X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা পরবর্তী বিশ্বে নেতৃত্ব দেবে কারা?

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২৮ মে ২০২০, ১৬:৩৪আপডেট : ২৮ মে ২০২০, ১৬:৩৬

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী এতদিন ধরে পশ্চিমা বিশ্ব গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে বিশ্ব নেতৃত্ব তাদের হাতে রাখার চেষ্টা করেছে। পশ্চিমা মানবাধিকারের মাহাত্ম্য কয়েকশ’ বছর ধরে দেখেছে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা। এখন সারা বিশ্ব তাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথাকে একান্তই বাগাড়ম্বরপূর্ণ ও অযৌক্তিক বলে মনে করে। ইউরোপ আটকা পড়েছে তার অনাচারের ইতিহাসে। ছোট ছোট জাতি অথচ এশিয়ার বড় বড় রাষ্ট্রগুলোকে নানা কৌশলে কব্জা করে লুটেপুটে খেয়েছে।
ভারতের উৎপাদিত আফিম ব্যবসা অব্যাহত রাখার জন্য দুই দুইবার চীনের সঙ্গে ব্রিটেনের যুদ্ধ হয়েছে। এই যুদ্ধ দুটিকে আফিমের প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধ বলা হয়। চীন পরাজিত হয়েছিল। একতরফা চুক্তিতে চীন সম্রাট দস্তখতও করেছিলেন। কথিত আছে, চুক্তির কালি কলমের খরচ পর্যন্ত চীন সম্রাটকে পরিশোধ করতে হয়েছিল। হংকংকে ব্রিটেন দখল করে এবং চীনের সম্রাটের সঙ্গে প্রতারণাপূর্ণ ১০০ বছরের এক লিজ এগ্রিমেন্ট করেছিল। ম্যাকাও দ্বীপপুঞ্জটি দখল করে নেয় পর্তুগিজরা। মাঞ্চুরিয়া দখল করে জাপান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান চীনের দখলকৃত মাঞ্চুরিয়া ছেড়ে যায় কিন্তু হংকং ও ম্যাকাও দ্বীপপুঞ্জ ব্রিটেন ও পর্তুগালের থেকে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গড়ে ওঠা চীনা কমিউনিস্ট পার্টি জাপানকে প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এবং জাপানকে প্রতিরোধ করার ব্যাপারে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্বচ্ছ ভূমিকা রেখে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সাধারণ মানুষের মাঝে দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তুলতে পেরেছিল। এটা কিন্তু আমেরিকার সহ্য হয়নি। তারা চীনের  কুওমিংটাং পার্টির ওপর ভর করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ফলে চীনে গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল। মার্কিনিরা কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেনি। কমিউনিস্ট পার্টির লংমার্চ যখন ১৯৪৯ সালে পিকিং এসে উপস্থিত হয় তখন মার্কিন সমর্থক চিয়াং কাইশেক পালিয়ে তাইওয়ানে চলে যায়। সেখানে মার্কিনিরা তাদের রক্ষা করে।

মার্কিনিদের সমর্থনের ওপর ভর করে তাইওয়ান দ্বীপের জাতীয়তাবাদী সরকার দীর্ঘদিন ভেটো পাওয়ারসহ জাতিসংঘের সদস্যপদে বহাল ছিল। নিক্সন যখন আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট হন তখনই আমেরিকা তার অবাস্তব সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে আসে এবং গণচীনকে স্বীকৃতি প্রদান করে। জাতিসংঘে ভেটো পাওয়ারসহ তার সদস্যপদ প্রদানের মাধ্যমে তার প্রতিরোধ স্থগিত করে দেয়। এখন চীন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পাঁচ জনের একজন।

রাশিয়ার চেয়ে ছোট হলেও ৯৬ লাখ বর্গকিলোমিটারের বিশাল এক চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। লোকসংখ্যার দিক থেকে প্রথম স্থানে রয়েছে। লোকসংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি। প্রাকৃতিক সম্পদে মার্কিনিদের সমান। ১৯৭৮ সাল থেকে জমিতে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে। উপকূলবর্তী এলাকায় গড়ে উঠেছে রফতানি জোন। এখন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি। আমেরিকা দ্বিতীয় স্থানে এসেছে। তৃতীয় স্থানে এসেছে জাপান। এই প্রথমবারের মতো পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে উঠেছে বিশ্ব অর্থনীতির নাভিকেন্দ্র।

চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া আর্থিক সঙ্গতি অর্জন করেছে। পশ্চিমের শক্তিগুলো আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এখন ক্রমশ ক্ষয়ের পথে। ফ্রান্স এত আর্থিক কষ্টে পড়েছে যে দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার মতো চিত্রকর্ম বিক্রির কথা চিন্তা করছে।

সারা বিশ্বে আমেরিকার আটশ’ সামরিক ঘাঁটি আছে সত্য। তবে তা পরিচালনার অর্থের অভাব হবে পেন্টাগনের। আমেরিকা গত দশকে তার নৌশক্তির বড় অংশ আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে স্থানান্তর করেছে। কিন্তু করোনা দীর্ঘ সময়ব্যাপী স্থায়ী হলে আমেরিকাকে তার নৌশক্তিকে মূল ঘাঁটিতে ফিরিয়ে নিতে হবে। আসলে চীনের উত্থান শঙ্কিত হয়েই আমেরিকার নৌশক্তি প্রশান্ত মহাসাগরে এনেছিল। আমেরিকা চীনের বড়বাজার। সে কারণে অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করতে হয় চীনের। বর্তমান নেতৃত্ব যারা আছেন তাদের বাণিজ্যপ্রীতি বেশি। প্রতিযোগিতা করে বিশ্বনেতৃত্বে আসতে চীনের আগ্রহের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।

সর্বোপরি আমেরিকা জাতিসংঘের ব্যাপক খরচের ২৪ শতাংশ একাই বহন করে। সুতরাং এই কারণে সহজে আমেরিকান নেতৃত্বকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে চায় না। কিন্তু আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই ধীরে ধীরে এই বোঝা থেকে অব্যাহতি চাচ্ছেন, যদিও বা কথাটা এখনও খোলাসা করে তারা বলেনি। এ বছরের তিন নভেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আর ডেমোক্রেট পার্টির মনোনয়ন পাচ্ছেন জো বাইডেন। তিনি বারাক ওবামা যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন দুই দুইবার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অভিজ্ঞ লোক।

আমেরিকা অভিবাসীদের দেশ। আদিবাসী ছিল রেড ইন্ডিয়ানরা। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গিয়ে বসতি করছে, অনুরূপ অভিবাসীরাই আমেরিকার মূল বাসিন্দা। তাদের মধ্যে ইউরোপ থেকে যাওয়া সাদারাই এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংখ্যালঘুদের মধ্যে আফ্রিকান-আমেরিকান এবং লেটিনরাই প্রধান অংশ। একমাত্র বারাক ওবামা ছাড়া স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমেরিকায় ইউরোপের সাদাদের মধ্য থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে আসছেন। সাদা ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর পণ্ডিতেরা হিসাব কষে বলেছেন, ২০৪০ সালে সাদারা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই সুযোগটা নিয়েছিলেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বর্ণবিদ্বেষ ছড়িয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।

গত চার বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের উল্লেখযোগ্য কোনও সফলতা নেই; বরং তার কারণে বিশ্ব ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনমত যাচাইয়ে যদিও বা জো বাইডেন এগিয়ে আছেন, কিন্তু গত নির্বাচনের মতো শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকে পড়বে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তিনি নির্বাচিত হলে বিশ্বের নেতৃত্ব আটলান্টিক থেকে প্যাসিফিকের দিকে চলে আসবে। কারণ, নেতৃত্ব ধরে রাখার জন্য ট্রাম্প অতিরিক্ত ব্যয় বাড়াতে আগ্রহী নন। তিনি এমনকি ন্যাটো জোটের ইউরোপীয় অংশীদারদের এমন কথাও বলেছেন, এখন আপনাদের নিরাপত্তা গ্যারান্টির ব্যবস্থা নিজেরাই করুন। আমেরিকার ক্লান্তি ও বিরক্তিকর ভাব তিনি গত চার বছর ধরে প্রকাশ করে আসছেন। তাই ন্যাটোর শৃঙ্খলাও বিঘ্নিত হয়েছে।

ন্যাটোর অন্যতম সদস্য তুরস্ক বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে রাশিয়া থেকে ওয়ার হার্ডওয়্যার ক্রয় করেছে। আর জো বাইডেন যদি নির্বাচিত হন তবে প্যাসিফিকের দিকে নেতৃত্ব আসতে হয়তো কিছু বিলম্ব হবে। একক পরাশক্তিরূপে এখনও বিদ্যমান থাকলেও শক্তির ক্ষমতা মার্কিনিদের ক্ষয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সামর্থ্য পড়ছে ক্রমশ টানাপড়েনে। শেষ কথা বলার সময় এখনও না হলেও মার্কিনিরা যে তাদের পূর্বের আর্থিক সামর্থ্য ফিরে পাবে, তা মনে হয় না।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

 

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কোরআন পোড়ানোর অভিযোগে যুবক গ্রেফতার
কোরআন পোড়ানোর অভিযোগে যুবক গ্রেফতার
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির আহ্বান ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির আহ্বান ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
ইসরায়েল থেকে বিমান আসা ও কেএনএফ নিয়ে যা বললো বিএনপি
স্থায়ী কমিটির প্রেস বিজ্ঞপ্তিইসরায়েল থেকে বিমান আসা ও কেএনএফ নিয়ে যা বললো বিএনপি
‘বিএনপি বিরোধিতা করলেও তাদের অনেকেই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে’
‘বিএনপি বিরোধিতা করলেও তাদের অনেকেই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ