X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুলতান সুলেমানের জয়!

রবিউল করিম
১২ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:১২আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:১৪

রবিউল করিম ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস্ অর্গানাইজেশন (FTPO) ‘শিল্পে বাঁচি, শিল্প বাঁচাই’  স্লোগানকে সামনে রেখে গত ৩০ নভেম্বর যে ৫টি ও ৪ ডিসেম্বর ৮টি দাবি জানিয়েছিল তার প্রেক্ষিতে দুই কিস্তিতে এই আন্দোলন, বাস্তবতা ও একটি স্বপ্ন নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। ইতোমধ্যে আমরা সবাই জানি FTPO ও ATCO এর যৌথ উদ্যোগে ডাউনলোডকৃত বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেওয়া যাবে না মর্মে দাবিটি বাস্তবায়িত হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপে।
এই সফলতার পর আমরা আশা করেছিলাম, পর্যায়ক্রমে আরও সুসংবাদ। কিন্তু FTPO তার পরে দুটি বেসরকারি টেলিভিশন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে এই দাবিতে যে, ওই টেলিভিশন দুটিতে ডাব করা বিদেশি সিরিয়াল প্রচারিত হয়, কেন অন্য দাবিগুলো এর সঙ্গে যুক্ত হলো না তা নিয়ে একটা প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়। এবং তারা পরবর্তী পদক্ষেপের গ্রহণের জন্য কেন সময় নিচ্ছে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত। কেন এই শঙ্কা? এত বিপুল জনপ্রিয়, তারকা মানুষের দাবি কেন মুখ থুবড়ে পড়বে? তা নিশ্চয় আমাদের ভেবে দেখা দরকার। কিংবা সত্যিই যদি তাদের কোনও ভুলত্রুটি থাকে তবে সেগুলোকে সংশোধন করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন। আমি স্বল্প পরিসরে যা বুঝেছি তা হলো:
ক. তাদের আন্দোলনে যেসব পেশাজীবীদের তারা সংগঠিত করেছিল, তারা কখনোই তাঁদের উত্থাপিত দাবিগুলোর সঙ্গে সহমত ছিল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই বুঝেছি। বড় তিনটি সংগঠনের (পরিচালক, শিল্পী এবং প্রডিউসার) প্রত্যেকেরই অপরের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট এবং বিস্তর অভিযোগ ছিল অতীতে। পরিচালকদের অভিযোগ, প্রডিউসার অনেক বেশি লভ্যাংশ চায় শুধুমাত্র টাকা লগ্নি করেই, শিল্পীরা প্রতিমাসেই তাদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি করে, সময়মতো আসে না, সিডিউল ফাঁসায় ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার শিল্পীদের অভিযোগ, এই শিল্পের সঙ্গে কোনোরকম দায়বদ্ধতা নেই, কয়েকমাস যুক্ত থেকেই একজন নিজেকে পরিচালক ভাবে, তাদের না আছে কোনও পরিকল্পনা, না কোনও স্ক্রিপ্ট বা শটের কোথায় কাট বলতে হবে ন্যূনতম এই যোগ্যতাও নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রডিউসারদের অভিযোগ, পরিচালকরা টাকা নিয়ে খেয়ে ফেলে, পরে কোনোরকম দায়সারা একটা প্রডাকশন জমা দেয় যা মানসম্মত হয় না বিধায় অনএয়ার করাও সম্ভব হয় না। পরস্পর পরস্পরের প্রতি এইরকম মনোভাব নিয়ে নিশ্চয় কোনও আন্দোলনে সফল হওয়া সম্ভব নয়।

খ. আন্দোলনের দাবিগুলোর দিকে তাকালে দেখি, তারা প্রত্যেকেই নিজেদের জীবিকার নিশ্চয়তা চেয়েছে কিন্তু একবারও ভাবেননি, যে দর্শক শ্রেণির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তাঁদের জীবন-জীবিকা; তাদের সত্যিই কী চাহিদা কিংবা তারা কী চায়? এই বুঝতে না পারাটার পেছনে কিছুটা জনসম্পৃক্ততার অভাব দায়ী। জনপ্রিয় হয়ে গেলে জনগণ থেকে দূরে সরে যেতে হবে এমন স্টার ইমেজের পূর্বধারণা থেকে তাদের বেরিয়ে আসা উচিত ছিল। আন্দোলনে যাওয়ার আগে একটা জরিপ করে নিলে ভালো হতো, এতে করে দাবিগুলোর সপক্ষে একটা যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যেত।

গ. প্রত্যেকটি আন্দোলনেরই কিছু কৌশল থাকে। এই আন্দোলনে সেরকম কোনও কৌশলের দেখা মেলেনি। তারা দর্শক, বিজ্ঞাপন দাতা, এজেন্সি, টেলিভিশন সবাইকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে আন্দোলন সফল করতে চেয়েছে। এটা একটা বড় ভুল। এত বড় শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার মতো সাংগঠনিক কোনও কাঠমোই তাদের ছিল না। ফলে আমরা কিছুদিন পরই মিডিয়া পিকনিকে এজেন্সি, বিজ্ঞাপনদাতা ও শিল্পী-কলাকুশলীর একটা বিরাট অংশকে দেখি মিলিত হতে। সেখানে বরং এই সুরই ছিল যে, এই আন্দোলনের কোনও যথার্থতা নেই।

ঘ. তারা দুই দফা ১৩ টি দাবি পেশ করেন। এত এত দাবির কারণে মূল দাবিটিকেই চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত প্রচার প্রপাগান্ডায় মনে হয়েছে যে, তারা শুধু বাংলায় ডাবকরা বিদেশি সিরিয়ালের বিরুদ্ধেই আন্দোলনে নেমেছে, বিশেষ করে, সুলতান সুলেমানের বিরুদ্ধে। এতে করে সুলতান সুলেমান আরও বেশি জনমানুষের কাছে পরিচিত হয়েছে। দেশের বিভিন্নস্থানে সুলতান সুলেমান দর্শক ফোরামের ব্যানারে একটা বিরুদ্ধ জনমত তৈরি হয়েছে। এটার আদৌ কোনও প্রয়োজন ছিল না। শুধুমাত্র ডাব করা সিরিয়াল বন্ধ করলেই তো সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যা তো অনেক গভীরে, এটা তাদের বোঝা উচিত ছিল।

ঙ. আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের প্রতি সকলের সমর্থন ছিল না। একই নেতৃত্বে অতীতে গুটি কয়েকজন ছাড়া অন্যরা তেমন উপকৃত হয়নি, ফলে আস্থাহীনতা কাজ করেছে। জোরালো কথা শুধু মিটিং, মিছিলেই থেকে গেছে- হৃদয়ে নয়। এটাও অনেকের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই মনে হয়েছে। আমার কী লাভ? এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনাও আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

যা হতে পারতো বলে আমরা কাছে মনে হয়েছে, তা হলো:

ক. জনসাধারণের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে, জরিপ করে, তাদের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে একটা আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করা। এবং সর্বোচ্চ ৩টি দাবি পেশ করা। যাতে করে মনোযোগ বা ধারা বিচ্যুত না হয়।

খ. প্রত্যেককেই তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে সততার সঙ্গে দায়িত্বপালন করা। তাহলে ভালো গল্প, মানসম্মত অভিনয় এবং হৃদয়গ্রাহী একটা নাটক আমরা পেতে পারতাম, যাতে করে সাধারণ দর্শকরা আবার আমাদের নাটক দেখতে উদ্বুদ্ধ হতো। এজন্য প্রয়োজনে জনসংযোগে অংশ নেওয়া যেতে পারত। দর্শকদের বোঝানো যেত, কতরকম প্রতিবন্ধকতার মাঝে তাদের কাজ করতে হয়। একটা সমর্থন তাদের কাছ থেকে আদায় করা নেওয়া। যাতে করে কোথাও চাপ প্রয়োগ করতে গেলে জনগণের একটা বড় সহায়তা পাওয়া যেত।

গ. বিজ্ঞাপন দাতা, এজেন্সি, টেলিভিশন এদের সঙ্গে মতবিনিময় করা। তাদেরকে বোঝানো যে এভাবে শুধু যে এই শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে, তাই শুধু নয়, তাদেরও ক্ষতি হচ্ছে। যে লাভের বিনিময়ে তারা এসব করছে, তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আগামীতে তারাই। এটা তাদের ব্যবসা। ব্যবসায় যখন বিদেশিরা আধিপত্য বিস্তার করবে তখন লাভের গুড় পিঁপড়াতেই খাবে। শিল্পীরা হয়ত কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা সাময়িক, কেননা তারা এ ভিন্ন প্রত্যেকেই অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত আছে। কয়েকটা গোল টেবিল বৈঠক করা যেতে পারত। এ নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা যেতে পারত।

ঘ. আন্দোলনে অন্য পেশার মানুষকেও সম্পৃক্ত করা। যেমন- গানের  শিল্পীরা, যন্ত্রিশিল্পীরা, উপস্থাপকরা, কণ্ঠদানকরীরা, এদের প্রত্যেকেরই আলাদা সংগঠন আছে। তাদেরকেও যুক্ত করতে পারলে দলে ভারি হতো। নানা দিক দিয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলা যেত। এখন অন্যরা দূরে দাঁড়িয়ে আরেক পক্ষের পরাজয়ই দেখছে শুধু।

ঙ. সর্বশেষ যা হতে পারে বা পারত তাহলো লাইসেন্সিং প্রথার ব্যাপারে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করা। তাহলে একটা একক নাটকেরও বাজেট ৭ লক্ষ টাকা হওয়া সম্ভব। ধরুন, ৭ লক্ষ টাকায় একটা একক নাটক নির্মাণ করা হলো তার মান নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক হবে। একজন প্রযোজক সেই টাকা লগ্নি করে অনায়াসেই ২/৩ বছরের মধ্যেই এ টাকা তুলে ফেলতে পারবে যদি তা লাইসেন্সিং পদ্ধতিতে চুক্তিপত্র হয় টেলিভিশনের সঙ্গে।

ধরুন প্রযোজক কোনও টেলিভিশনের সঙ্গে এইমর্মে চুক্তি করল যে, ১ বছরের মধ্যে ওই নাটকটি ২বার সম্প্রচার করতে পারবে তার জন্য প্রযোজককে ২ লক্ষ টাকা দিতে হবে। এভাবে দ্বিতীয় বছরে অন্য কোনও টেলিভিশনের সঙ্গে চুক্তিপত্র করবে হয়ত তখন সে ১.৫ লক্ষ টাকা ১ বছরে ২ বার সম্প্রচারের জন্য পাবে। এভাবে ইউটিউব, ডিভিডি এগুলো থেকেও সে টাকা অর্জন করতে পারবে। একটা সিনেমা যেরকম বহু বছর ধরে বিভিন্ন চ্যানেলে পর্যায়ক্রমে চলতে থাকে, সেভাবে একটি নাটকও চলতে থাকবে। এটা সকলের জন্যই মঙ্গলজনক হবে।

পরিশেষে যে কথাটাবলতে চাই, বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে কোনও কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়, অতীতেও হয়নি। সকলের ঐকান্তিক ইচ্ছাকে যদি আমরা একত্রিত করতে না পারি তবে অটোমান সুলতানের জায়গায় হয়ত কয়েকমাস পর ব্রিটিশ রানী আমাদের শাসন শুরু করবে, বার ভুইয়া, তিতুমির সহ অসংখ্য বীরের এই বাঙলা তাদের বিজয়গাঁথা ভুলে সুলেমান বা রানীর গলায় মালা পরিয়ে দেবো। এ বড় লজ্জার। FTPO কে এ বিষয়ে ভাবতে অনুরোধ করি। একজন মিডিয়াকর্মী হিসাবে এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ