ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন মত, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য বাংলাদেশ কি বসবাসের অনুপযুক্ত পড়ছে? এখানে বসবাস করতে হলে সবাইকে কি একই ধর্ম, একই মতের অনুসারী হতে হবে? তা না হলে খুন হয়ে যেতে হবে? একের পর এক ভিন্ন মত ও ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা ও আক্রমণের ঘটনা এই প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। চিন্তিত করে তুলেছে ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের। দেশটা কি তবে উগ্র ধর্মবাদীদের তালুকে পরিণত হলো?
এতকাল যে ঘটনা আমরা দেখেছি- উগ্র জঙ্গিবাদ কণ্টকিত পাকিস্তানে, এবার বাংলাদেশেও তেমন ঘটনা ঘটেছে। গত ২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় শিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে নামাজ চলাকালে মুসল্লিদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় একজন নিহত এবং ইমামসহ তিনজন গুরুতর আহত হয়েছে। এ ঘটনা আমাদের চমকিত করছে। আমরাও কি তবে পাকিস্তানের পথে এগিয়ে চলেছি?
বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের সীমাহীন গর্ব রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় আমরা ভালো আছি। বিভিন্ন সামাজিক অগ্রগতির সূচকে আমাদের অবস্থান উন্নয়ন-বিশেষজ্ঞদের প্রশংসা কুড়োচ্ছে। দেশের আয়-উন্নতি-প্রবৃদ্ধি সবকিছুই বাড়ছে। তারপরও কোথায় যেন আমাদের তাল কেটে যাচ্ছে। আমরা এগিয়ে গিয়েও পিছিয়ে পড়ছি! আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা, স্থিতি, হাজার বছর ধরে লালিত সহিষ্ণু মনোভাব, ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য- এসব যেন তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এক অদৃশ্য অপশক্তি আমাদের যাবতীয় অর্জন নস্যাৎ করে দিতে উদ্যত। আমরা দেখছি, অনুভব করছি, কিন্তু এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়া থামাতে পারছি না। অদৃশ্য ঘাতকরা ওঁৎ পেতে বসে আছে। সুযোগ বুঝে তারা হিংস্র আক্রমণ করছে। অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতে হচ্ছে নিরীহ নাগরিকদের।
গত কয়েকদিনে ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হতে হয়। গত ২৪ নভেম্বর ফরিদপুর হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলোক সেনকে ফরিদপুরে নিজ বাসার সামনে কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা।
রংপুরে ১০টি খ্রিস্টান মিশনারির প্রধানদের হত্যার হুমকি দিয়ে একটি উড়ো চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যারা খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করছে, তাদের সবাইকে এক এক করে বিদায় করা হবে। এর আগে ঢাকার বিভিন্ন চার্চের পাঁচ পাদ্রিকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। দিনাজপুরে ইতালীয় নাগরিক ধর্মযাজক ও চিকিৎসক ড. পিয়ারোষ পিজম ও ঈশ্বরদী পাবনার পালক লূক সরকারকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ৮ নভেম্বর রংপুর নগরীর আর কে রোডের আইডিয়াল মোড়ে নিজ বাসার সামনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছেন বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা রুহুল আমিন।
এ মাসেই রাজধানীতে একজন ইতালীয় এবং রংপুরে একজন জাপানি নাগরিক হত্যা করা হয়। রাজধানীতে হোসনি দালানে শিয়া সম্প্রদায়ের সমাবেশ প্রস্তুতির সময় বোমা হামলা চালানো হয়। পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার নিজ বাসভবনে হত্যা করা হয়। পীর হিসেবে পরিচিত খিজির খান সেখানে রহমতিয়া খানকা শরীফ পরিচালনা করতেন। তাকে জবাই করে হত্যার আভিযোগে গ্রেফতারকৃতরা পুলিশের কাছে প্রদত্ত জবানবন্দীতে জানিয়েছে, ‘ঈমান আকিদা’ পরিপন্থী কাজে লিপ্ত থাকায় তারা খিজির খানকে খুন করেছে। জবাই করে খুন করলে সওয়াব বেশি তাই জবাই করে খুন করা। তারা এও বলেছে, যারাই পীরালি করবে তাদেরই তারা খুন করবে! কেবল খিজির খানই নয়, এর আগে আরও অনেককেই পীরালি বা মাজার দরবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় খুন হতে হয়েছে।
ভিন্ন মত কিংবা ভিন্ন ধর্ম অনুসরণকারীরা উগ্র ধর্মবাদীদের নৃশংস আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, অথচ এ ব্যাপারে রাষ্ট্র কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এটা অত্যন্ত হতাশার। বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ যেন দিন দিন প্রকট রূপ নিচ্ছে। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদী রাজনীতির একটি প্রভাব রয়েছে। নিজের ধর্মমতকে শ্রেষ্ঠ মনে করা, অন্যের ওপর সেই মত চাপিয়ে দেওয়া, যারা তাদের মত অনুযায়ী না চলবে, তাদের গর্দান কেটে হত্যা করা- এ সবই হচ্ছে জঙ্গিবাদী রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য। এই রাজনৈতিক দর্শন এখন ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে।
ধর্মীয় উগ্রবাদ যেভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তাতে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ মাত্রই বিচলিত হয়ে পড়ছেন। অথচ হাজার বছর ধরে এখানকার নাগরিকরা নীরবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করে এসেছেন। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে প্রায় এক হাজার বছর আগে। এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছেন প্রধানত সুফি দরবেশরা, যারা এসেছিলেন আরব বণিকদের সঙ্গে। ইসলামের আবির্ভাবের আগে এখানে হিন্দু ধর্মের প্রচার ঘটেছে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ঘটেছে এবং তারও আগে আদিবাসীদের ভেতর প্রাকৃতিক ধর্মের চর্চা ছিল। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ভেতর শাসকদের প্ররোচনায় কখনও কখনও ধর্মীয় সংঘাত হলেও সাধারণভাবে বাঙালিরা পরমতসহিষ্ণু, উদারনৈতিক এবং ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের সহঅবস্থানে বিশ্বাসী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরনো ধর্মমতের জায়গায় নতুন ধর্মমত এসেছে সমঝোতার ভিত্তিতে। পুরনোকে পুরোপুরি বর্জন নয়, পুরনোর অনেক বৈশিষ্ট্য নতুন নির্দ্বিধায় আত্মস্থ করেছে। যার ফলে ধর্মে ধর্মে কিংবা একই ধর্মের বিভিন্ন পথ ও মতের ভেতর পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কয়েক হাজার বছরের বাঙালির সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবন তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে বরং সমৃদ্ধ হয়েছে।
কিন্তু ইদানিং দেশে এক শ্রেণির উগ্র মৌলবাদীর উত্থান ঘটেছে। তারা ব্যবহৃত হচ্ছে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের হাতিয়ার হিসেবে। দেশকে সবদিক থেকে পিছিয়ে দেওয়া এবং অস্থিতিশীল করে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে বহুকাল থেকে। বলা যায় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে সেই ষড়যন্ত্র চলে আসছে সমানভাবেই। আর এই ষড়যন্ত্রীরা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও হত্যার চেষ্টা করেছে অনেকবার। এর মধ্যে সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে। ২১শে আগস্টের সেই নৃশংস হামলার বিচার আজও শেষ হয়নি। সেই ষড়যন্ত্রী ও অপশক্তি এখনও সমানভাবেই দাবার চাল দিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ যেন মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ধারণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেই অপচেষ্টা চলছে বিরামহীনভাবে। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে, নাশকতা হচ্ছে এসব কিছুই একই সূত্রে গাঁথা বলেই বিষেষজ্ঞ মহল মনে করেন।
রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু ও অনন্তবিজয় দাশ, নিলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়সহ অনেক মুক্তমনা লেখকের রক্তের দাগে দেশের মাটি ভেজা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেই ২০১৩ সাল থেকেই উগ্রবাদী জঙ্গিদের আক্রমণের নিশানায় থেকেছেন এই মৌলবাদবিরোধী লেখকরা। পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে দফায় দফায় চলছে বিএনপি ও তার জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর তাণ্ডব এবং পেট্রোলবোমা হামলা। হামলা-সন্ত্রাস পরিচালনা, অপছন্দের, ভিন্ন মতের কাউকে জবাই, গুলি কিংবা বোমা মেরে খুন করা একদল নরপিশাচের নেশায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বাতাসে মিশে গিয়েছে ঘৃণার বাষ্প এবং তা দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশের সর্বত্র। এই বিষবাষ্পে একের পর এক মুক্তচিন্তার লেখক এবং এই লেখকদের বইয়ের প্রকাশককে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। হামলার শিকার হতে হচ্ছে ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন মতের অুনসারীদের। অথচ আমাদের সংবিধানই আমাদের মতামত প্রকাশ করার, চিন্তার স্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে। প্রত্যেকটি মানুষের কথা বলার, নিজস্ব ধর্মাচরণের স্বাধীনতা দিয়েছে। আজ সেই স্বাধীনতার টুঁটি টিপে ধরা হচ্ছে। সংবিধানকে উপড়ে ফেলে দেওয়া, হিংসাকে গণতন্ত্র বলে চালানো, শান্তির অর্থটাকেই বদলে দেওয়ার মতো ঘটনা দীর্ঘদিন চলতে পারে না।
এ ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা আশাব্যঞ্জক নয়। যথেষ্টও নয়। প্রধানমন্ত্রী এখন পর্যন্ত এমন কোনও পাকা আশ্বাস দেননি যার ফলে বহুত্ববাদী সমাজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। একের পর এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, সেখানে কোনওরকম আশ্বাস-অঙ্গীকার ছাড়া কীভাবে ভরসা পাবেন দেশের মানুষ? বাংলাদেশ যে শুধু মুসলমানের দেশ নয়, সবার সেটা গলা তুলে বলার সময় এসেছে। দেশের সব মানুষকে নিরাপত্তা দিতে হবে, তাদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। সরকারের এটা প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। প্রত্যেকটি ধর্মের নিজস্ব জায়গা আছে, সম্মান আছে। এই বহুত্ববাদই আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের অলঙ্কার। তার ওপর যদি খাঁড়া নেমে আসে, তবে যেকোনও মূল্যে তাকে রক্ষা করতে হবে।
একথা হয়তো ঠিক যে বর্তমানে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার যে ন্যাক্কারজনক ঘটনাগুলো চারদিকে ঘটছে তাতে রাষ্ট্র বা প্রশাসনের কোনওরকম সায় বা মদদ নেই। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এক্ষেত্রে যেন রাষ্ট্র কোনও কিছু দেখেও দেখছে না। যেন চোখ বন্ধ করে রয়েছে রাষ্ট্র। এটা অনভিপ্রেত। এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে খারাপ বার্তা পৌঁছচ্ছে।
বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাই এ দেশের সরকার তথা রাষ্ট্র কখনই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে এভাবে নীরব অবস্থান নিতে পারে না। রাষ্ট্রের উচিত ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার মতো বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে কড়া অবস্থান নেওয়া। বতর্মান সরকার ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে যে অবস্থান নিয়েছে তা আদৌ যথেষ্ট নয়। আর এর সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ। কিছু লোক যারা অশান্তি বাঁধাতে চায় তারা রাষ্ট্রের এই মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে এর থেকে ফায়দা নিচ্ছে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে রাষ্ট্রের এই মনোভাব পরোক্ষভাবে তাদের উৎসাহিত করছে। তাই রাষ্ট্রের উচিত ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে শুরুতেই কড়া অবস্থান নেওয়া।
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে চাইলে রাষ্ট্রীয়ভাবে নতুন নীতি-কর্মসূচি-অঙ্গীকারের কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু তেমন কিছু শাসকদের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তবে কি এদেশে উগ্র ধর্মবাদীদের হাতে ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন মতের মানুষদের অসহায় খুন হওয়াটাই একমাত্র ভবিতব্য?
লেখক: কলামিস্ট
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।