X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

যতদিন রবে পদ্মা যমুনা...

ওমর শেহাব
১৫ আগস্ট ২০২৪, ০১:১৫আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১৯:৪৩

তখন মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়। কীভাবে যেন ছড়িয়ে গেলো পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলবে। মুখে মুখে এ খবর রটতে রটতে একপর্যায়ে চলে গেলো সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের কাছে। আমাদের অনেকেই তাঁর লেখা গদ্য স্কুলজীবনে পড়েছি। সত্তর পাড়ি দেওয়া মানুষটি কলম তুলে নিলেন। লিখে ফেললেন,

যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরি মেঘনা বহমান,
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান
দিকে দিকে আজ রক্তগঙ্গা
অশ্রুগঙ্গা বহমান
তবু নাহি ভয় হবে হবে জয়
জয় মুজিবুর রহমান।

এবারের ১৫ আগস্ট কেমন অদ্ভুত লাগছে। আমি যখন স্কুলে পড়ছি তখন দেশে চলছিল বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার প্রথম চেষ্টা। এখন চল্লিশ পার হবার পর দেখছি দ্বিতীয় চেষ্টা। জানি এটিও ব্যর্থ হবে আগের মতো। তারপরও দেখতে লাগছে কুৎসিত, অশ্লীল।

৩২ নম্বরে এখনও পোড়া গন্ধ! আমি জানি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সাবেক সরকার গুলি করে এতগুলো বাচ্চাকে মেরে ফেললো, সেই প্রাণগুলোর কাছে একটি বাড়ি কিছুই না। সবার আগে মানুষের জীবন। কিন্তু প্রথম মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের’ এত পার্থক্য কেন? প্রথম প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধারা তো ১৯৭১ সালে শহীদ মিনারে আগুন দেননি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এটিকে ধ্বংস করেছিল। তাহলে এবারের ‘মুক্তিযুদ্ধে’ সেটি ধ্বংস করার দরকার হলো কেন?

৩২ নম্বর শেখ হাসিনার স্মারক নয়। ৩২ নম্বর আওয়ামী লীগের প্রতীক নয়। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর হলো বাংলাদেশের প্রতীক। এই প্রতীককে এত ভয় কেন?

১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন করার জন্য শেখ হাসিনা আহ্বান জানিয়েছেন এমন একটি চিঠি চোখে পড়লো (যদিও চিঠির সূত্র নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না)। স্বীকার করছি আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ওনার গলায় যে ঔদ্ধত্য ছিল সেটি নেই। কিন্তু চিঠির কোথাও গত কয়েক সপ্তাহে নিজের ভুল, নিজের অন্যায়, নিজের আদেশে নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের গুলিতে নিহত হওয়া নিয়ে ক্ষমা চাওয়া তো অনেক দূরের কথা, অপরাধ স্বীকারেরও কোন চিহ্ন নেই! এর চেয়ে জনবিচ্ছিন্ন ও অসচেতন হওয়া কী সম্ভব?

এই ১৫ আগস্ট আমরা কীভাবে স্মরণ করবো? ফুল দেওয়ার যেহেতু জায়গা নেই, আমি চাই এবারের ১৫ আগস্ট স্মরণ করা হোক নির্মম প্রশ্নের মালা গেঁথে। কীভাবে বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া ছাত্রলীগ আপাদমস্তক একটি সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত হলো?

যে দল কয়েক দশক পর যুদ্ধাপরাধের বিচার করে আমাদের কলঙ্কমুক্ত করলো, সেই দলই বা কী করে আয়নাঘরে বিনা বিচারে মানুষকে আটকে রাখে? একসময় এই ভূখণ্ডের প্রতিটি মানুষের হৃদস্পন্দনে যে দলের নাম ছিল, কেন সেই দলটি ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না যে দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তাদের কোনও যোগাযোগ নেই?

একজন প্রধানমন্ত্রী যদি ৪০০ কোটি টাকা মেরে দেওয়ার পরও তার পিয়নকে ধরতে না পারেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রী পদে এর চেয়ে কঠিন আর যা যা দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল সেগুলো কি তিনি ঠিকমতো করতে পেরেছেন?

যে আদর্শ বঙ্গবন্ধু এ দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছিলেন সেই আদর্শ মুছে ফেলা অত সহজ হবে না। এবারের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের দেওয়া স্লোগানগুলোই তার প্রমাণ। মুছে ফেলা অত সহজ হলে বাংলাদেশের নামের পর ২.০ লাগাতে হতো না।

আমাদের তরুণদের অভিনন্দন তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারার জন্য। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি তীব্র ঘৃণা এই আন্দোলনে অনেক মত ও পথের দলকে একতাবদ্ধ করেছিল। তারা চলে যাওয়ার পর সেই বন্ধন ফিকে হয়ে উঠেছে। এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের কৃত্রিম বন্ধন আলগা হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ স্পষ্ট।

যুদ্ধাপরাধীদের দলের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া কিছু দলের ‘কৌশলগত’ যোগাযোগ ইতোমধ্যে প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। নতুন পটভূমিতে আন্দোলনকারীদের অন্তত একটি ধারা ধর্মনিরপেক্ষ উদার গণতান্ত্রিক ধারা হিসেবে এই দেশে বিকশিত হবে এই আশা বুকে নিয়ে বসে আছি। এরাই হবে ৩২ নম্বরের অঙ্গার থেকে জন্ম নেওয়া ফিনিক্স!

এবারের শোক দিবস পালনের জন্য আমাদের সরকারের প্রয়োজন নেই। যতদিন নিজের জঘন্য কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবে না ততদিন আওয়ামী লীগেরও আর দরকার নেই। এবারের শোকদিবস শুধু তাদের জন্য যারা কোনোদিন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি, যাদের হৃদয়ে খচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে লেখা আহ্বান ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা’ এবং যারা কোনোদিন এই আদর্শের নামে অন্যায় সুযোগ সুবিধা নেননি। বাকিরা দূরে থাকুক এই পবিত্র আয়োজন থেকে, পচতে থাকুক ইতিহাসের কারাগারে।

লেখক: তত্ত্বীয় কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিজ্ঞানী, আইবিএম থমাস জে. ওয়াটসন রিসার্চ সেন্টার

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাস্কের সমালোচনা করলেন গেটস, দিলেন ২০০ বিলিয়ন ডলার দানের প্রতিশ্রুতি
মাস্কের সমালোচনা করলেন গেটস, দিলেন ২০০ বিলিয়ন ডলার দানের প্রতিশ্রুতি
যমুনা থেকে বাংলামোটর জনসমুদ্রে পরিণত করার ডাক হাসনাতের
যমুনা থেকে বাংলামোটর জনসমুদ্রে পরিণত করার ডাক হাসনাতের
বিএনপি নেতার টাকা দাবির অডিও রেকর্ড ভাইরাল, ‘এডিটেড’ বলছেন অভিযুক্ত
বিএনপি নেতার টাকা দাবির অডিও রেকর্ড ভাইরাল, ‘এডিটেড’ বলছেন অভিযুক্ত
আ.লীগ নিষিদ্ধে অনেকগুলো ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম: মাহফুজ আলম 
আ.লীগ নিষিদ্ধে অনেকগুলো ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম: মাহফুজ আলম 
সর্বশেষসর্বাধিক