X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২

বাঙালির আত্মা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৭ মার্চ ২০২১, ১৪:১৯আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২১, ১৪:১৯

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
‘ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বলবো আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে।’– এমন কথা যিনি বলেছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে, সেই মানুষই-তো বাঙালির আত্মা। আজ তাঁর ১০১ তম জন্মবার্ষিকী।

তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ ভাবা যায় না। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সে কারণেই অভিন্ন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেট পৃথিবী থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গেছে, কিন্তু বাঙালি থেকে কখনও তাঁকে ছিন্ন করা যায়নি। মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু যেন আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছেন। তাঁকে যতবার খাটো করার চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই তিনি আরও বেশি মাথা উঁচু করে স্বমহিমায় দীপ্ত হয়েছেন। যারা তাঁকে ছোট করার চেষ্টা করেছে তারাই আসলে অনেক বেশি খর্ব হয়েছে।

রাজনীতিবিদ মুজিবের অনেক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা যায়। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, আমাদের সামাজিক পরিসরের বুননে শেখ মুজিবের উপস্থিতি সবসময় অমোঘ অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে।

একটা মানুষ মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে ৩০৫৩ দিন কারাভোগ করেন। ব্যক্তিগত কোনও অপরাধে নয়। বারবার তিনি কারাগারে গেছেন মানুষের কথা বলতে গিয়ে, দেশের কথা বলতে গিয়ে, জাতির কথা বলতে গিয়ে। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের রাজনীতির সাধনার মূলে অন্যতম আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবাদ। এই দুটি আদর্শে তিনি নিজে চলেছেন আজীবন এবং তাঁর নামে পরিচালিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধও। প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর নিজের ধর্ম মেনে চলার সম্পূর্ণ অধিকারের কথা বলেছেন বারবার। এটাই বঙ্গবন্ধুর দর্শন। আজ জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে একথাই বারবার বলতে হচ্ছে যে, দেশ যেন না চলে ধর্ম, বা ধর্মের নামে প্রচলিত আচারের অন্ধ অনুশীলনে।

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ স্মরণ করা যেতে পারে। বলেছিলেন, ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনও দিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা এখানে মুসলমান আছেন তারা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন তিনি রাব্বুল আলামিন। রাব্বুল মুসলেমিন নন। হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক সমস্ত মানুষ তাঁর কাছে সমান। সেই জন্যই এক মুখে সোশ্যালিজম ও প্রগতির কথা এবং আরেক মুখে সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চলতে পারে না’।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিকে তার গৌরবময় জীবনের সন্ধান দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনও ক্ষুদ্র রাজনীতি করেননি। মানুষ হিসেবে মানুষকে দেখার যে রাজনীতি, কোনও ধর্ম বা অন্য পরিচয়ে নয়, এমন নেতা আর আসেনি এ ভূখণ্ডে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পুরো সময়টাতেই এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করেছেন। ১৯৪৬ সালে সংঘটিত কলকাতা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামাতে মহাত্মা গান্ধী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মিলে বয়সে তরুণ শেখ মুজিব ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ বলছেন, ‘এই সময় শহীদ সাহেবের সঙ্গে কয়েক জায়গায় আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে শহীদ সাহেব হিন্দু-মুসলমান শান্তি কায়েম করার জন্য কাজ করেছিলেন।’ এ বইতেই তিনি বলছেন, “আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না”।

মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারীদের সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করা সবাই পারে না। বঙ্গবন্ধু যা বিশ্বাস করতেন, জীবনাচরণে তার প্রতিফলন দেখাতে চাইতেন। নেতৃত্বের একটা অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হলো সাহস। মানুষের জন্যে বঙ্গবন্ধুর যেমন মমতা ছিল, তেমনই ভালোবাসা ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্যে। আর সংস্কৃতিবান মানুষ কখনও সাম্প্রদায়িক হতে পারে না।

বঙ্গবন্ধু নিজেকে সবসময় বাঙালি বলে পরিচয় দিতেন। এই বাঙালি শব্দটি ছিল জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক পরিচয়। এবং সে কারণেই মুসলিম লীগের ছাত্র নেতা মুজিব হয়ে উঠলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের নেতা। তবে একটা কথা বলতেই হয় যে, তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধর্মকে বাদ দিয়ে ছিল না। তাঁর কাছে অসাম্প্রদায়িকতা ছিল সব ধর্মের মাঝে একতা।

জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে দরিদ্র মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠার করা সম্ভব হতে পারে, এমন একটা চিন্তা থেকে শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনে গিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার প্রতি পাকিস্তানের মনোভাব, শোষণ এবং ভাষা আন্দোলন তাঁকে ভিন্ন এক চিন্তার জগতে নিয়ে যায়। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের ওপর যে আঘাত- এগুলোকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু খুব দ্রুত তার পরিণত বয়সে ধর্মনিরপেক্ষতার পথে আকৃষ্ট হন।

পাকিস্তানের রাজনীতি পূর্ব বাংলার জন্য ক্ষতিকর, একটা পরিবর্তন দরকার – মূলত এই ভাবনাই ছিল সবচেয়ে বড় ভাবনা তাঁর ভেতর। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ও সে সময়ের পশ্চিম পাকিস্তানি সমাজের যে বুনন তা ছিল ভয়ংকর প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক। এসব দেখেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকে পা বাড়ান মুজিব যা তাঁকে পরিণত করে অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাঙালির সবচেয়ে বড় মানুষ হিসেবে।

আজ সমাজের মধ্যে আবার সাম্প্রদায়িক অপশক্তি নানা ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। জাতির পিতার নেতৃত্বে একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তাঁর জন্মশত বার্ষিকীতে প্রত্যাশা এই যে, তাঁর দল এসব অপতৎপরতা রুখে দেওয়ার মতো রাজনীতির চর্চা যেন করে ক্ষমতা ও আধিপত্যের চর্চা থেকে বেরিয়ে এসে।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অসহায় মা-মেয়ের সরকারি চাল খেয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা
অসহায় মা-মেয়ের সরকারি চাল খেয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা
নীরবে কাঁদেন আবু সাঈদের বাবা-মা, দেখতে চান ছেলে হত্যার বিচার
নীরবে কাঁদেন আবু সাঈদের বাবা-মা, দেখতে চান ছেলে হত্যার বিচার
ফিরে দেখা: ২ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ২ জুলাই ২০২৪
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
সর্বশেষসর্বাধিক