্ণের নামে পরিচালিত গোষ্ঠী স্থান নেয় সে সময়ে এসব গানের সুর বদলে গেলে বা এর সুর থেকে মানুষের হৃদয়ের প্রাণ স্পন্দন চলে গেলে কোনও প্রতিবাদ বা বেশিরভাগেরই বুকে প্রকৃত কোনও ব্যথা বা অপরাধ বোধ জাগে না। আর এই ভারত উপমহাদেশে উনবিংশ শতাব্দী থেকে নতুন করে ধীরে ধীরে মানুষের ভেতর যে মানবসত্তার উদ্ভব ঘটতে শুরু করেছিল তার মৃত্যু ঘটতে শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের শুরুতে। আর এই মৃত্যু যে ঘটে চলেছে এ সত্যটি প্রকাশ করেছিলেন সে সময়ে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনিও পরে রাষ্ট্র ক্ষমতা লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা হয়েছিলেন। সে অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে এই পাকিস্তান আন্দোলনে আসার আগে মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর ধর্মীয় রাজনীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি কংগ্রেস শুধু নয়, রাজনীতি ত্যাগ করে বিলেতে চলে যান। তার বিলেতের বন্ধুবান্ধবরা তার ওই বিলেতে চলে আসা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ভারতবর্ষে এখন শুধু হিন্দু আর মুসলমান আছে। সেখানে কোনও মানুষ নেই।

বাস্তবে তার কথা যে সত্য ছিল তার প্রমাণ পরবর্তীতে চল্লিশের দশকে শুধু ভারতবর্ষ নয়, গোটা পৃথিবী দেখেছে। বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে ধর্মের নামে যে ব্যাপক নরহত্যা ও নারী ধর্ষণ হয়েছে– ধর্মের নামে এত বড় নরহত্যা ও নারী ধর্ষণ তার আগের কয়েক শতকে দেখা যায় না। আর ওই নরহত্যার ভেতর দিয়ে শেষ হয়ে যায় বঙ্কিমের দেশমাতা, রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষ আর নজরুলের রাষ্ট্র নামক যন্ত্রের লৌহ কপাট ভাঙার প্রাণের উচ্চারণ। তার বদলে সৃষ্টি হয় ধর্মের নামে দেশ। আর ধর্মের শৃঙ্খল অদৃশ্য হলেও বিদেশি শৃঙ্খলের চেয়ে অনেক কঠিন। দৃশ্যমান শৃঙ্খল যত সহজে ভাঙা যায় অদৃশ্য শৃঙ্খল ভাঙা তার থেকে সহস্র গুণ কঠিন। কারণ, মানুষ যখন মনুষ্যত্বের চেয়ে ধর্মকে বড় করে দেখে তখন তার প্রাণের শক্তি খণ্ডিত হয়ে যায়। খণ্ডিত শক্তি মূলত খণ্ডিত তরবারির মতোই- তার ধারালো অংশ মাটিতে পড়ে থাকে। হাতে থাকে শুধু ভোঁতা অংশ।

যাদের কারণে বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে ভারতজুড়ে নরহত্যা ও নারী ধর্ষণ হয়েছিল ও  যাদের নেতৃত্বে এই ধর্মের নামে দেশ সৃষ্টি হয়েছিল, সেসব নেতা ও কর্মীর অনেকেরই আত্মজীবনী বা নানান ধরনের আত্মকথন ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে– তার যতটি পড়েছি সেখানে দুই লাইনের মাঝখানে পাওয়া যায় তারা সবাই তিরিশের দশকের শেষের ধর্মে কাছে কমবেশি আত্মসমর্পণ করেছিলেন।

তাই সেটা রাষ্ট্র ক্ষমতার লোভে হতে পারে, মনুষ্যত্ববোধের অভাবে হতে পারে বা ধর্মীয় অন্ধত্ব থেকেও হতে পারে। এ নিয়ে কবে সব মৌলবাদিত্ব'র বাইরে এসে এ ভূখণ্ডে গবেষণা হবে তাও এখনও বলার সময় আসেনি। এমনকি ওই সময়ের রাজনীতি ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের চরিত্র পর্যালোচনা করলে কেন যেন মনে হয়, সুভাষ চন্দ্র বসু যে শুধু অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে ভারতবর্ষ স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন, তারও একটি বড় কারণ হতে পারে হয়তো তিনি বুঝেছিলেন, ভারতবর্ষ থেকে মনুষ্যত্ব মারা গেছে। তাই প্রাণে দেশমাতাকে জাগিয়ে  আর মানুষের দেশ সৃষ্টি সম্ভব নয়। এটা কৌশলে অস্ত্রের জোরেই করতে হবে। কিন্তু দেশের প্রাণের জোর না থাকলে অস্ত্রের জোরের যে কোনও শক্তি থাকে না তার প্রমাণ তার আজাদ হিন্দের সপক্ষে ভারতবর্ষে গণজাগরণ হয়নি বরং তার বিরোধিতা করেছিল ধর্মীয় মৌলবাদী থেকে সমাজতান্ত্রিক মৌলবাদী সবাই।

তাই স্বাভাবিকভাবে ধর্মের নামে বিভক্ত বর্তমানের এই ভূখণ্ডগুলোতে যদি কোনোদিন মনুষ্যত্ব বড় হয়, আবার মানুষকে মানুষ হয়ে ওঠার পরিবেশ সৃষ্টি হয় তখন রবীন্দ্র, নজরুলের মানুষের মুক্তির প্রাণের উচ্চারণগুলো মানুষের বোধ দিয়েই উচ্চারিত হবে। তার আগে যাই ঘটুক না কেন তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ও মেনে নেওয়া ছাড়া করার খুব কিছু নেই। যেমন শোনা যাচ্ছে সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দের ওপর খড়গ তুলছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি রবীন্দ্রনাথের গানের  ‘বাঙালি'র শব্দের স্থলে ‘বাংলা' ব্যবহার করতে চাচ্ছেন। এ নিয়ে ক্ষীণ আকারে প্রতিবাদ উঠেছে। এই প্রতিবাদে কোনও কাজ যে হবে না তা বুঝতে কারও কোনও কষ্ট হবার কথা নয়। কারণ, এ মুহূর্তে পৃথিবীর দিকে দিকে রাষ্ট্রগুলোতে যেভাবে অটোক্রেসি জেঁকে বসছে তাতে এ ধরনের অটোক্রেটদের থামানোর কেউ আছে বলে মনে হয় না। যদিও মমতা ব্যানার্জি সম্পর্কে খুব বেশি জানা নেই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন, বিধান রায়, অজয় মুখার্জি এমনকি জ্যোতি বসু সম্পর্কেও জানার যে আগ্রহ ছিল, কেন যেন মমতা ব্যানার্জি সম্পর্কে সে আগ্রহ জাগে না। হয়তো এটা নিজেরই অক্ষমতা। তবে দুর্ভাগ্যবশত তার লেখা কয়েকটি কবিতা পড়তে হয়েছে এবং সম্প্রতি একটি কিশোরী ধর্ষণ সম্পর্কে তার যে বক্তব্য এবং ভাষা প্রয়োগ শুনেছিলাম, এই দুই মিলিয়েই নিশ্চিত বলা যায়, বাঙালি এবং বাংলা'র পার্থক্য তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। বাঙালি  সংস্কৃতিজাত একটি নরগোষ্ঠীর পরিচয়। বাংলা ভূখণ্ডের ভৌগোলিক পরিচয়। ভূখণ্ডের ভৌগোলিক পরিচয় রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে প্রবহমান- রাষ্ট্র ক্ষমতার নানান পরিবর্তনের সঙ্গে তা পরিবর্তিত হবে। আর সংস্কৃতিজাত পরিচয় মানুষের হাজার হাজার বছরের কর্ম ও জীবনাচরণের নানান উপাদান সৃষ্টির ভেতর দিয়ে হয়।

সংস্কৃতিজাত এই পরিচয় বিকশিত ও পরিবর্তিত হয় বোধে, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক পরিচয় বিকশিত হয় না, শুধু পরিবর্তিত হয় রাষ্ট্র ক্ষমতার নানান সমীকরণে।

যাহোক, বর্তমানের এই সময়ে বসে রবীন্দ্রনাথের ওপর রাষ্ট্রক্ষমতার ভোটের কৌশলের এ খড়গ মেনে নিতে হবে। কারণ, এটাও তো ঠিক রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, বাঙালির মধ্যে ভুল করে দুই একজন মানুষ জন্ম নেয়। তিনিও তো সেই ভুলের শিকার। তাই বাঙালির ক্ষমতার দম্ভ যদি কখনও তার সৃষ্টিতে ক্ষমতার তরবারি চালায় সেটাকে স্বাভাবিক ধরতে হবে। বরং এখন যা সময় তাতে কেবলই বলা যায়, চারপাশে যা চলছে তা সবই ‘স্বাভাবিক'!

লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খিলগাঁওয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের মৃত্যু
খিলগাঁওয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের মৃত্যু
‘দাবদাহের মধ্যে কষ্ট হলেও মানুষ ভোট দিতে আসবে’
‘দাবদাহের মধ্যে কষ্ট হলেও মানুষ ভোট দিতে আসবে’
ইরফান খান: জীবনের মোড় ঘুরেছিল ২০০ রুপির অভাবে!
প্রয়াণ দিনে স্মরণইরফান খান: জীবনের মোড় ঘুরেছিল ২০০ রুপির অভাবে!
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ