X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

কোভিড-১৯ সংক্রমণের ওষুধ কি সত্যি কার্যকর?

সৈয়দ আতিকুল হক
১০ এপ্রিল ২০২০, ১৬:৫৭আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২০, ১৭:০০

সৈয়দ আতিকুল হক কোভিড-১৯ সংক্রমণের চিকিৎসা, পথ্য ও ওষুধ সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পত্র-পত্রিকা এমনকি কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট বা জার্নালেও নানা বার্তা ছড়াচ্ছে। এর মধ্যেই দুই একটি প্রচলিত ওষুধ (বিশেষ করে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, এজিথ্রোমাইসিন ইত্যাদি) নিয়ে এমন বার্তা ছড়িয়েছে যে এই ধরনের ওষুধ ব্যবহারে কোভিড-১৯ সংক্রমিত রোগী দ্রুত সেরে ওঠেন বা যারা কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে আসেন (স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক) তারাও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এসব ওষুধ গ্রহণ করলে উপকৃত হবেন। ইতোমধ্যে এসব ওষুধ কেনার জন্য দোকানে হিড়িক পড়ে গেছে এবং বাজারে ওষুধগুলোর অভাব দেখা দিয়েছে। এতে যাদের আসলে এসব ওষুধ সেবন করার কথা তারা পড়ছেন বিপদে। এ বিষয়টির যথার্থতা নিয়ে আলোচনা করার আগে প্রথমে চিকিৎসা গবেষণালব্ধ তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা খানিকটা ব্যাখ্যা করা উচিত।
গবেষণার মানের ওপর নির্ভর করে যেকোনও তথ্যের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রথম থেকে পঞ্চম এই পাঁচটি মাত্রায় শ্রেণিবদ্ধ করা যায়। সর্বোচ্চ মানের গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যকে লেভেল ১ এবং সর্বনিম্ন মানের গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যকে লেভেল ৫ হিসেবে ধরা হয়। কোভিড-১৯ সংক্রমণ চিকিৎসায় ক্লোরোকুইন ও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের কার্যকারিতা নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সেল রিসার্চ জার্নালে প্রথম পত্র আকারে চীনের একটি গবেষণার তথ্য উপাত্ত প্রকাশিত হয়। সেখানে গবেষণাগারে কৃত্রিম পরিবেশে এক ধরনের কোষে ভাইরাসটি প্রবেশ করিয়ে তার ওপর ওষুধের প্রভাব পরীক্ষা করা হয়। তাতে ওষুধটিকে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি প্রতিহত করতে দেখা যায়। তবে মনে রাখা দরকার, ইতিপূর্বে গবেষণাগারে কৃত্রিম পরিবেশে কার্যকর বলে প্রমাণিত অনেক ওষুধ পরবর্তীতে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অকার্যকর, কখনও কখনও ক্ষতিকরও প্রমাণিত হয়েছে। এর আগে চিকনগুনিয়ার চিকিৎসায়ও ক্লোরোকুইন ওষুধটি গবেষণাগারে কার্যকর বলে মনে হলেও পরে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে বরং ক্ষতিকর বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর পর ফ্রান্সে একটি গবেষণায় এইচসিকিউএস নামক ওষুধটি নিয়ে ২৬ জন রোগীর ওপর গবেষণা করা হয়। এরমধ্যে ২০ জনকে নিয়ে তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। ওষুধটি গ্রহণ করার পর নাক ও গলার ভাইরাস মুক্তি পরিলক্ষিত হলেও রোগের মূল ফলাফল বা পরিণামের ওপর এর প্রভাব কী ছিল, তা উল্লেখ করা হয়নি। তাছাড়া যে ৬ জনের উপাত্ত প্রকাশ করা হয়নি (যাদের মধ্যে ৪ জনের ইনটেনসিভ কেয়ার দরকার হয়েছিল) তাদের বিষয়ে পরিষ্কার কোনও তথ্য দেওয়া হয়নি। এসব টেকনিক্যাল ত্রুটির কারণে এ রিপোর্টটিকে গ্রহণযোগ্যতার বিচারে বড়জোর লেভেল ৫ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। গণচীনে আরও ৩০ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর ওপর এই ওষুধ প্রয়োগে একটি পৃথক গবেষণায় এইচসিকিউএস-এর কোনও বাড়তি উপকার প্রমাণিত হয়নি।

বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ নয় এমন ওষুধ ব্যবহারের প্রবণতার নাম `অফ লেবেল’ ব্যবহার। মহামারি চলাকালীন ওষুধের অফ লেবেল ব্যবহার হয়, কিন্তু তার কিছু বিপদ রয়েছে। প্রথমত, এটি চিকিৎসার অকারণ ব্যয় বাড়ায়। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসা চলছে এমন এক ধরনের ‘ভ্রান্ত স্বস্তি’ মূল প্রামাণিক চিকিৎসা ও মনিটরিং এর ক্ষেত্রে শিথিলতা এনে দেয় এবং জটিলতা বাড়িয়ে দিতে পারে। তৃতীয়ত, ওষুধের অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রোগীর ওপর আরও জটিলতা আরোপ করতে পারে। চতুর্থত, ওই ওষুধ অন্য যে রোগের জন্য আগে থেকে অনুমোদিত সেই রোগীরা ওষুধের কৃত্রিম সংকটে ভোগেন ও বঞ্চিত হন। উল্লেখ্য, এইচসিকিউএস ওষুধটি আগে থেকেই এসএলই, রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস, প্রাইমারি জোগ্রেন সিনড্রোম, ডার্মাটোমায়োসাইটিস, সারকোয়ডোসিস ইত্যাদি রোগে প্রচলিত ও ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। বর্তমানে এই ওষুধের সংকটের কারণে এ ধরনের রোগীরা মহাবিপদে পড়েছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব তার ২৭ মার্চের ভাষণে কোভিড-১৯ মহামারিতে ওষুধের অফ লেবেল ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। এখানে বলে রাখা ভালো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কার্যকর ওষুধ লাভের আশায় সলিডারিটি নামের একটি বৃহৎ ট্রায়াল বা গবেষণা শুরুর ঘোষণা দিয়েছে এবং আক্রান্ত সব দেশের গবেষক চিকিৎসকদের সে গবেষণায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের চিকিৎসকদেরও উচিত হবে বিক্ষিপ্তভাবে চিকিৎসা না করে যারা কোভিড-১৯ চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদের ওই ট্রায়ালে অন্তর্ভুক্ত হওয়া।

স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের মাঝেও এমন একটা ধারণা আছে যে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে এইচসিকিউএস ওষুধটি গ্রহণ করলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকর হবে। আশঙ্কা হলো, যারা এভাবে ওষুধটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করছেন তারা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সত্যিকারের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণে শিথিল হয়ে পড়বেন এবং সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়বেন। ওষুধটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ামুক্ত নয় এবং এতেও তারা বাড়তি ঝুঁকি ডেকে আনতে পারেন। এই ওষুধটির প্রতিরোধমূলক কার্যকারিতা নিয়ে আরেকটি ট্রায়াল বা গবেষণা শুরু হয়েছে, চাইলে বাংলাদেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এতে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারেন। (https://clinicaltrials.gov/ct2/show/NCT4308668)

আমরা জানি যে, কোভিড-১৯ সংক্রমিত রোগীদের ৮০ শতাংশই মৃদু বা মাইল্ড উপসর্গ নিয়ে শুধু উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসাতেই সেরে উঠবেন। বাকি যে ২০ শতাংশের জটিলতা দেখা দেয় তাদের হাসপাতালে চিকিৎসকরা প্রটোকল মেনেই চিকিৎসা দেবেন বলে আস্থা রাখা যায়। প্রয়োজনে কিছু রোগীকে অফ লেবেল ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করার সিদ্ধান্ত তারাই নেবেন আর এদের সলিডারিটি ট্রায়ালে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া উচিত হবে। কিন্তু তাই বলে সাধারণ মানুষ নিজে নিজে ওষুধ কিনে সেবন করবেন, বিষয়টা মোটেও নিরাপদ নয়।

স্বভাবতই বিজ্ঞানের চেয়ে গুজব মানুষকে বেশি আকর্ষণ করে। কারণ, গুজব সহজবোধ্য ও চাকচিক্যপূর্ণ। অন্যদিকে বিজ্ঞান দুর্বোধ্য ও বিরক্তিকর। কিন্তু গুজবের প্রতিক্রিয়া মারাত্মক, এমনকি প্রাণসংহারিও হতে পারে। তাই এই সময়ে যেকোনও ধরনের গুজব থেকে দূরে থাকা, ধৈর্যের সঙ্গে মহামারিকে মোকাবিলা করা, বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা করা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করলেই আমরা কোভিড-১৯ জনিত ক্ষয়ক্ষতিকে গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে রাখতে সক্ষম হবো বলে আশা করি।
লেখক: অধ্যাপক, রিউমাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ