X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘কী একটা অবস্থা!’

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১০ মার্চ ২০২১, ১৬:০৩আপডেট : ১০ মার্চ ২০২১, ১৬:২২

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাটে আওয়ামী লীগের এই দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কিরের মৃত্যুর তিন সপ্তাহ না যেতেই মঙ্গলবার রাতে আবারও সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ১১ জন। গুরুতর আহত ছাত্রলীগ নেতা জাকির হোসেনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হচ্ছে। বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের স্থগিত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমানের (বাদল) সমর্থকদের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়।

এর আগের দিন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াত খানের একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে অনলাইনে। ছেঁড়া পাঞ্জাবি পরা আহত এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। বসুরহাটের রুপালি চত্বরে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের পাশে এ ঘটনা ঘটে এবং খিজির হায়াত খান অভিযোগ করেছেন, পৌর মেয়র মির্জা আবদুল কাদের তার ওপর হামলা করেছেন। একই দিনে মির্জা কাদেরের বক্তব্যও পাওয়া যায়, যেখানে তিনি তার ভাইয়ের সমালোচনা করেছেন। একটি পত্রিকায় এ খবরের নিচে পাঠকের মন্তব্য- ‘কী একটা অবস্থা আওয়ামী লীগের! নিজেরা নিজেরাই’।

সত্যি 'কি একটা যেন অবস্থা'। মির্জা আবদুল কাদেরের ভোকাল টনিক টাইপ কথাবার্তা কিছু দিন মানুষকে পুলকিত করলেও এখন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তিনি আসলে কী চান– দলীয় শৃঙ্খলা নাকি দলের ভেতর বিদ্রোহ।

প্রান্তিক পর্যায়ে অনেক জেলা উপজেলায় এবং বিভাগে শাসক দলের ভেতর বিবাদ এবং বিবাদকে কেন্দ্র করে সহিংসতা দেখছি আমরা। সারা দেশেই এখন আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ। কোনও জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগ আর এক আছে বলে মনে হয় না। এক আওয়ামী লীগে কত যে ভাগ। উপদলীয় কোন্দলে আওয়ামী লীগ ক্ষত-বিক্ষত। মুখে যদিও বলা হয়, তারা সবাই বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী কিন্তু বাস্তবে তারা অনুসরণ করেন বা সোজা বাংলায় বলা যায় 'চামচামি' করেন স্থানীয় কোনও না কোনও নেতাকে। এবং এই নেতা কেন্দ্রিক ক্ষমতাচর্চা থেকেই পক্ষ ও প্রতিপক্ষ।

আওয়ামী লীগের কলহ-কোন্দল সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে খবর থাকছে। বিরোধী দল দুর্বল, তাই দলের ভেতর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যেই বিবাদে জড়াচ্ছেন নেতাকর্মীরা।

বরাবরই বাংলাদেশের রাজনীতির সুনাম হলো সহিংসতা। এক দলের প্রতিপক্ষ আরেক দলের লড়াই, সংঘর্ষ স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এক দলের ভেতর যখন অনেক দল গড়ে ওঠে তখন পরিস্থিতি বেশি উত্তপ্ত হয়। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বেগ পেতে হয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। একরামুল করিম চৌধুরীকে সামলাবে না মির্জা কাদেরকে প্রতিহত করবে– সে এক বড় জটিল অঙ্ক নোয়াখালীতে পুলিশের জন্য। এমন অঙ্ক প্রায় প্রতিটি জনপদে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে, কারণ সবাই চায় মার্কার দখল নিতে।

আধিপত্য বিস্তারের জন্য নেতাদের যে উদগ্র বাসনা তার মধ্যেই নিহিত আছে সহিংসতা। যেকোনও জীবনে সংঘাত ও সহিংসতা হতে পারে। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায়, জাতি বনাম জাতি— এসব নানাভাবে হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ। এসব দ্বন্দ্ব নিরসন করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু সহিংসতা যদি সরকারি দলের রাজনৈতিক অনুশীলন হয়ে দাঁড়ায় তখন সেটা থামাবে কে?

ব্যাপক জনভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ এখন টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায়। অনেকেই বলছেন, বেশি দিন ক্ষমতায় থাকায় দলের ভেতর সংহতির শক্তিতে বেশ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে দল, উপদল। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন নেতা ও তাদের গোষ্ঠী। এর সুযোগ নিচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা যতটা ক্ষমতার চর্চা করছে, ততটা করছে না রাজনৈতিক চর্চা। এটাই রাজনীতিতে পেশাদারিত্বের অভাব। এতে করে ভেতর থেকে মেধাশক্তি এবং চিন্তাশক্তির ক্ষয় ঘটছে, ত্যাগী নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে নিষ্ক্রিয় হচ্ছেন বা দল ছাড়ছেন।

এমনিতেই বিশ্বব্যাপী নানা কারণে মৌলবাদী শক্তি রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে গেছে অনেক দেশে। অনেক সংগঠিত অপশক্তি যখন মৌলবাদী শক্তির হাতিয়ার হয়ে উঠছে, তখন ভয়ের কারণ হয় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী শক্তির ভেতরকার এই চিত্র। আমাদের মতো দেশে, বিশাল জনসংখ্যা যার মাথাব্যথার কারণ, সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা যদি শাসক দলের কারণে নষ্ট হয়, তাহলে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সবকিছু দমন করা সহজ নয়।

হয়তো দলের উপরের পর্যায়ের অনেকেই এই সত্যটা বুঝতে পারছেন। হয়তো তারা বিপন্নও বোধ করছেন। কিন্তু কোনও উদ্যমী উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। এসব ঘটনা মানুষের ভেতর নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি করে, অসহিষ্ণুতাকে উসকে দেয়।

আওয়ামী লীগের মতো দলের ঐক্যবন্ধন এক বড় শক্তি। একবার যদি তা আলগা হতে শুরু করে, তবে সমূহ বিপদ। মানুষের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে জাগানোর কাজ করছে একটি শক্তি। নিজেদের স্বার্থেই। জঘন্য কুরুচিকর ভাষায় চলে এর প্রচার। ইউটিউবে, ফেসবুকে চলছে এদের মাতম। সারাদেশে বিভিন্ন মাহফিলের নামেও চলছে এসব কাণ্ড। কে কত বেশি জঘন্য ভাষা ব্যবহার করতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে। মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক উপকরণ যাদের রাজনীতির পুঁজি তাদের হাত শক্তিশালী হয় শাসক দলের কোন্দল আর সহিংসতায়।

কিছু কিছু ঘটনায় আমরা দেখেছি কতটা ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতার শত্রুরা। সময় এসেছে সেটা নিয়ে ভাববার। দলের ভেতর আওয়াজ তোলা। দরকার কে কোথায় ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করছে, কে কোথায় হিংসার আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি বজায় রাখছে তার হিসাব নেওয়া, নিজেদের মধ্যে লড়াই করা নয়।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ