X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

হেফাজত কি নতুন মহামারি?

আবদুল মান্নান
০৯ এপ্রিল ২০২১, ১১:৫৪আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২১, ১৭:১১

আবদুল মান্নান ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় অবস্থিত হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় (আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদ্রাসা) গঠিত হয়েছিল হেফাজত-ই ইসলাম নামের একটি কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সেই মাদ্রাসার প্রধান, বর্তমানে প্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফী। এটি দেশের অন্যতম পুরাতন একটি মাদ্রাসা, যেটি ভারতের দেওবন্দ তরিকায়  চলে। তফাৎ হচ্ছে, দেওবন্দে যারা পড়ালেখা করেন তারা ভারতে ইসলামের নামে কোনও সন্ত্রাস বা সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারেন না, যদিও ভারতে মুসলমানের সংখ্যা বিশ কোটিরও বেশি। এটি ব্রিটিশ আমলে ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজদের সহায়তায়। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সালাফি (কট্টর মৌলবাদ) মতাদর্শ প্রচার করা, যার মূলে ছিল অসহিষ্ণুতা, জোরপূর্বক নিজস্ব মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়া, যা ইসলাম কখনও অনুমোদন করে না। আল্লাহর নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) থেকে শুরু করে ইসলামি শাসকরা বিভিন্ন সময় বিশ্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করেছেন  কিন্তু কোথাও জোরপূর্বক কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়ার উদাহরণ নেই। ইসলামের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল ওসমানিয়া (তুর্কি) সাম্রাজ্য। উত্তর আফ্রিকা থেকে ইউরোপ পর্যন্ত। সাত শত বছর তারা এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করেছে কিন্তু জোরপূর্বক কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়ার কোনও উদাহরণ তারা সৃষ্টি করেননি, এমনকি জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতও না। ইসলামকে হেফাজত করার মালিক স্বয়ং আল্লাহ। চৌদ্দশত বছর ইসলামকে তিনিই হেফাজত করেছেন, সেখানে ইসলামকে হেফাজত করার দায়িত্ব হেফাজত-ই-ইসলামকে কে দিলো তা একটা বড় প্রশ্ন। শুরুতে ঘোষণা করেছিল তারা একটি অরাজনৈতিক সংগঠন এবং তাদের একমাত্র কাজ মানুষকে ইসলামের পথে আনা। কিন্তু কিছু দিন না যেতেই তারা হয়ে গেলো শুধু একটা রাজনৈতিক সংগঠনই নয়, বরং একটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী সংগঠন। আর তারা তাদের এই সন্ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য ব্যবহার করে মাদ্রাসার এতিম ছাত্রদের।

হেফাজতের জন্ম নারী বিদ্বেষ দিয়ে। সরকার যখন ২০০৯ সালে নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করলো তখন প্রথমবারের মতো হেফাজত তাদের অস্তিত্ব জানান দিলো। ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি হেফাজত নারী নীতিকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে সভা করার ঘোষণা দিলো। তা শুনে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও একসময়ের জননন্দিত মেয়র  আলহাজ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ঘোষণা দিলেন, চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় (শহরে প্রবেশমুখ) পার হলে আর কেউ পা নিয়ে ফিরতে পারবে না। এক কথায় হেফাজত চুপসে গেলো। হলো না তাদের আর সেই ঘোষিত জনসভা। বর্তমানে তো বাংলাদেশে ঘরে ঘরে আওয়ামী লীগের নেতা কিন্তু তেমন কোনও নেতা দেখা গেলো না যে হেফাজতের সামনে দাঁড়াবে। বরং খোঁজ নিলে জানা যাবে অনেক নব্য আওয়ামী লীগ সমর্থক হেফাজতকে হেফাজত করার দায়িত্ব পালন করেন। গত কিছু দিন ধরে হেফাজত ইসলাম হেফাজতের নামে দেশে যে তাণ্ডব চালাচ্ছে, মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে দেশে তারা একটা ‘দ্বৈত সরকার’ চালু করেছে। সর্বশেষ সরকার ঘোষণা দিলো দেশের এতিমখানা ছাড়া সব মাদ্রাসা বন্ধ থাকবে। একই সাথে পরীক্ষাও বন্ধ থাকবে। কে শোনে কার কথা। সব মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষা চলছে। ভাবখানা এমন, সরকার এসব নির্দেশ দেওয়ার কে? 

হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠালগ্নে তারা নেজামে ইসলামের অনুসারি ছিল। ১৯৭১ সালে এই মাদ্রাসা ছিল চরম স্বাধীনতা বিরোধী এবং পরবর্তীকালে চরম আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী। বঙ্গবন্ধুবিরোধী হওয়ার অন্যতম কারণ, তাদের মতে বঙ্গবন্ধুর কারণেই তাদের সাধের পাকিস্তান ভেঙে গেছে। তারা বর্তমানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান অথবা তালেবানি আফগানিস্তান বানাতে চায়। আর তাদের সঙ্গে এখন একাত্ম হয়ে গেছে জামায়াত শিবির ও কিছু সর্বদা বিভ্রান্ত বাম সংগঠন। বিএনপি থেকেও তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত পাচ্ছে।

১৯৭৩ সালের পর আওয়ামী লীগ কখনও হাটহাজারী আসন হতে কোনও সংসদ নির্বাচনে জিততে পারেনি। দীর্ঘ সময় ধরে এই আসনে বিজয় হয়েছে একাত্তরের ঘাতক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ডান হাত বলে পরিচিত বিএনপি নেতা সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম। বর্তমানে জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এই আসনের সংসদ সদস্য। হাটহাজারী উপজেলায় প্রায় শ’খানেক কওমি মাদ্রাসা আছে, বলা যেতে পারে এটি বাংলাদেশের মাদ্রাসার রাজধানী। এ উপজেলার অনেক মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত। তারা প্রায়  প্রত্যেকেই এসব মাদ্রাসায় নিয়মিত কোটি কোটি টাকা দান করেন, যার একটি বড় অংশ আসে রমজান মাসে জাকাত ফিতরা হিসেবে। এটি মোটামুটি সারা দেশের চিত্র। এসব অর্থ আসে মাদ্রাসা সুপারের নামে এবং তার কোনও হিসাব নেই, কখনও কোনও পাবলিক অডিট হয় না। এর ফলে এই অর্থের একটি বিরাট অংশ যায় এসব সুপারের নিজের পকেটে। যেসব মাদ্রাসা একটু পুরনো তাদের সুপারের অর্থের হিসাব নিলে জানা যাবে তারা এই অর্থ কীভাবে খরচ করেছে, নিজেদের নামে কত জমির বা ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছে। বিলাসবহুল গাড়ি আছে ক’জনের। আর ক’জনের ক’টি স্ত্রী আছে। এসব মাদ্রাসার সুপাররা রমজান মাসে প্রায় সকলে সৌদি আরবে চলে যান সেখানে বসবাসরত বাঙালি শ্রমিক ও পরিচিত সৌদি ব্যবসায়ীদের কাছ হতে জাকাত আর ফিতরার টাকা আদায় করতে। এটি আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আর যারা এসব দান খয়রাত করেন, সম্ভবত তার একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হচ্ছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। 

গত দশ বছরে হেফাজত ফুলেফেঁপে এবং কিছুটা সরকারি আসকারা পেয়ে বর্তমানে অনেকটা বেপরোয়া। কওমি মাদ্রাসায় পড়ে সাধারণত গরিব এতিম ছেলেমেয়েরা। বর্তমানে অবশ্য অনেক বিত্তবানদের সন্তানরাও এসব মাদ্রাসায় ভর্তি হচ্ছে। অনেককে বলতে শুনেছি, ‘আমার তিন ছেলের মধ্যে একজনকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছি’। তারা মনে করেন ওই ছেলের বা মেয়ের কাঁধে চড়ে তারা বেহেশতে যাবেন। কিন্তু কওমি মাদ্রাসায় সত্যিকারের অর্থে পড়ালেখা হয় কিনা তা তারা খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করেন না। এসব মাদ্রাসায় শুধু আরবি ও উর্দু ভাষায় রচিত কিছু কিতাব পড়ানো হয়। অষ্টাদশ শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত সময়কালকে ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এই সময় বাগদাদ, কায়রো আর স্পেনের করডোভার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (তখনকার দিনের মাদ্রাসা বলা যেতে পারে) বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী তৈরি করেছিল। কারণ, তখন এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা হতো, যা এখন সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আবু আল কাসিমকে আধুনিক শৈল্যবিদ্যার জনক বলা হয়। ইবনে খালেদুনের সমকক্ষ সমাজতত্ত্ববিদ, অর্থনীতিবিদ, ইবনে সিনার মতো চিকিৎসক, আল বিরুনির মতো ফার্মেসি বিশারদ, আল-খাওয়ারিজমির মতো অংক শাস্ত্রবিদ, আবু রুশদের মতো ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাবিদ, আল ফারাবির বা ইমাম গাজ্জালির মতো দার্শনিক বর্তমান বিশ্বেও বিরল। এরকম অসংখ্য ইসলামি চিন্তাবিদদের কথা বলা যেতে পারে। এখন কেন এমন পণ্ডিতজন দেশের হাজার হাজার মাদ্রাসা হতে বের হয় না? তার একমাত্র কারণ, বর্তমান সময়ের মাদ্রাসাগুলোতে এসব বিশ্বসেরা জ্ঞানীদের কর্ম সম্পর্কে পড়ানো বা জানানো হয় না। বর্তমানে অনেক কওমি মাদ্রাসাগুলো প্রধান পঠন পাঠনের বিষয় হচ্ছে অন্যকে হিংসা, সন্ত্রাসের মাধ্যমে জোরপূর্বক ইসলাম কায়েম, যা কখনও ইসলাম অনুমোদন করে না আর রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা। ইসলামের চিন্তা চেতনাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার মতো এসব মাদ্রাসা শিক্ষকদের তেমন কোনও  যোগ্যতা নেই। বিশ্বে ৫৭টি মুসলমান প্রধান দেশ আছে (ওআইসি সদস্য)। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ছাড়া জানা মতে অন্য কোনও দেশে ইসলামের নামে এমন সন্ত্রাস করা হয় না বা এমন ধরনের সন্ত্রাসী সৃষ্টি করার কওমি মাদ্রাসাও নেই। প্রায় কোনও দেশেই ইচ্ছা করলেই যেখানে সেখানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা যায় না বা এমনকি ইমামও হওয়া যায় না। বাংলাদেশে কিছু আরবি পড়ে যেভাবে সহজে আল্লামা আর ওলামা মাশায়েক হওয়া যায়, তা অন্য যেকোনও দেশে অসম্ভব।

তুরস্ককে বর্তমান মুসলিম দুনিয়ার অন্যতম পরাশক্তি বলা হয়। দেশটির ৯৯ শতাংশ মানুষ মুসলমান। মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ককে আধুনিক তুরস্কের জনক বলা হয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে আতাতুর্কের মতাদর্শের ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এরদোগান আতাতুর্কের আমলে রচিত ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান পরিবর্তন করেননি। কামাল আতাতুর্কের পূর্বে তুরস্কের সংবিধানে তুরস্ক একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে বর্ণিত হতো এবং সংবিধানে লেখা ছিল ‘রাষ্ট্র ধর্ম হবে ইসলাম’। কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতা নিয়ে সংবিধান থেকে এই ধারা বাতিল করে দেন এবং বলেন তুরস্ক হবে আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত এই ধারাটি বলবৎ আছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হতে বলতে পারি, মুস্তাফা কামাল বিরোধী এরদোগানের শাসনকালে আমার তুরস্ক ভ্রমণের সময় আমি তুরস্কের মতো এত শক্তিশালী মুসলমান প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও এত উদার চিন্তার দেশ আছে বলে মনে হয়নি। সেখানে ইসলাম ধর্ম হেফাজত করার জন্য কোনও হেফাজত-ই-ইসলামের প্রয়োজন হয়নি। বাংলাদেশে যেখানে সেখানে মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মাণ করা যায় নিজের ‘ধান্ধা’ চরিতার্থ করার জন্য,  হতে পারে তা অন্যের বা সরকারি জমির ওপর। তুরস্ক বা এমনকি অন্যান্য মুসলমান প্রধান দেশেও তা সম্ভব নয়। করতে হলে সরকার থেকে তার অনুমতি লাগবে। অনুমতি দেওয়ার আগে সরকার যাচাই করে দেখবে ওই এলাকায় মসজিদের প্রয়োজন আছে কিনা। ইন্দোনেশিয়া (বিশ্বের বৃহত্তম মুসলমান প্রধান দেশ) বা মালয়েশিয়াতেও একই নিয়ম। হজরত মুহাম্মদ (সা.) শুধু আল্লাহর নবী ছিলেন না, তিনি রাষ্ট্রপ্রধানও ছিলেন। তাঁর রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস ছিল। তিনি কখনও তাঁর শাসিত রাষ্ট্রকে ‘ইসলামিক রাষ্ট্র’ ঘোষণা করেননি বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালনে বাধা দেননি। আল্লাহ পবিত্র কোরআন শরিফে বলেছেন, যার যার ধর্ম তার তার।

বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসায় পড়ে ভালো চাকরি পাওয়া অসম্ভব। কারণ, যারা এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ে তারা হয়তো ভালো আরবি পড়তে পারে কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরাই তার কোনও অর্থ জানে না। বর্তমানে যাদের বিভিন্ন মাহফিলে বক্তৃতা বা বয়ান করতে শোনা যায় তারা প্রায়শ দু’লাইন আরবি পড়ে তার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করায়, যার সঙ্গে মূল বিষয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। তাদের বেশিরভাগের বক্তৃতার বিষয় হচ্ছে নারী। একজন তো এক বক্তৃতায় বলেই  দিলেন নারী হচ্ছে আল্লাহর গজব (নাউজুবিল্লাহ)। সেই ব্যক্তি ভুলে গেছেন তার মা, স্ত্রী  বা কন্যাও একেকজন নারী।

ফিরে আসি তুরস্কের কথায়। ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত ব্লু মস্কে জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছি। ঢোকার আগ মুহূর্তেই একটি গাড়ি এসে থামলো এবং সেখান থেকে এক ব্যক্তি জোব্বা আর পাগড়ি পরে নামলেন। আমার সঙ্গের গাইড জানালেন তিনি জুমার নামাজ পড়াবেন। তুরস্কে যারা মসজিদে ইমামতি করেন তারা সকলেই সরকার থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং ‘ইমাম হাতিপ’ স্কুলের (ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র) গ্রাজুয়েট। এই প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। মুস্তাফা আতাতুর্ক এসব প্রতিষ্ঠানকে ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেন এবং সেখান হতে পাস না করলে কেউ মসজিদের ইমাম হতে পারবেন না। যারা এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পড়ালেখা করেন তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামের মনীষীরা কী অবদান রেখেছেন তার বিস্তারিত পড়েন এবং মসজিদে যখন খুতবা দেন বা অন্য কোনোখানে ইসলাম সম্পর্কে বলেন সেখানেও সেই বিষয় সম্পর্কে বলেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের অধিকাংশ ইমাম, যারা কওমি মাদ্রাসা হতে পাস করে বের হয়েছেন, তারা লাগামহীনভাবে অর্থহীন কথাবার্তা বলেন। এরদোগান মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের রাজনীতির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করলেও তুরস্কের চারদিকে স্থাপিত তাঁর কোনও ভাস্কর্যে হাত দেননি। কারণ, তিনি বোঝেন কোনটি ভাস্কর্য আর কোনটি মূর্তি। আর মূর্তি হলেও তাতেও হাত দেননি। ব্লু  মস্কের ভেতরের দেয়ালে বেশ বড় বড় করে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে কী উল্লেখ আছে তা খোদিত আছে। হিন্দুদের বেদ হতে শুরু করে বৌদ্ধদের ত্রিপিটক কোনও কিছুই বাদ যায়নি। তোরা, বাইবেল আর পবিত্র কোরআন শরিফ তো আছেই। তুরস্ক সফরের সময় দেখেছি সেই দেশে বাংলাদেশের মতো অর্ধশিক্ষিত কাটমোল্লাদের কোনও দৌরাত্ম্য নেই বা কাটমোল্লা হওয়ার সুযোগও নেই। ঈদেও নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে। ইমাম সাহেব খুতবা দিলেন তুর্কি ভাষায়। সঙ্গী গাইড জানালেন তিনি শাসক হজরত উমরের (রা.) কথা বলছেন।

হেফাজত নিয়ে আরও লেখার ইচ্ছা ছিল। অন্য সময় লিখবো। এই মুহূর্তে বলতে পারি তারা কোনও ধর্মীয় সংগঠন নয়। তারা পবিত্র ইসলাম ধর্মকে পুঁজি করে ধর্মভীরু মানুষকে বোকা বানিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে পরিণত নিজেদের আখের গোছাতে চায়। তাদের বিশ্বাস করে বর্তমান সরকার অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে সুতরাং তারা যাই করে তাই জায়েজ। তারা সরকারের শক্তিকে ভুল বুঝেছে, যে কারণে তারা বাংলাদেশের জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ বানচালের পরিকল্পনা করেছিল। কোমলমতি শিশুদের রাস্তায় নামিয়ে তাদের বিপদের সম্মুখীন করেছিল। অনেকে বলেন এরা ইসলামি দল। বাস্তবে এরা হচ্ছে একদল সন্ত্রাসী, যারা জোব্বা পরে দাঁড়ি টুপি রেখে ইসলামকে অপমানিত করে আর রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে। এই সন্ত্রাসীরা সরকার থেকে অনেক আস্কারা পেয়ে মাথায় উঠেছে। এখন সময় হয়েছে তাদের মাথা থেকে নিচে নামানো। বুঝিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রের হাতের চেয়ে কারও হাত লম্বা নয়।

সাম্প্রতিককালে সন্ত্রাস সৃষ্টির পেছনে অজুহাত হিসেবে হেফাজত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে সামনে এনেছে। এসব নাদান কী জানেন প্রতি বছর ১৫ লক্ষ বাংলাদেশি ভারতে যায়, যার মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ যায় চিকিৎসা নিতে। ভারত যদি বলে কোনও বাংলাদেশি আর ভারতে চিকিৎসা নিতে আসতে পারবে না তাহলে পরদিনই মাতম উঠবে। বলেছি ভারতে বিশ কোটি মুসলমান বাস করে। ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা যদি তাদের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর নিয়ে হেফাজতি সন্ত্রাসীরা যে তাণ্ডব চালিয়েছে সেই অজুহাতে ভারতের এই মুসলমানদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়, তাহলে তা কি এই হেফাজতিরা ঠেকাবে?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সরকার প্রধান হিসেবে আপনি অনেক সহ্য করেছেন। এখন হেফাজতিদের বুঝিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে দেশ চালায় কে। কিছু ইসলামের লেবাসধারী দুর্বৃত্তকে আইনের আওতায় আনলে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। এমনিতে দেশ করোনা মহামারিতে জেরবার। এই সময় হেফাজত নামক একটি সন্ত্রাসী সংগঠনকে মহামারি হিসেবে আবির্ভাব হতে দেওয়া যায় না।   

 

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পহেলা বৈশাখের নির্দেশনা উপেক্ষা উদীচীর: যা বলছে ডিএমপি
পহেলা বৈশাখের নির্দেশনা উপেক্ষা উদীচীর: যা বলছে ডিএমপি
সিডনির গির্জায় ছুরিকাঘাতকে সন্ত্রাসী হামলা ঘোষণা
সিডনির গির্জায় ছুরিকাঘাতকে সন্ত্রাসী হামলা ঘোষণা
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১২ জনের
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১২ জনের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ