X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

‘গলার কাঁটা’ অপসারণেই মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন

মোস্তফা হোসেইন
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:৩৫আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:৩৫

১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের মাথায় চেপে বসে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এরমধ্যে রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে সে দেশের সশস্ত্র বাহিনীর লড়াইয়ে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এবারও প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে। মিয়ানমার সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর ৩ শতাধিক সদস্যের সম্প্রতি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এবং মিয়ানমারের ছোড়া মর্টারশেল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়া এবং দুজন নিহতের ঘটনার পর সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশকে নড়েচড়ে বসতে হয়েছে।

মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশে আশ্রিত তাদের সশস্ত্র ব্যক্তিদের ফিরিয়ে নিলেও সেখান থেকে বাংলাদেশে আসার পথ রুদ্ধ হয়নি। বিজিবি ও কোস্ট গার্ড তাদের প্রহরা বাড়িয়ে দেওয়ার পরও কয়েকজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।

এদিকে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে মানবিক বিপর্যয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য। বৃহৎ শক্তিগুলোও মানবতার কথা বলতে শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে বিষফোঁড়ার মতো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অনেক আগে থেকেই জেঁকে বসে আছে। ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে তাদের দেশে ফেরানোর কোনও অগ্রগতি নেই, সেখানে আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অসম্ভব ব্যাপার। সুতরাং বাংলাদেশকে অবশ্যই আগে থেকেই জোরালো ভূমিকা নিতে হবে– যাতে আর একজন রোহিঙ্গাও বাংলাদেশে প্রবেশ না করে।

যারা মানবতার কথা বলেন, তাদের উচিত মিয়ানমার জান্তাকে মানবতায় বিশ্বাসী করা, তাদের নির্যাতন বন্ধ করা। রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের, সেই সমস্যা তাদেরই সমাধান করতে হবে। মিয়ানমারের জাতিগত দাঙ্গার কারণে বাংলাদেশের ভোগান্তিতে পড়ার কোনও যুক্তি থাকতে পারে না।

এরমধ্যে বাংলাদেশের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী একটি পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতায় মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের  সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ স্থাপনের সুপারিশ করেছে। তাদের দাবি শুনলে মনে হতে পারে, রোহিঙ্গারা তাদের বিপ্লবে সফল হওয়ার পথে। তারা স্বাধীন জাতি হিসেবে যেন শিগগিরই ‍আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে।

আপাতত মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কিছু জায়গায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে এটা সত্য। কিন্তু এই জায়গাগুলো মিয়ানমার যে পুনর্দখল করবে না এর কি নিশ্চয়তা আছে?

“শান রাজ্যের শান আর্মি, তাং, ওয়া আর্মি এবং এদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ব্রাদারহুড”, এই তিন শক্তির সমঝোতায় মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাময়িক বিজয় অর্জন হয়েছে, এটা অস্বীকার করার কথা নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মিয়ানমারে ১৩৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিরাজমান। এবং তাদের দূরত্ব একটু বেশিই। এই দূরত্ব এতটাই যে যুগের পর যুগ সামরিক নির্যাতনের পরও তারা ১৩৫ থেকে ১-এ নামতে পারেনি।

এই মুহূর্তে তিনটি শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কারণে যে সাফল্য এসেছে তাকে দীর্ঘস্থায়ী বলার সময় এখনও আসেনি। কারণ এই তিন শক্তির বাইরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক গোষ্ঠী রয়েছে। যাদের একটি প্ল্যাটফর্মে পাওয়া কখনও সম্ভব কিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারে না কেউ।

যুগের পর যুগ মিয়ানমারের জাতিগত বিভেদকে দূর না করে কয়েকটি গ্রুপের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কারণেই ক্ষণস্থায়ী বিজয়কে চূড়ান্ত কিছু ভাবনার সুযোগ নেই।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদের সাময়িক পরাজয়ের পর যে বড় শক্তি নিয়ে হামলে পড়বে সেই সম্ভাবনাই বেশি। তখন কি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর পক্ষে আত্মরক্ষা সম্ভব হবে? অন্যদিকে এই মুহূর্তে মিয়ানমার সীমান্তে অন্তত ৪ লাখ রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছে দেশত্যাগের জন্য। তারা কতটা বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে তা এ থেকেই প্রমাণ হয়। বাংলাদেশকে ভাবতে হবে সম্ভাব্য মানবঢেউ কীভাবে ঠেকানো যায় সেই বিষয়ে।

যারা পরামর্শ দিচ্ছেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা উচিত, তারা কি যুগ যুগ ধরে চলা সংঘাতের কথা ভুলে গেছেন? তারা এমন কোনও আলামত কি পেয়েছেন যাতে বাংলাদেশকে স্বাধীন আরাকান রাজ্য কিংবা জান্তাবিরোধী শক্তির মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন হওয়া নিশ্চিত হয়ে গেছে?

মিয়ানমার জান্তার চোখে বিদ্রোহীরা রাষ্ট্রদ্রোহী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী। বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনও শক্তিকে কি বাংলাদেশ সমর্থন করতে পারে? সেটা কি আন্তর্জাতিক আইনে গ্রহণযোগ্য হবে? কূটনৈতিক কৌশল হিসেবেও এই চিন্তা করার কোনও যুক্তি নেই বলে মনে করি।

ভুলে যাওয়ার কথা নয়, রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে দলে দলে ঢুকতে চাইছিল, বাংলাদেশ সরকার তখন প্রথম অবস্থায় তাদের ঢুকতে দেয়নি। মনে থাকার কথা, সেই সময় দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো চিৎকার শুরু করে দিয়েছিল। নয়াপল্টন থেকে সরকারকে মুসলিম উম্মাহবিরোধী এবং মানবতাবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। বিশ্বজনমতও ছিল রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের পক্ষে। বাংলাদেশ মানবতা দেখিয়েছিল। পরিণতি কী হয়েছে, তা বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। সোজা কথায় রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের গলার কাঁটা। যেসব বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদ রোহিঙ্গাদের জন্য মায়াকান্না করছিল তাদের কাউকে এখন আর মাঠে দেখা যায় না। রোহিঙ্গা নামক ‘গলার কাঁটা’ থেকে মুক্ত না হওয়ার আগে আবার ভিন্নতর কাঁটা গলায় ঢোকানোর চেষ্টা আদৌ ইতিবাচক হওয়ার কারণ নেই।

মিয়ানমারে কতটা বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে, ওই দেশে কে জয়ী কিংবা পরাজিত হলো এটা বাংলাদেশকে চিন্তা করা থেকে বিরত থেকে গলার কাঁটা কীভাবে বের করা যায় সেই চেষ্টাই করা উচিত। সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে মিয়ানমারের কাউকে প্রবেশের পথরুদ্ধ করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ যাতে নিরাপদে থাকতে পারে সেদিকে নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করি। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা ঘামানো নয়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনেই বাংলাদেশের অধিক মনোযোগী হওয়া উচিত। এরপর যদি মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা কখনও ক্ষমতায় আসীনও হয়, তখনও বাংলাদেশকে তাদেরই প্রয়োজন হবে। সেজন্য বিদ্রোহীদের কাউকে কোলে বসানোর যুক্তি নেই। বরং মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনা করাই উত্তম।

 
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৮ ঘণ্টা শ্রম ৮ ঘণ্টা বিনোদন ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম কোথায়
৮ ঘণ্টা শ্রম ৮ ঘণ্টা বিনোদন ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম কোথায়
পাকিস্তানের বোধোদয় এবং বিএনপির ‘গোস্বা’!
পাকিস্তানের বোধোদয় এবং বিএনপির ‘গোস্বা’!
ড্র করেও যে কারণে ‘অসন্তুষ্ট’ আনচেলত্তি  
ড্র করেও যে কারণে ‘অসন্তুষ্ট’ আনচেলত্তি  
ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ: এবার নিউ ইয়র্কের সিটি কলেজে পুলিশের ধরপাকড়
ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ: এবার নিউ ইয়র্কের সিটি কলেজে পুলিশের ধরপাকড়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ