X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাহাড় ধস, আগুন কিংবা ভবন ধস: কেন গরিবরাই মরে?

তপন মাহমুদ
২২ জুন ২০১৭, ১২:৩৬আপডেট : ২২ জুন ২০১৭, ১২:৫০

তপন মাহমুদ ‘ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে, এখানে তাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না’। মানিক বন্দোপাধ্যায় তার কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে গরিব জেলেপাড়ায় ঈশ্বরকে খুঁজে পান নি। তবে এরকম গরিব পাড়ায় যমের ঘোরাঘুরি মনে হয় একটু বেশিই।
খুব বেশি পেছনে তাকাতে হবে না। যে কেউ তার সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে শ’য়ে শ’য়ে উদাহরণ খুঁজে পাবেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে শুরু করে মানবসৃষ্ট যুদ্ধ বিগ্রহ কিংবা দুর্যোগ- মৃতদের তালিকায় চোখ বোলালে সারি সারি গরিব মানুষের নামই উঠে আসবে। তাদের জন্য মৃত্যুটা একটু সহজই মনে হয়!
এ পর্যন্ত দেড়শোরও বেশি মানুষ মারা গেছেন পার্বত্য এলাকায় পাহাড় ধসে। এখানেও ইতিহাসের খুব একটা ব্যতিক্রম হয়নি। মৃতদের তালিকাটা অসহায় গরিব মানুষগুলোই দীর্ঘ করেছে। পাহাড়ের পায়ের কাছে আশ্রয়হীন কিছু মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজেছিল। এর মধ্যে অনেক বাঙালি ছিল, যাদের এই সমতল থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। তাদেরকে ‘সেটলার’ বানিয়ে পাহাড়ে পাঠানো হয়েছে। একে তো তাদের ব্যবহার করা হয় পাহাড়ের জায়গা দখলের জন্য, সাথে ঠেলে দেওয়া হয় জাতিগত সংহিসতার পথে। এরা হলো পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের এক একজন ‘কুবের’ যাদের ‘হোসেন মিয়া’রা সেটলার করে পাহাড়ের মৃত্যুকূপে ফেলে এসেছে। আর আমাদের রাষ্ট্র এইসব ‘হোসেন মিয়া’দের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, দিচ্ছে। কারণ এই রাষ্ট্র আসলে ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। সে ‘করুনা’ করে কিছু গরিব লোককে তার জায়গায় থাকতে দেয় আর কী!
বিশ্ব রাজনীতি বদলায়, রাষ্ট্রের নীতি বদলায়, সময়ের ব্যবধানে বদলায় সরকারও। এর সাথে বদলে যায় ক্ষমতার চরিত্রগুলোও। কিন্তু শুধু বদলায় না গরিব মানুষের ভাগ্য। দিনে দিনে তাদের কপালের মৃত্যুরেখাগুলো আরো পষ্ট হয়। নইলে কি তাদের নিজভূমে পরবাসী হয়ে ‘ময়না দ্বীপে’ যেতে হয় মৃত্যুর খোঁজে? তাদের আশ্রয় নিতে হয় সমাজের ক্ষমতাশালী উচ্চবিত্ত ও সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর তৈরি মৃত্যুকুপে? আর খুব আশ্চর্যের বিষয় পাহাড় দখল আর ধ্বংসযজ্ঞ কিন্তু প্রশাসন বা সরকারের চোখের সামনেই ঘটে!

এমন ঘটনা তো নতুন নয়। ২০০৭ সালেও ভয়াবহ পাহাড় ধসে প্রায় একশোর ওপর মানুষ মারা গেছে। এবং তারা অবশ্যই গরিব মানুষ। না হলে তো আমাদের সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা সবার টনক নড়তো। গরিব মানুষ মরে বলেই এ নিয়ে খুব একটা রা হয় না। দখল চলতে থাকে। সাথে পাহাড় কাটাও। নতুন নতুন ‘হোসেন মিয়া’র জন্ম হয়। আর আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তো ‘কুবের’দের তৈরির সূতিকাগার। এই গরিব মানুষগুলোকেই সামনে ঠেলে দিয়ে পাহাড় গ্রাস করে সমতলের প্রভাবশালী মানুষ আর মতাদর্শ। তাদেরকেই কাজে লাগায় পাহাড়িদের ঘরে আগুন দেওয়ার জন্য। তাদেরকেই শ্রমিক বানিয়ে পাহাড় কাটানো হয়। আর তাদেরই আশ্রয় দেন ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে। আর এভাবেই কেটে যায় গরিব মানুষগুলোর দাস জীবন। মৃত্যুই হয়তো তদের মুক্তি দেয়!

একইভাবে পাহাড়ের গরিব মানুষগুলোও নিত্য শোষিত হয় তাদের সামন্তীয় প্রভূদের দ্বারা। যাদের কাছে শুধু পাহাড়টাই সম্বল, যাদের আর কোনও অবলম্বন নেই, তারা পাহাড়ের গরিব মানুষগুলোই। হুমায়ুন আজাদ তার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝর্ণাধারা’ প্রবন্ধে পাহাড়ের অন্যতম সমস্যা হিসেবে দেখিয়েছেন, সেখানকার সামন্তীয় সমাজ ব্যবস্থাকে। তার মতে, ‘ওই অঞ্চলের সামন্ত প্রভুরা সাধারণ মানুষকে বিকশিত হতে দেয়নি। তাদের দাসে পরিণত করে ১৯০০ সালে বিধিমালা দিয়ে...।’ খুব কি বদলেছে এই চিত্র। বদলায়নি বলেই পাহাড় ধসে পাহাড়ের অসহায় শোষিত গরিব মানুষগুলো মারা যায়। এদের অবস্থা, ‘গরিবের মধ্যে গরিব, ছোটলোকের মধ্যে আরও ছোটলোক’। মৃত্যু তো তাদেরই ভাগ্য হবে! দুর্যোগটা প্রাকৃতিক নাকি মানবসৃষ্ট, সেটা কিন্তু বড় কথা নয়।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। স্মৃতিগুলো এখনও অনেকের কাছেই দগদগে। রানা প্লাজার সেই মুত্যুকূপে গুনতে গুনতে হাজার ছাড়ালো মৃতের সংখ্যা। কারা মরল সেখানে? যারা বাংলাদেশকে সারা বিশ্বে পরিচিত করেছে তাদের হাতের নিপুন দক্ষতায়, যারা প্রতিমুহূর্তে চোখের সামনে চুরি হতে দেখছে তাদের শ্রম, যাদের পারিশ্রমিক খুব কমই ঘাম শুকানোর আগেই পরিশোধ করা হয়, যাদের ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার করতে সহ্য করতে হয়েছে অসহ্য নির্যাতন, বেতন বা বোনাসের দাবিতে যাদের এখনও কারখানা ছেড়ে রাস্তায় নামতে হয়, যাদের জীবনের প্রতিটা ক্ষণ কাটে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায়, তারই মরলো। না, তাদের মেরে ফেলা হলো। কারণ এই আর্থ-সমাজিক ব্যবস্থায় গরিব মানুষের মৃত্যু তো অস্বাভাবিক কিছু নয়!

কিন্তু যার ভুলে, যার লোভের কবলে এতগুলো মানুষের জীবন দিতে হলো, তার কী হলো শেষ পর্যন্ত? কী হবে শেষ পর্যন্ত? বলা কঠিন। কারণ তিনি তিনি তো আছেন প্রভাশালীদের তালিকায়।

পোশাক কারখানায় আগুন লাগে, গরিব মরে। ঘুর্ণিঝড় আঘাত হানে, গরিব মরে। বস্তিতে আগুন লাগে, গরিব মরে। পাহাড় ধস হয়, গরিব মরে। ভবন ধস হয়, গরিব মরে। জীবন মৃত্যুর খেলায় গরিব মানুষই কেন বলি হয় বারবার? কারণ কী এটাই যে, তারা এই পৃথিবীতে টিকে থাকার যোগ্য নয়। তারা অসহায়। তারা শুধু করুনার পাত্র। কিন্তু আসল উত্তরটা বোধ হয়, তাদের গরিব করে রাখা হয়। তারা মারা যায় না। তাদের মারা হয়।

কিন্তু এর শেষ কোথায়? কারো জানা আছে কি? তবে যখন এমন মৃত্যুগুলো চোখের সামনে বারবার ঘটতে থাকে, তখন বারবার শিহরিত হই, একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে মনে আসে, আমিও কি কোনও না কোনোভাবে এই গরিব মানুষগুলোর মৃত্যুকে তরান্বিত করছি? কারণ, আমি তো এগুলো ঠেকানোর জন্য দৃশ্যত কিছু করছি না। তাই তাদের ‘মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়’!

লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
ফটোকপি দোকানের কর্মচারী, জেলে, রাজমিস্ত্রি তৈরি করতো জাল টাকা
ফটোকপি দোকানের কর্মচারী, জেলে, রাজমিস্ত্রি তৈরি করতো জাল টাকা
রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর নিরাপত্তা জোরদার করছে কিয়েভ
রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর নিরাপত্তা জোরদার করছে কিয়েভ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ