X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

স্মার্ট উপায়ে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি

এবিএম ফরহাদ আল করিম
৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৫৭আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯:০৩

শ্রম অভিবাসন ও অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। আমাদের কৃষি ও তৈরি পোশাক খাতের পরপর এই খাতটির অবস্থান।

করোনার মহামারির সময় বিদেশে অভিবাসনের গতি কিছুটা সংকুচিত হলেও গত এক দশক ধরে গড়ে ৫-৭ লাখ কর্মী বিদেশে নানা পেশায় গেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী কর্মীও রয়েছেন। সরকারি দফতর বিএমইটির ডাটাবেজ অনুযায়ী সরকারিভাবে মাত্র ৬ হাজার ৮৭ জন কর্মী নিয়ে ১৯৭৬ সাল থেকে এই দেশ থেকে আমাদের কর্মীরা চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার উদ্যোগ শুরু করেন।

বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টির বেশি দেশে বাংলাদেশি কর্মীরা চাকরি নিয়ে গেছেন, যার সংখ্যা এখন ১ কোটি ৫৯ লাখের বেশি, যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে। অভিবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক শক্তি।


তবে ২০২৩ সালটি বাংলাদেশের শ্রম অভিবাসনের জন্য নতুন মাইলফলক হিসেবে ধরা হচ্ছে। কারণ এই বছরটিতে ইতোমধ্যে যে পরিমাণ কর্মী প্রবাসে কাজের উদ্দেশ্যে গেছেন, তা আলাদাভাবে বছর হিসেব করলে অতীতের সকল বছরের চেয়ে বেশি যা একটি নতুন রেকর্ড হতে যাচ্ছে।  

চলতি বছরের (২০২৩) নভেম্বর পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি কর্মী গেছেন যার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখী। আমাদের কর্মীরা পরিশ্রমী ও নানাবিধ সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিদেশে নিরলস শ্রমের মাধ্যমে নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন। করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক হানাহানি বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে চরম মন্দাভাব চললেও আমাদের অর্থনীতির ভিত সহজে টলাতে পারেনি, যার অন্যতম কারণ প্রবাসীদের নিয়মিত হারে পাঠানো রেমিট্যান্স। সুতরাং প্রবাসী আয় যে অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক শক্তি তা আবারও প্রমাণিত হলো। সুতরাং সঠিক পথে রেমিট্যান্স আনার আরও বেশি উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

শ্রম অভিবাসন খাতে  ডিজিটালাইজেশন ছাড়াও নতুন নতুন উদ্যোগ ও প্রণোদনা ইতোমধ্যে সরকার প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন দফতর, যেমন: বিএমইটি, প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড, বোয়েসেল ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ইত্যাদির মাধ্যমে চালু করেছে। ফলে অভিবাসন খাতটি আমাদের দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর আয়ের একটি বিকল্প ও আকর্ষণীয় খাত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আমরা জানি যে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে।

বর্তমানে নতুন করে শ্রমবাজারে যুক্ত হওয়া তরুণ চাকরি প্রার্থীর একটি অংশ এখন চাকরি নিয়ে বিদেশে গিয়ে আরও বেশি আয়ের স্বপ্ন দেখছে যাতে নিজের জীবনমান উন্নয়ন করতে পারেন। বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য ইদানীং অনেককে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে আগেভাগে প্রস্তুতি নিতে দেখা যাচ্ছে, যা ইতিবাচক একটি সংবাদ বটে।

তবে হালনাগাদ তথ্য ও সঠিক উপায়ে অর্থাৎ নিয়ম মেনে বিদেশে যাওয়ার প্রচার-প্রচারণা করলে আগ্রহী বিদেশগামীরা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি যেমন নিতে পারবেন, তেমনি প্রতারণা বা বিপদের ঝুঁকি জেনে সতর্ক হয়ে সঠিক মাধ্যমে বিদেশে যেতে উৎসাহিত হবেন। যদিও সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সহায়তায় বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন এনজিও/ সিবিও’রা আজকাল বিভিন্ন সচেতনতামূলক তথ্য প্রচার করে অভিবাসীদের সচেতন করা হচ্ছে। তবে এই প্রচার-প্রচারণা সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীরা এক হয়ে সমন্বিতভাবে করলে সফলতা আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
যদিও  বাংলাদেশ থেকে ক্রমান্বয়ে শ্রম অভিবাসনের হার বাড়ছে, এবং তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর বিদেশে কাজের আগ্রহ আগের তুলনায় বাড়ছে। তবে  বিদেশে শ্রম দিতে আগ্রহীদের একটি অংশ সঠিক উপায় ও প্রশিক্ষণ না জেনে এবং লাভক্ষতির হিসেব বিশ্লেষণ না করে বিদেশে যায়। ফলে প্রায় সময় দেখা যায় একজনকর্মী ৫-৭ বছর বিদেশে গিয়ে চাকরি শেষে আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেননি। এছাড়াও কেউবা বিদেশে যেতে গিয়ে সঠিক মাধ্যমে না যাওয়ার কারণে প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন।

অনেকে অর্জিত রেমিট্যান্সের সঠিক খাতে বিনিয়োগের উপায় জানেন না। সুতরাং বিদেশে যাওয়ার আগে চাই সঠিক মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ- যা হতে হবে সরকার নির্দেশিত বৈধ ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। এছাড়াও লাভ ক্ষতির বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ শেষে বিদেশে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

 লাভ-ক্ষতির হিসেবটি সামাজিক লাভ-ক্ষতি ও আর্থিক লাভ-ক্ষতি- এই দুই ভাগে বিভক্ত রয়েছে। একজন মানুষ যখন বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন- তখন তিনি না থাকলে তার পরিবারের দেখভাল কে করবেন ও পরিবারের সুবিধা-অসুবিধা কে দেখবেন তা বিবেচনায় আনতে হবে যা সামাজিক লাভ ক্ষতির অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নারী কর্মীদের জন্য জীবনদক্ষতা প্রশিক্ষণ ও সন্তানের দেখাশোনা কে করবেন তাও বিবেচনায় আনা জরুরি। অনেক সময় এসব ইস্যু বিবেচনায় না এনে বিদেশে গিয়ে নারীরা চাকরির চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। ফলে অভিবাসন থেকে তিনি আশানুরূপ লাভবান হতে পারেন না।

অন্যদিকে বিদেশে যেতে ভিসা ও বিমানভাড়ার খরচ ছাড়াও, থাকা খাওয়া, চিকিৎসা ও অন্যান্য খরচের বিপরীতে বিদেশে গেলে অভিবাসন শেষে আনুমানিক কত টাকা আয় হবে তার হিসেব বিশ্লেষণ আগেভাগে করে নিতে হবে। যদি দেখা যায় যে তিনি যে আয় বিদেশে গিয়ে করবেন তা দেশের অর্জিত আয়ের চেয়ে বেশি- তখন অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। সর্বোপরি সামাজিক ও আর্থিক লাভক্ষতি বিশ্লেষণ শেষে লাভবান হলে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বর্তমানে সরকার ছাড়াও বিভিন্ন এনজিও এবং প্রাইভেট সেক্টর আগ্রহী বিদেশগামীতে সচেতনতা ছাড়াও প্রি-ডিসিশন মেকিং ওরিয়েন্টেশন (প্রাক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রশিক্ষণ) করছে যেখানে আগ্রহী বিদেশগামীরা লাভ-ক্ষতির হিসেব করে বিদেশে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন। তবে এই ধরনের ওরিয়েন্টেশন সারা দেশে বিদেশ গমনেচ্ছুদের সাথে আগে ভাগে করলে লাভক্ষতির হিসেব বিশ্লেষণ করে বিদেশে যাওয়ার উদ্যোগ ত্বরান্বিত হবে।

অভিবাসনে আগ্রহীদের আরেকটি বিষয় জোর দিতে হবে- যা হলো দক্ষতা অর্জন করে বিদেশে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া। একসময় দেশে দক্ষতা অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল না, মানুষ দক্ষতার সুফলও জানতো না। এখন দক্ষতা অর্জনের ইতিবাচক দিক নিয়ে যেমন প্রচার প্রচারণা চলছে, তেমনি সরকারি বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেশের প্রায় সর্বত্র অবস্থিত। এছাড়াও নতুন সুখবর হচ্ছে ইতোমধ্যে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনেও অভিবাসনপ্রবণ উপজেলাগুলোতে টিটিসি স্থাপিত হয়েছে। ফলে অভিবাসনে আগ্রহীরা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থাপিত কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিদেশে যাওয়ার আগে চাহিদা মাফিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেদের প্রস্ততি সেরে রাখতে পারেন।

যারা বিদেশে না গিয়ে দেশে কর্মসংস্থান খুঁজছেন তারাও চাইলে দেশের চাকরি উপযোগী প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারেন। মোটকথা, দেশে বা বিদেশে কাজ খুঁজতে চাইলে তার আগে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেকে উপযুক্ত কর্মী  হিসেবে তৈরি করে নেওয়া হবে স্মার্ট সিদ্ধান্ত।

কারণ, আমরা যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি তার পূর্বশর্ত হলো প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করা আর দক্ষতার সদ্ব্যবহার করা। দক্ষ হয়ে বিদেশে গেলে যেমন ভালো বেতন পাওয়া যায়, তেমনি অভিবাসন কাল শেষে কর্মীর অর্জিত দক্ষতা দেশে ফিরে পুনরায় নিজ উপযোগী কাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ নিতে পারেন।

শ্রম অভিবাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে রি-ইন্টিগ্রেশন যা অভিবাসন চক্রের শেষ বা চূড়ান্ত ধাপ। অভিবাসন শেষে যদি একজন কর্মী তার অর্জিত রেমিট্যান্স ও দক্ষতা দেশে বিনিয়োগ করে পূর্বের চেয়ে সচ্ছল বা স্বাবলম্বী জীবনযাপন করতে পারেন- এটি হবে তার অভিবাসনের সফলতা। রি-ইন্টিগ্রেশন-এর গুরুত্ব  অনুধাবন করে সরকার ইতোমধ্যে একটি রি-ইন্টিগ্রেশন পলিসি বা  নীতিমালা তৈরি করতে যাচ্ছে, যা আশাব্যঞ্জক।

আশা করা যায়, প্রণীত এই নীতিমালা এবং অভিবাসন ইস্যুতে  নতুন নতুন উদ্যোগের ফলে শ্রম অভিবাসনের পুরো চক্রে বা মাইগ্রেশন সাইকেলে আমাদের অভিবাসী কর্মীরা সম্মান, মর্যাদা ও আর্থিকভাবে সফল হয়ে নিজের ও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন।

“প্রবাসীদের কল্যাণ, মর্যাদা-আমাদের অঙ্গীকার; স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ায় তারাও সমান অংশীদার’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে প্রথমবারের মতো সরকার ৩০ ডিসেম্বরকে জাতীয় প্রবাসী দিবস ঘোষণা করে দিবসটি উদযাপন করেছে।  

দেশের অর্থনীতিতে ডায়াসপোরা ও  প্রবাসীদের অবদানকে সম্মান জানাতে দিবসটি পালিত হবে। আমরা চাই প্রবাসীরা যেন দেশের বাইরে সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে কাজ করে তাদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখেন।  

লেখক: উন্নয়ন কর্মী

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাংকিং:  বাংলাদেশ থেকে শীর্ষে বুয়েট, বেসরকারিতে নর্থ সাউথ
টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাংকিং: বাংলাদেশ থেকে শীর্ষে বুয়েট, বেসরকারিতে নর্থ সাউথ
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
ছাঁটাই ও পলিশ বন্ধ হলে কম দামে চাল কিনতে পারবে মানুষ: খাদ্যমন্ত্রী
ছাঁটাই ও পলিশ বন্ধ হলে কম দামে চাল কিনতে পারবে মানুষ: খাদ্যমন্ত্রী
উচ্চশিক্ষা খাতকে ডিজিটালাইজেশনে আনার পরামর্শ ইউজিসির
উচ্চশিক্ষা খাতকে ডিজিটালাইজেশনে আনার পরামর্শ ইউজিসির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ