X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরকারের আপিলই প্রমাণ করে তাদের মনস্তত্ত্ব

ডা. জাহেদ উর রহমান
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৮:২১আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২১:৩২

ডা. জাহেদ উর রহমান আচরণ দিয়ে মানুষের ব্যক্তিত্বের ধরন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়–এটা মনোবিজ্ঞানের একেবারে প্রতিষ্ঠিত সত্য। ‌আমি বিশ্বাস করি, এটা শুধু মানুষ নয়, সরকারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য–একটা সরকারের নানা আচরণও সেই সরকারের চরিত্র সম্পর্কে আমাদের খুব স্পষ্ট ধারণা দেয়। 

নানা ক্ষেত্রেই এটা প্রমাণ করা গেলেও একটা উদাহরণ হিসেবে আইনের কথাই ধরা যাক। একটা সরকার কোন ধরনের আইন প্রণয়ন করছে, সেই আইনের ধারা কেমন, সেটা কীভাবে প্রয়োগ করছে এগুলো সেই সরকার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের নানা ধারা নিয়ে সাংবাদিক-সম্পাদকসহ সাধারণ মানুষ অনেক সমালোচনা করেছেন, কিন্তু সেই আইনটি পাল্টায়নি উপরন্তু সেটি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও শক্ত সমালোচনা আছে সরকারের বিরুদ্ধে। তাদের এই আচরণ নিশ্চয়ই সরকারের চরিত্র সম্পর্কে ধারণা দেয় আমাদের।

সরকার তার তৈরি করা আইন সবসময় যে তার মতো করে প্রয়োগ করতে পারে, সেটা নয়। অনেক সময়ই আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ সরকারের পদ্ধতিকে সমালোচনা করেন, অনেক ক্ষেত্রে বাতিল করেন। কখনও কখনও পুরোপুরি বাতিল না করলেও কিছু নির্দেশনা দেয়। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের কোনও রায় তার বিপক্ষে গেলে সরকার কেমন আচরণ করে, আমি বিশ্বাস করি সেটাও সরকারের চরিত্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা নির্দেশক। দুটো ঘটনা উল্লেখ করে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করবো আমরা।

সাম্প্রতিক ঘটনাটি সম্পর্কে আগে বলা যাক। চট্টগ্রামের মো. ইব্রাহিম নামে এক ব্যক্তির হাইকোর্টের জামিন থাকা অবস্থায় নিম্ন আদালত কর্তৃক সেটা বাতিল করার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এক রায় দেন। ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি মো. হাবিবুল গণি ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ তাদের রায়ে উচ্চ আদালতের জামিন নিয়ে চার দফা নির্দেশনা দেন। এগুলো হলো–

১. হাইকোর্ট বিভাগ থেকে কোনও আসামি যদি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জামিনে মুক্তি পান, তবে জামিনের অপব্যবহারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া অধস্তন আদালত তার জামিন বাতিল করতে পারবেন না।

২. নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জামিনে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তির জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশ দাখিল না করার কারণে অধস্তন আদালত তার জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠাতে পারবেন না।

৩. সংশ্লিষ্ট আসামি বা ব্যক্তির জামিন বাতিল করতে হলে তিনি হাইকোর্টের যে রুল বা আপিলে জামিন পেয়েছেন, সেই রুল বা আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

৪. হাইকোর্ট যে রুলে বা আপিলে জামিন দিয়েছেন, তা খারিজ না হওয়া পর্যন্ত অধস্তন আদালত তার জামিন বাতিল করতে পারবেন না। তবে, হাইকোর্টের দেওয়া জামিনের শর্ত ভঙ্গ করলেই শুধু জামিন বাতিল করা যাবে।

এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করে এবং গত ৫ জানুয়ারি আপিল বিভাগে এই শুনানি উঠলে যথারীতি হাইকোর্টের আগের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেন আপিল বিভাগ। 

পাঠক, আইনজ্ঞ না হলেও আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে যদি আমরা ভেবে দেখি, যে চারটি শর্ত এখানে দেওয়া হলো সেগুলো মেনে নিতে সমস্যা কেন সরকারের? দেশের উচ্চ আদালতের রায় (সেটা জামিন হলেও) অমান্য করে নিম্ন আদালত সিদ্ধান্ত নেবে, এটা তো অসাংবিধানিক ব্যাপার। সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ এ ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য দেয়–

‘আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যেকোনও বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় হইবে।’

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৫ এবং ১১৬-এর মাধ্যমে নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ-পদোন্নতি বদলে ইত্যাদি বিষয়ে রাষ্ট্রপতির নামে মূলত সরকারের কর্তৃত্ব আছে। এই মামলায় সরকারের এই আপিল কি প্রমাণ করে না, উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করে নিম্ন আদালতের রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কোনও ধরনের প্রভাব তৈরির সুযোগ থাকবে এ আশায় ওই আপিল করা হচ্ছে?

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করাকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের রায় হয় ২০১৭ সালের ১১ মে। সেই রায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ২০০৯ সালের আইনের ১১টি ধারা ও উপধারা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। শুধু তা-ই নয়, এই আইনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। রায়ে বলা হয়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া সংবিধানের লঙ্ঘন এবং তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর আঘাত। এটি ক্ষমতার পৃথককরণ নীতিরও পরিপন্থী। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ কর্ম-কমিশনের সব সদস্য প্রশাসনিক নির্বাহী। একজন নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তারা প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন না।

এই রায়ের পর সরকার আপিল করে এবং আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ দেয় রায়ের ওপরে। সেই স্থগিতাদেশ বলেই এখনও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে এই আদালতগুলো চলতে পারছে। 

এতে খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটো প্রশ্ন আছে। প্রথমটি হলো দেশের হাইকোর্টের এরকম সুস্পষ্ট রায়ের বিরুদ্ধে সরকার কেন আপিল করলো? বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা কি সরকার জানে না?

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, আপিল করার পর সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে যাবার পর‌ও এই আপিলের শুনানি এখনও কেন শুরু হয়নি? এই শুরু না হওয়াটা কি প্রমাণ করে না স্থগিতাদেশ অনন্তকাল ঝুলিয়ে রাখার চেষ্টা করবে সরকার এবং সেটা দিয়েই এই নির্বাহী বিভাগের পরিচালনায় মোবাইল কোর্ট চলতেই থাকবে?

মোবাইল কোর্টের তথাকথিত বিচারের অন্তঃসারশূন্যতা, আর সেটা যদি রাখা হয় কীভাবে শুধু বিচারক ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে সেটা বহাল রাখা হবে সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। কিন্তু এই কলামে আমরা ওই প্রসঙ্গে আর যাচ্ছি না। 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কেউ পছন্দ না-ই করতে পারে। গত বেশ কয়েক বছরে চীনের অর্থনৈতিক উন্নতি দেখিয়ে অনেকেই আকারে-ইঙ্গিতে কিংবা সরাসরি সেই ধরনের সরকারের পক্ষেও কথা বলার চেষ্টা করেন। তাদের উদ্দেশ্যে আমার এই বক্তব্যটা না। তাদের সাথে বিতর্ক ভিন্ন। কিন্তু যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করেন তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একেবারে মৌলিক ব্যাপার ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’-এর ওপরে আস্থা থাকতেই হবে।

মধ্যযুগীয় সম্রাট শাসিত রাজ্যগুলো কিংবা হালের চীনের সাথে সাথে আধুনিক, কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক পার্থক্যই হচ্ছে  কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’ থাকে। সেই রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করে। প্রতিটি বিভাগের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় তার অধীনস্থ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এভাবেই রাষ্ট্রের কোনও একটি অঙ্গের, বিশ্বাস করে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা একেবারে সর্বময় হয়ে ওঠে না। ‌

আলোচ্য দুটি ক্ষেত্রে আপিলের ফলাফল কী হবে সেই আলোচনা দূরে সরিয়ে রেখেও আমরা এই প্রশ্ন খুব জোর করে নির্বাহী বিভাগকে করতে পারি–এই রায়গুলোর বিরুদ্ধে আপিল করা হলো কেন?

এই দেশের কোনও সরকার বিচার বিভাগের সত্যিকারের পৃথকীকরণ চায়নি। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের সব অঙ্গের ওপর সর্বময় কর্তৃত্ব চাওয়া হয়েছে। অথচ সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ অধ্যায়ের অংশ, যাতে বলা হয়েছে– ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন’। অর্থাৎ সংবিধানের ১১৫ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ ২২ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক‌ হলেও সেগুলো এখনও সংবিধানে আছে।

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত যুগান্তকারী মাসদার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগের রায় হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এরপর আরও দেড় বছরের বেশি ক্ষমতায় ছিল; তারা সেই রায় বাস্তবায়ন করার প্রাথমিক পদক্ষেপটুকুও শুরু করেনি। তারপর বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল পূর্ণাঙ্গ মেয়াদ, এবং তারাও কোনও পদক্ষেপ নেয়নি এ ব্যাপারে। নানা ক্ষেত্রে দেশের দুই ‘বড় দল’-এর মধ্যে খুব বড় ধরনের মতপার্থক্য থাকলেও এই একটা জায়গায় তাদের কী ‘অসাধারণ’ দর্শনগত মিল। এটা আমাদের জন্য ভীষণ লজ্জার ব্যাপার হয়ে থাকবে। শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে এই পদক্ষেপ নিয়েছিল এই দেশের একটি অগণতান্ত্রিক (এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক) সরকার। ‌

বিচার বিভাগ একেবারে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বিচার বিভাগের ওপরে নির্বাহী বিভাগের লিখিত কর্তৃত্ব দূর হলেও অলিখিত কর্তৃত্ব থেকে যেতে পারে দীর্ঘ সময় ধরে। সেই অলিখিত কর্তৃত্ব দূর করে বিচার বিভাগকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে তোলাও রাষ্ট্রের নাগরিকদের এক গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। 

হতাশার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা এখনও লিখিতভাবেই বিচার বিভাগকে (নিম্ন আদালতকে) পূর্ণাঙ্গভাবে পৃথক করতে পারিনি। হতাশার পরিমাণ বেড়ে যায় আর‌ও বহুগুণ, যখন দেখি নির্বাহী বিভাগ তার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছে এই পৃথকীকরণ ঠেকাতে। এই কলামে আলোচিত সরকারের দু’টি আপিল সরকারের এই মানসিকতার জাজ্বল্যমান‌ প্রমাণ।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ