X
শনিবার, ২১ জুন ২০২৫
৭ আষাঢ় ১৪৩২

৭ মার্চ: অনুপ্রেরণার চিরন্তন শিখা

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
০৭ মার্চ ২০২৪, ১৫:৪৩আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৪, ১৮:৪২

বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসে ৭ মার্চ এক অনন্য গুরুত্বপূর্ণ দিন। বাঙালির সংগ্রাম, অধিকার আদায় ও অর্জনের ইতিহাসে ৭ মার্চ  অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, ৭ মার্চ বাঙালির জাতীয় মুক্তির পথে চূড়ান্ত সংগ্রামের সূচনার অধ্যায়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বিশাল জনসমুদ্রে বাঙালির হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির মহামন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন।

কালোত্তীর্ণ এই ভাষণ সেদিন মুক্তিকামী মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল, পথ দেখিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের– অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন করার। এটা শুধু কোনও বক্তৃতা নয়, শুধু কথামালা নয়. বরং এক অমর মহাকাব্য! যার প্রতিটি উচ্চারণে-বাক্যে রয়েছে শোষিত মানুষের আত্মত্যাগের কথা এবং মুক্তির সাহসী বার্তা। বাঙালি মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছে এবং  সেই উজ্জীবনী শক্তি নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর ইশারার অপেক্ষায় ছিল মুক্তিপাগল জাতি। সে ইশারায় বাঙালি শক্তি পেয়েছিল, বিজয় ছিনিয়ে আনার উদ্যম পেয়েছিল। সে মহাকালজয়ী অমর পঙক্তিমালাজুড়ে ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তির আহ্বান, সুকৌশলে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহ্বান। সেসময় এ ভাষণের প্রতিটি বাক্য বাংলাদেশে গণজাগরণ সৃষ্টি করে। ৭ মার্চের ভাষণ জাতির পিতার সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ, কারণ এ ভাষণ একটি জাতিকে মুক্তি এনে দিয়েছিল, স্বাধীনতা ও স্বাধীন দেশ দিয়েছিল।

২০১৩ সালে লেখক ও ইতিহাসবিদ Jacob F. Field-এর আড়াই হাজার বছরের গণজাগরণ ও উদ্দীপনামূলক বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা ‘We shall Fight on the Beaches: The Speeches That Inspired History’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ স্থান পেয়েছে। পাশাপাশি, ভাষণটি ২০১৭-এর ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে সংস্থাটির ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জাতির পিতার ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রমাণ করে জাতির পিতার এ ভাষণ মুক্তির মহান নির্দেশনা যা অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সদা জাজ্বল্যমান আলোক শিখা এবং নিপীড়িত মানুষের এক চিরন্তন শক্তি।

অনেক গবেষক, ইতিহাসবিদ জাতির পিতার এই কালজয়ী ভাষণকে যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক গণতন্ত্রের প্রবক্তা ও মহান নেতা প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালে জাতির উদ্দেশে গ্যাটিসবার্গে দেওয়া ভাষণের (গ্যাটিসবার্গ অ্যাড্রেস, ১৮৬৩) সঙ্গে তুলনা করেন, এমনকি অনেকে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ (১৯৬৩) ভাষণের সঙ্গে মিল খুঁজে পান। এ দুটি ভাষণের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। জাতির পিতার ভাষণ ছিল প্রবল চাপের মুখে শত্রুর ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে মুক্তিপাগল জাতির প্রত্যাশা পূরণের জন্য দিকনির্দেশনা সংবলিত।

অনেকে ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটেনের জনগণকে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলের ঐতিহাসিক বেতার ভাষণটির সঙ্গে মিল খুঁজে পান।

তবে চার্চিল ও বঙ্গবন্ধুর অবস্থা, পরিবেশ, প্রেক্ষাপট ছিল আলাদা। এমনকি উভয়ের শক্রকে দমন করার কৌশলও ভিন্ন, বঙ্গবন্ধু গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুকে পরাস্ত করার পন্থা নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কোনও লিখিত ভাষণ দেননি, সম্পূর্ণ নিজস্ব ভঙ্গিমায় বাঙালির মহান নেতা হিসেবে, সংগ্রাম ও আন্দোলনের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রজ্ঞা থেকে মুক্তির জয়গান সেদিন জনসমুদ্রকে উপহার দেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের কর্মকাণ্ড, মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও ত্যাগের নিখুঁত প্রতিফলন হয় এই ভাষণে। ৭ মার্চ তারিখে নিজস্ববোধ ও আত্মোপলব্ধি থেকে তিনি মুক্তিপাগল জাতিকে এক অসাধারণ জয়গান শুনিয়েছেন, যার জন্য উন্মুখ ছিল সমগ্র জাতি। এ ভাষণের পর “নিউজ উইক” বঙ্গবন্ধুকে “রাজনীতির কবি” আখ্যা দিয়েছিল। জগদ্বিখ্যাত এই ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতির ফলে এখন শুধু বাঙালির নয়, বিশ্বমানবতার জন্যও অনুপ্রেরণার এক মূল্যবান দলিল। অধিকার আদায়ে, ন্যায়-নীতি ও মানবিকতা প্রতিষ্ঠায় এবং সাম্যের ভিত্তি রচনায় এ ভাষণ শক্তি দিতে, পথ দেখাবে এবং অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেদিন অত্যন্ত কৌশলী হয়ে ভাষণটি দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি সুকৌশলে গেরিলা যুদ্ধের নির্দেশও দিয়েছিলেন। অনেকে সেদিনই স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা চেয়েছিল, সেটা দিলে তা হতো হঠকারিতা। অত্যন্ত বিচক্ষণভাবেই তিনি সেদিন উপস্থিত জনতাকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেদিন একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে তিনিসহ সমগ্র জাতিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে যেত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এতে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালাতো। সারা দেশে আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতাকামী নেতাকর্মীদের হত্যা করা হতো। কিন্তু তাঁর এই দূরদর্শিতার ফাঁদে পড়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা। 

এ ভাষণে তাঁর অসামান্য দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এমন কঠিন ও উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে সময়ে এত ভারসাম্যপূর্ণ বক্তৃতা দেওয়া শুধু বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব ছিল। কারণ তিনি জানতেন এরপর কী হবে, আর তিনি কী করবেন।

৭ মার্চের সুকৌশলী ভাষণের মধ্য বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিশ্ব জনমতের সমর্থন ও সহানুভূতি  তৈরি করতে পেরেছিলেন। এ ভাষণের মধ্য দিয়েও বহির্বিশ্ব বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার-নির্যাতন এবং বাঙালির স্বাধীনতার যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে অবগত হয়েছিল। 

তিনি যে যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং জাতিকে প্রস্তুত হতে বলেছিলেন। তার প্রমাণ হলো– তিনি বলেন, “তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমার বন্ধ করে দেবে।” তিনি জানতেন আর কোনও আলোচনা পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে হবে না।

সরাসরি না বললেও যুদ্ধের সার্বিক প্রস্তুতির জন্য তিনি বলেছেন, “প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলে এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। তারপরই বজ্র কণ্ঠে আওয়াজ উঠে, “মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। কিন্তু এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ।” তিনি যে স্বাধীনতার কথাই বলছেন তার প্রমাণ এখানেই পাওয়া যায়। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ জাতির পিতা “জয় বাংলা” বলেই ভাষণটি শেষ করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণই ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা। কারণ এরপর থেকে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলার পতাকা। এরপর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে শুরু হয় গেরিলা মুক্তিযুদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন বাজানো হতো এই ভাষণ এবং মুক্তিযোদ্ধারা সকল নির্দেশনা পালন করেছিল। জাতির পিতা বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, “সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।” কেউ আমাদের আর দাবায়ে রাখতে পারেনি। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি পায় স্বাধীনতা, স্বাধীন রাষ্ট্র ও আত্মপরিচয়।

যতদিন অধিকার আদায়ের দাবি থাকবে, যতদিন ন্যায্যতার জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন এই অনুপম ভাষণ অনুপ্রেরণা, শক্তি-সাহস হয়ে থাকবে। আজও ৭ মার্চের সম্মোহনী ভাষণের আবেদন অমলিন ও চিরপ্রেরণার উৎস। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই অমর ভাষণ নানা মাত্রায় বারবার বিশ্লেষিত হবে, পথচলার উৎসাহ-সাহস হয়ে থাকবে। ৭ মার্চের ভাষণ শুধু কালজয়ীই নয়, বহুমাত্রিকতায় পূর্ণ।

বহুগুণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এই চিরন্তন, অমর মহাকাব্য এখন বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ, যা আমাদের বোধ ও চেতনাকে সামনের সময়ে আরও শক্তিশালী করবে। ৭ মার্চের অনুপম হৃদয়স্পর্শী ভাষণ আমাদের শাশ্বত গর্ব ও অহংকার এবং অনুপ্রেরণার চিরন্তন শিখা।


তথ্যসূত্র:

১.  ৭ই মার্চের ভাষণ কেন বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ- বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ। ড. হারুন-অর-রশিদ।

 ২.  ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আলোচনা সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, ০৭ মার্চ ২০২০।

 ৩.  দৈনিক সমকাল, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক জনকণ্ঠ- ৭ মার্চ ২০২২ ও ২০২৩।

 

 

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বরগুনায় ডেঙ্গুর ভয়াবহ রূপ, আতঙ্কে রোগী-স্বজনরা
বরগুনায় ডেঙ্গুর ভয়াবহ রূপ, আতঙ্কে রোগী-স্বজনরা
টিভিতে আজকের খেলা (২১ জুন, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (২১ জুন, ২০২৫)
নির্মাণাধীন ভবনের সেপটিক ট্যাংকে পড়ে দুই শিশুর মৃত্যু
নির্মাণাধীন ভবনের সেপটিক ট্যাংকে পড়ে দুই শিশুর মৃত্যু
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস-বাস দুর্ঘটনা, নিহত ১
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস-বাস দুর্ঘটনা, নিহত ১
সর্বশেষসর্বাধিক