X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রেসক্লাবে পুলিশ এবং হঠাৎ সরব বিএনপি

আনিস আলমগীর
০২ মার্চ ২০২১, ১৩:৫২আপডেট : ০২ মার্চ ২০২১, ২০:৫৬

আনিস আলমগীর মৌসুম এখন আন্দোলনের অনুকূলে, রাস্তায় বিরোধী দল নামবে সেটাই স্বাভাবিক। দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বীর উত্তম খেতাব কেড়ে নেওয়ার জন্য সরকারি একটি কমিটির প্রস্তাব হয়তো বিএনপিকে রাস্তায় নামতে বেশি বাধ্য করেছে। এই ইস্যুতেও যদি বিএনপি চুপ থাকে, রাজনীতিতে তাদের মুখ রক্ষার আর কিছুই থাকে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার মূল্যবৃদ্ধি, লাগামহীন বাড়িভাড়া, আর্থিক সেক্টরে দুর্নীতি বা অন্য কোনও নাগরিক ইস্যুতে বিএনপির চেতনা ছিল না। ১২ বছর পার করে দিয়েছে শুধু খালেদা জিয়ার দুর্নীতি আর তারেক জিয়ার সন্ত্রাসের মামলার প্রতিবাদ করতে করতে। জনগণের কথা ভাবার তাদের সময় কোথায়, যদিও কাগজে কলমে না হলেও সরকার এবং জনগণ সবাই বিএনপিকেই বিরোধী দল হিসেবে গণ্য করে।

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ার কৃতিত্ব জনগণকে জানানোর জন্য গত শনিবার ২৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের এই অর্জন তুলে ধরতে গিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ কৃতিত্ব সমগ্র বাংলাদেশের জনগণের। দেশে-বিদেশে প্রবাসের সবাইকে আমি এই কৃতিত্বের অংশীদার মনে করি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই মাইলফলক অর্জন করতে পেরেছি।’

১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে থাকা বাংলাদেশ এমন এক সময়ে এই স্বীকৃতি পেলো যখন দেশটি তার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছে এবং মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে।

বিএনপি বাংলাদেশের এই অর্জন নিয়ে কিছু বলেছে কিনা আমি দেখিনি। তবে সেদিন খুলনায় বিএনপি সমাবেশ করেছে সরকারের বাধা উপেক্ষা করে। এই সমাবেশ ঠেকানোর জন্য সরকারি প্রচেষ্টা ভালো ছিল না। পুলিশ সমাবেশের অনুমতি না দিলেও বিএনপি নেতারা সমাবেশ করেছেন এবং বড় ধরনের কোনও গোলযোগ হয়নি এটা ছিল ভালো দিক। সরকার কোন অজুহাতে সমাবেশের অনুমতি দেয়নি জানি না তবে গণতান্ত্রিক যেকোনও আন্দোলন করার, সভা-সমাবেশ করার অধিকার নাগরিকদের আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে সে অধিকারের কথা বলা হয়েছে। শুধু মনে রাখতে হবে সমাবেশের নামে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব যাতে না হয়। আর রাজনৈতিক দল বা সংগঠনগুলো তাদের কর্মসূচি অগ্রিম জানাতে হবে, যাতে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে। আর জনগণ যাতে পূর্ব প্রস্তুতি নিতে পারে, কারণ রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বিঘ্ন ঘটতে পারে।

কিন্তু ২৭ ফেব্রুয়ারি খুলনায় বিএনপি আহূত মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ প্রশাসন ও সরকার-সমর্থক পরিবহন মালিকরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা জনগণের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে এবং অনেককে দুর্ভোগের মধ্যে ফেলেছিল। খুলনার পরিবহন বাস মালিক সমিতি ২৬ তারিখ থেকে ২৭ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত খুলনা থেকে ১৮টি রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়। ফলে নগরবাসীর জন্য এক অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে যারা দূরযাত্রার যাত্রী ছিলেন তারা চরম ভোগান্তিতে পড়ে। পরিবহন মালিকদের হাস্যকর দাবি ছিল যে, খুলনায় বিএনপির সমাবেশে কোনও গোলমাল হতে পারে, এ কারণে নাকি পরিবহন শ্রমিকেরা বাস চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

খবরে দেখলাম, বিএনপি শহীদ হাদিস পার্কে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছিল। কেএমপি সেখানে সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীরা দলীয় অফিসের সামনে জড়ো হন। কিন্তু সেই জায়গাটিও পুলিশ চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। সকাল ১০টার পর কাউকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বিএনপি অফিসের সামনে নেতাকর্মী-সমর্থক ছিলেন দুই হাজারের মতো। তাদের পাহারায় সমসংখ্যক পুলিশ সদস্য ছিলেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যে যারা ছিলেন, তাদের নিয়েই সমাবেশ হয়েছে এবং কোনও গোলযোগ হয়নি।

প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপির আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই বলে সরকারের মন্ত্রীরা প্রায় তিরস্কার করেন, যদি তা-ই হবে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে গোটা খুলনা শহরকে পুলিশ দিয়ে ঘিরে ফেলা হলো কেন? কেন পরিবহন বন্ধ করা?

বিএনপির সমাবেশ বন্ধ করতে ক্ষমতাসীনরা এখন যেসব যুক্তি দেখাচ্ছেন, ক্ষমতায় থাকতে বিএনপিও একই রকম যুক্তি দিয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশ বন্ধ করতে চেয়েছে নানা সময়। কিন্তু তারা সফল হয়নি দুটো কারণে। আওয়ামী লীগ সব সময় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জনস্বার্থে আন্দোলন করেছে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের রয়েছে কমিটেড কর্মীবাহিনী। বিএনপির জনস্বার্থ বাদ দিয়ে শীর্ষ নেতানেত্রীর স্বার্থ নিয়ে রাস্তায় আছে। আর তাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয় বলে কর্মীরাও রাজপথে রক্ত দিতে প্রস্তুত না। কার স্বার্থে তারা জেলে যাবে, রক্ত দিবে!

এদিকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ছাত্রদলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও ছাত্রদল নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পুলিশ তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ পণ্ড করতে হামলা চালিয়েছে। পুলিশ বলেছে, তাদের ওপর ছাত্রদলের কর্মীরা ইটপাটকেল ছুড়েছে। এখানেও পুলিশের যুক্তি দিয়েছে, সমাবেশের অনুমতি নেওয়া হয়নি।

ওই প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বলেছেন, পুলিশ চরম ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। প্রেসক্লাবে অল্প কয়েকজন পুলিশ ঢুকেছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। প্রেসক্লাবের ভেতরে যেন বহিরাগত ব্যক্তিরা ঢুকতে না পারে, সে দায়িত্ব প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এই ইস্যুতে আমি একমত পোষণ করি যে, প্রেসক্লাবের ভেতরে যাতে বহিরাগত ব্যক্তিরা ঢুকতে না পারে, সেই দায়িত্ব প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। প্রেসক্লাবের দিকে তাক করে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া, ভেতরে ঢুকে প্রেসক্লাবকে অনিরাপদ করার অধিকার যেমন পুলিশের নেই, তেমনি প্রেসক্লাব থেকে পুলিশকে লক্ষ করে ইটপাটকেল মারাও সমর্থনযোগ্য নয়। প্রেসক্লাবের ভেতরে যদি আন্দোলনকারীরা বিশেষ কোনও পরিস্থিতিতে আশ্রয় নেয়, সেটাও মহা-অপরাধ বলে আমি মনে করি না। প্রেসক্লাব সবক্ষেত্রে জনতার আশ্রয়স্থল হোক। কিন্তু আশ্রয়ের স্থল থেকে পুলিশকে টার্গেট করে প্রেসক্লাবকে রণক্ষেত্র বানানো মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। এটা আশ্রয়স্থলকে অনিরাপদ করা, আশ্রয়দাতাদের অপমান করা।

আমি দেখেছি, এই ঘটনা নিয়ে বিএনপিপন্থী লোকেরা সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু ছবি পোস্ট করেছে, যার সবই পুলিশি অ্যাকশনের কিন্তু বিপরীত চিত্র নেই। তাদের কেউ কেউ এমন সুর তুলেছেন যে প্রেসক্লাবকে অপবিত্র করে গিয়েছে পুলিশ। প্রেসক্লাবের ভেতর থেকে দলবেঁধে পুলিশকে ইট মারার দৃশ্য তারা পোস্ট করেনি, যেটা করেছে অন্য পক্ষ। কিন্তু অনেকে ভুলে গেছেন যে ১৯৯২ সালের ২১ জুন এই পুলিশ বাহিনী শুধু প্রেসক্লাবের আঙ্গিনায় নয়, অভ্যন্তরে ঢুকে জনে জনে সাংবাদিকদের পিটিয়েছে। সাংবাদিকরা বড় বড় বাঁশের লাঠি দিয়ে, বা ইট মেরে পুলিশ পেটানোর চেষ্টা করেনি। সেই সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। তার বিচার এখনও হয়নি। আমরা এমন দৃশ্য আর কোনও আমলেই দেখতে চাই না।

বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালের যখন প্রেসক্লাবের সামনে জনতার মঞ্চ হয়েছিল, বিএনপি সমর্থক সাংবাদিকরা তখন প্রেসক্লাবের নেতৃত্বে। জনতার মঞ্চ ভেঙে এবং মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিমের মতো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পুলিশ মারলেও কেউ তখন প্রেসক্লাবে আশ্রয় পায়নি। পুলিশ জনতার মঞ্চ ভাঙার পর আবারও একই স্থানে মঞ্চ তৈরি করেছিল আওয়ামী লীগ। বিএনপিকে এখন সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে হলে তার প্রয়োজনীয়তা জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে। অন্যের আশ্রয়ে নয়, নিজের শক্তিতে আন্দোলন করতে হবে। সরকার কর্তৃত্ববাদী হলেও দেশকে এগিয়ে নেওয়ার, নাগরিকদের হেফাজত করার ক্ষমতা থাকলে জনগণ সেই সরকারকে সহ্য করে যায়। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী না হলেও অকর্মন্য, দুর্বল, দুর্নীতিবাজ কাউকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সিলিং ফ্যানের যত্নে ৬ টিপস
সিলিং ফ্যানের যত্নে ৬ টিপস
ঢাকা লিগের কারণে জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে খেলবেন না সাকিব!
ঢাকা লিগের কারণে জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে খেলবেন না সাকিব!
ইসরায়েলের আকরে শহরে হামলার দাবি করলো হিজবুল্লাহ
ইসরায়েলের আকরে শহরে হামলার দাবি করলো হিজবুল্লাহ
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ