X
রবিবার, ০৪ মে ২০২৫
২০ বৈশাখ ১৪৩২

কেমন হলো প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন?

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
১৮ মে ২০২৪, ১৩:০৯আপডেট : ১৮ মে ২০২৪, ১৩:০৯

গত ৫ মে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলার ভোটাররা তাদের সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করেছে। নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, নির্বাচন ছিল অবাধ ও সুষ্ঠু, যদিও কাঙ্ক্ষিত ভোটার উপস্থিতি নিয়ে অনেকের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে কারণ নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী গড়ে ৩৬.১ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। তবে আশার কথা হলো প্রথম পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি, যদিও কোনও কোনও নির্বাচনি এলাকায় কোনও কোনও প্রার্থী তাদের পেশীশক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন।

এখন একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো– অতীতের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় কেন প্রথম ধাপের ১৩৯টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটারদের ভোটদানের হার তুলনামূলকভাবে কম। ভোটারদের ভোটদানের হার কম হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথম কারণ হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কেন্দ্রীয় ভাবে নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমাদের দেশে উৎসাহী ও অংশগ্রহণমূলক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ইতিহাস রয়েছে যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিত। সেই সময় উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো।

প্রার্থীদের রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়াও, স্থানীয় ক্ষমতার কাঠামো এবং স্থানীয় বিষয়গুলো নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করতো। আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি নেতারা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও বেশ কয়েকজন স্থানীয় বিএনপি নেতা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং সাতটি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন।

ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে এক ধরনের অনীহা দেখা দিয়েছিল।

দ্বিতীয় কারণ হতে পারে নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনীত না করার সরকারের সিদ্ধান্ত অর্থাৎ নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতীক ব্যবহার করা হয়নি। তাই, বিএনপি প্রার্থীদের অনুপস্থিতিতে অধিকাংশ নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তাই, নাগরিকরা হয়তো এই ভেবে তাদের ভোটদানের অধিকার প্রয়োগ করতে অনিচ্ছুক বোধ করেছে যে, ক্ষমতাসীন দলের যে কোনও একজন প্রার্থী নির্বাচনে জিতবেন। ফলে, দিনমজুররা শ্রেণির ভোটাররা হয়তো তাদের একদিনের আয়ের বিনিময়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কথা ভাবেনি। তাছাড়া বিএনপি ও তাদের সমর্থকরা হয়তো কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের আলোকে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি।

তৃতীয় কারণটি হলো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বর্তমান সাংসদ ও মন্ত্রীদের আত্মীয়দের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত। এই ধরনের সিদ্ধান্ত হয়তো এই চিন্তাভাবনা থেকে নেওয়া হয়েছে যে, সাংসদ ও মন্ত্রীরা তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে তাদের ক্ষমতার ভিত্তি শক্তিশালী করেছে। ফলে, দলের  নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্ব হয়তো নিজেদেরকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অবহেলিত বলে মনে করছে। তাই নিবেদিতপ্রাণ ও জনপ্রিয় নেতাদের জন্য উপজেলা পরিষদের প্রতিনিধি হওয়ার পথ তৈরি করতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

এই সিদ্ধান্ত আরও অনেকের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পথ প্রশস্ত করেছে। তবে, ক্ষমতাসীন দলের সাংসদদের বেশ কয়েকজন আত্মীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছে। সাংসদদের আরও কয়েকজন আত্মীয় তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনও দলীয় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আবার যারা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন, তাদের সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা বোধ করেননি। ফলে, ভোট প্রদানের হার কম ছিল।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে গত এক মাস বা তারও বেশি সময় ধরে অব্যাহত তাপপ্রবাহের প্রভাব। বৈরি আবহাওয়া কারণে জনগণ নির্দ্বিধায় নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেনি। অন্যদিকে, মাত্র চার মাস আগে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং, ভোটাররা হয়তো নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহীবোধ করেনি।

যেহেতু আমরা ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট ভোটিং পদ্ধতি অনুসরণ করি, তাই নির্বাচনের বৈধতার জন্য নির্দিষ্ট শতাংশ ভোটার উপস্থিতির প্রয়োজন হয় না। এই দৃষ্টিকোণ বিচার করলে থেকে, ৩৬.১ শতাংশ ভোটদানের হার নিয়ে ১ম পর্যায়ের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে বৈধতা দিতে কোনও সমস্যা নেই।

তবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকরণের জন্য আরও বেশি ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাছাড়া ভোটারদের কম উপস্থিতি বিরোধীদের এই দাবি করার সুযোগ তৈরি করতে পারে যে, তাদের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নাগরিকদের সমর্থন পেয়েছে, যদিও বাস্তবতা ভিন্ন। সুতরাং, ক্ষমতাসীন দলের এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।

আমরা জানি যে স্থানীয় স্তর পর্যন্ত শাসক দলের একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি রয়েছে। সুতরাং, দলের সুবিধার জন্য বৃহত্তর সংখ্যায় জনগণকে ভোটদানের অধিকার প্রয়োগ করতে অনুপ্রাণিত করার উদ্যোগ দলের স্থানীয় নেতৃত্বের নেওয়া উচিত। অবশ্য একথাও ঠিক যে স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দল বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত। তবুও দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উচিত এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যাতে নির্বাচনের পরবর্তী তিনটি পর্যায়ে ভোটারদের ভোটদানের হার বেশি হয়।

জনগণকে তাদের ভোটদানের অধিকার প্রয়োগে অনুপ্রাণিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের একটি প্রধান ভূমিকা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন অতীতেও বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় ব্যাপক ভোটার শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করত। দেশে গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে জনগণের মধ্যে ভোটদানের অধিকার প্রয়োগের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে এই কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের কথা বিবেচনা করা উচিত।

পরিশেষে, ভোটদানের হার কম হওয়া সত্ত্বেও বলা যেতে পারে যে, নির্বাচন কমিশন প্রথম পর্যায়ের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সফল হয়েছে। এই পর্যায় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগের জন্য ভোটারদের অনুপ্রাণিত করার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ভোটার, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসহ সকল পক্ষের সমর্থন প্রয়োজন। সুতরাং, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের এই বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করা উচিত।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আর্সেনালের মাঠে জিতে বোর্নমাউথের ইতিহাস
আর্সেনালের মাঠে জিতে বোর্নমাউথের ইতিহাস
আর্সেনাল ম্যাচের ১০ জনকে বেঞ্চে রেখে লিগে টানা হার পিএসজির
আর্সেনাল ম্যাচের ১০ জনকে বেঞ্চে রেখে লিগে টানা হার পিএসজির
ঢাকার দুই সিটিকে একীভূত করার যৌক্তিকতা কী
ঢাকার দুই সিটিকে একীভূত করার যৌক্তিকতা কী
চেন্নাইয়ের বিপক্ষে বেঙ্গালুরুর ২ রানের শ্বাসরুদ্ধকর জয়
চেন্নাইয়ের বিপক্ষে বেঙ্গালুরুর ২ রানের শ্বাসরুদ্ধকর জয়
সর্বশেষসর্বাধিক