X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইউক্রেন যুদ্ধে বৈশ্বিক সংকটের ‘সুবিধা’ নিচ্ছেন এরদোয়ান

বিদেশ ডেস্ক
০৬ জুন ২০২২, ২১:০৮আপডেট : ০৬ জুন ২০২২, ২১:৪৪

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটকে কাজে লাগিয়ে সুবিধা আদায় করছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। তুরস্কের দীর্ঘদিনের লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি পশ্চিমা ও মস্কোর কাছ থেকে সুবিধা আদায়ে কাজে লাগাচ্ছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করা হয়েছে। 

পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোতে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের যোগদানের পথে বাধা সৃষ্টি করছেন এরদোয়ান। এক্ষেত্রে তিনি অভিযোগ তুলছেন, দেশ দুটি তুরস্কে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গিদের সমর্থন দিচ্ছে। একই সময়ে তিনি ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য বহনকারী জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগে জড়িত। ইউক্রেনকে বলা হয় বিশ্বের খাদ্য সরবরাহকারী। কৃষ্ণ সাগরে ইউক্রেনীয় খাদ্যশস্য বোঝাই জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তুরস্কের নৌবাহিনীর শক্তি কাজে লাগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

এরদোয়ানের নেতৃত্বে তুরস্ক ইউক্রেনকে সশস্ত্র ড্রোন সরবরাহ করে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। যা রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে কৃষ্ণ সাগরে কয়েকটি রুশ যুদ্ধজাহাজের প্রবেশ ঠেকিয়ে দিয়েছেন তিনি এবং কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করছেন। তিনি রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন না বলে জানিয়েছেন। এর ফলে তুরস্ক নিজেকে রুশদের ও রুশ অর্থের গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যস্থল হিসেবে হাজির করেছে তুরস্ক। বিশ্বের অল্প যে কয়েকজন নেতা নিয়মিত রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেন, এরদোয়ান তাদের একজন। রাশিয়াকে শান্তি আলোচনায় বসতে চাপ দিতে এই চ্যানেলকে ব্যবহার করছেন তিনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দশকের বেশি সময় ধরে বারবার একই প্লেবুক অনুসরণ করছেন এরদোয়ান। তিনি সাধারণ মানুষের সংকটকে রাজনৈতিক সুবিধায় পরিণত করছেন। তার প্রবণতা হলো শত্রু ও বন্ধু উভয়ের কাছ থেকে সুবিধা আদায়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ঘটনাবলিতে নিজের ভূমিকাকে দেশের ভাবমূর্তি গঠনে ব্যবহার করছেন।

স্বতন্ত্র তুর্কি বিশ্লেষক ও আঙ্কারা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ইলহান উজগেল বলেন, এটিই এরদোয়ান। দেশে ও বিদেশে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সব সুযোগকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে একজন পণ্ডিতে পরিণত করেছেন।

ন্যাটোতে যোগদান ইস্যুতে তুরস্ক ও ফিনল্যান্ডের আলোচনা

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে যে বৈশ্বিক সংকট দেখা দিয়েছে সেখানে নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন এরদোয়ান। এই প্রক্রিয়ায় তিনি কয়েকজন ইউরোপীয় নেতার বিরাগভাজন হয়েছেন। যারা তাকে একজন ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী শাসক এবং অনির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে মনে করেন। ওই কর্মকর্তারা ইঙ্গিত করছেন, এরদোয়ানের রাজনৈতিক বিরোধিতাকারীদের ওপর তুরস্কের দমন-পীড়ন এবং আক্রমণের পর পশ্চিমা উদ্যোগে সম্পূর্ণভাবে শামিল হতে আঙ্কারার অনীহার কথা।

 

‘আমরা শিশু নই’

তুরস্কে দায়িত্ব পালন করা সাবেক ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাষ্ট্রদূত মার্ক পিয়েরিনি বলেন, ন্যাটো মহলে এখনও মনে করা হয়, তুরস্ক আমাদের সঙ্গে পুরোপুরি নেই, অর্ধেক আছে। কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি, কোনও ফ্লাইট বাতিল করেনি।

পশ্চিমা উদ্যোগে আন্তরিকভাবে যুক্ত না হওয়ার অভিযোগটি প্রত্যাখ্যান করেছেন তুর্কি কর্মকর্তারা। তারা উল্লেখ করছেন, তুর্কি সেনারা এবং তাদের সমর্থিত যোদ্ধারা সিরিয়া, লিবিয়া ও ককেশাস অঞ্চলে রাশিয়াকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে।

এরদোয়ানের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক এক সিনিয়র উপদেষ্টা ইলনুর জেবিক বলেন, আমরা কোনও মনোমুগ্ধকর অভিযানে নেই। আমরা এসব স্থানে তুরস্কের অধিকার রক্ষা করছি। আমরা শিশু নই।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ এমন সময় শুরু হয়েছে যখন ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টার পর ক্ষমতায় নিজের লাগাম নিয়ে সবচেয়ে কঠিন ঝুঁকিতে ছিলেন এরদোয়ান। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত এরদোয়ানের আর্থিক ব্যবস্থাপনার কারণে তুরস্ক মুদ্রা সংকটে রয়েছে। দেশটির সরকারি মূল্যস্ফীতি প্রায় ৭০ শতাংশ, যা জি-২০ দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ এবং বিশ্বের মধ্যে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ। স্বতন্ত্র অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তুরস্কের প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ১০০ শতাংশের বেশি হতে পারে।

এই সংকটের ফলে লাখো তুর্কি নাগরিক দারিদ্র্যে পতিত হয়েছেন, কমেছে এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা, এমনকি রক্ষণশীল সমাজেও হ্রাস পেয়েছে তার প্রতি সমর্থন। এর ফলে ২০২৩ সালের জুনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে তার পরাজয়ের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অবশ্য সরকার চাইলে আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্তও নিতে পারবে।

তুরস্কের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য দায়ী নেতা হিসেবে নয়, বরং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের একজন নেতা হিসেবে ভূমিকা রাখার সুযোগ দিয়েছে এরদোয়ানকে।  

সরকারের আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে ইস্তাম্বুলে তুর্কি ট্রেড ইউনিয়নের বিক্ষোভ

তুর্কি নির্মিত বায়রাখতার টিবি-২ সশস্ত্র ড্রোন রাশিয়ার আক্রমণ মোকাবিলায় ইউক্রেনের প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এসব ড্রোন দিয়ে ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা রুশ সামরিক বহর উড়িয়ে দিচ্ছে, ডুবিয়ে দিচ্ছে রুশ যুদ্ধজাহাজ। এই যুদ্ধে ড্রোনের সাফল্য তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের শক্তি প্রদর্শন করছে। যে শিল্প দেশের ৭০ শতাংশ চাহিদা মেটানোর জন্য এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নির্ভরতা কমাতে গড়ে তুলেছেন এরদোয়ান।

আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় কৃষ্ণ সাগরে রুশ যুদ্ধজাহাজের প্রবেশ ঠেকিয়েছে তুরস্ক এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার দুটি শান্তি আলোচনা আয়োজন করেছে। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করা এবং রুশ অর্থের প্রবাহকে স্বাগত জানালেও এই সিদ্ধান্তগুলো পশ্চিমাদের নেতাদের অনুমোদন পেয়েছে। বিশ্বে এখন যে কয়টি দেশে রুশ নির্বিঘ্নে বিমান চলাচল করতে পারছে তুরস্ক সেগুলোর একটি।

 

পিছু হটলেও রাজনৈতিক সুবিধা পাবেন এরদোয়ান

ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে তুরস্কের পদক্ষেপের কারণে পশ্চিমা কর্মকর্তাদের সঙ্গে এরদোয়ানের যোগাযোগ বাড়িয়েছে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পক্ষ থেকে ফোনকলও পেয়েছেন।

কিন্তু শুরুর দিকে যে সুনাম এরদোয়ান অর্জন করেছিলেন তা মে মাসে ম্লান হয়ে গেছে। যখন তিনি ঘোষণা দেন যে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদানকে সমর্থন করবে না তুরস্ক। ইউরোপীয় নিরাপত্তা কৌশলের ঐতিহাসিক মুহূর্তকে বিপথগামী করার অভিযোগ ওঠে তুরস্কের বিরুদ্ধে।

আঙ্কারার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামরত কুর্দি গোষ্ঠীগুলোকে নরডিক দেশ দুটি সমর্থন করছে অভিযোগ তুলেছেন এরদোয়ান। তুরস্ক ও ইউরোপে এই গোষ্ঠী সন্ত্রাসী হিসেবে স্বীকৃতি। সুইডেন পাল্টা অভিযোগ করেছে, তুরস্ক ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে। সংলাপের মাধ্যমে বিরোধ নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দেশ দুটি।

এই পদক্ষেপের মাধ্যমে এরদোয়ান তুরস্কের দীর্ঘদিনের অভিযোগকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। আঙ্কারা দাবি করে আসছে, পশ্চিমা সরকারগুলো সিরীয় কুর্দি যোদ্ধাদের সমর্থন দিচ্ছে। ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে মার্কিন সমর্থিত লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ কুর্দিরা।

সিরিয়ায় কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের হুমকি দিয়েছেন এরদোয়ান

তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ঘোষিত কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পাটির বিরুদ্ধেও অভিযান জোরদার করছে এরদোয়ান প্রশাসন। উত্তর ইরাকে তাদের ঘাঁটিতে বোমা বর্ষণ করছে তুর্কি বাহিনী। সিরিয়ার কুর্দি নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে নতুন সামরিক অভিযানেরও হুমকি দিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট।

এত কিছুর মধ্যে এরদোয়ান আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এরমধ্যে রয়েছে, কৃষ্ণ সাগর দিয়ে খাদ্য রফতানির জন্য একটি নিরাপদ করিডোর স্থাপনে রাশিয়া ও ইউক্রেনের আলোচনা। এক্ষেত্রে একটি প্রস্তাব হলো খাদ্যশস্য ও অপর খাদ্যপণ্য বহনকারী বেসামরিক জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তুর্কি যুদ্ধজাহাজকে সম্পৃক্ত করা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত ন্যাটোতে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের যোগদানের বিরোধিতা থেকে এরদোয়ান রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে পারেন। এমনকি তিনি যদি ন্যূনতম ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে জোটে যোগদানের বিরোধিতা প্রত্যাহার করার পরও। তুর্কি সংবাদমাধ্যম ও তার দলের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে দেশে তিনি নিজেকে তুরস্কের স্বার্থরক্ষাকারী একজন বিশ্বনেতা হিসেবে হাজির করতে পারবেন।

ইলহান উজগেল বলেন, এমনকি তিনি পিছু হটলেও তার সমর্থকরা পরোয়া করে না। এভাবেই এরদোয়ান অনেক সময় সাফল্যের সঙ্গে সংকটকে কাজে লাগিয়েছেন।

/এএ/এমওএফ/
টাইমলাইন: ইউক্রেন সংকট
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:৩০
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭:০২
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:০৪
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:০১
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:০৪
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২৩:০১
সম্পর্কিত
ঘুষ মামলায় আদালতের আদেশ লঙ্ঘন, ট্রাম্পের শাস্তি চান প্রসিকিউটররা
ইসরায়েলের আকরে শহরে হামলার দাবি করলো হিজবুল্লাহ
ইউক্রেনকে ৬২ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য
সর্বশেষ খবর
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ