X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার করুণ কাহিনি: মৃত্যু ও কুরুচির মহাপ্লাবন

মাকসুদুল হক
১৮ এপ্রিল ২০২১, ১১:৫১আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২১, ১৮:১৩

মাকসুদুল হক “যে যার কাজে ব্যস্ত হবে দুদিন পরে
এই পৃথিবীর শোকের আয়ু দ্বন্দ্ব তরে” –কবি কাজী রোজী

করোনার মৃত্যুর ঢেউ এখন সুনামির আকার ধারণ করেছে এবং আমাদের করেছে খুবই ইনসেন্সিটিভ ও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বইছে ‘কুরুচির মহাপ্লাবন’। দিনের পর দিন মৃত্যু নিয়ে আমাদের ফেসবুক পোস্ট তাই প্রমাণ করে। কারণ, ঘুরে ফিরে সবই একইরকম–অর্থাৎ রিপিটেটিভ। বিশেষ করে আমাদের তথাকথিত ক্রিয়েটিভ লোকজনের ক্রিয়েটিভিটির যে চরম ভাটা পড়েছে তা কেবল নয়, তাদের এই মানুষ দেখানো শোক প্রমাণ করে যে তারা মনুষ্যত্বও ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন। তাই অন্যরা মৃত্যু নিয়ে কী লিখছেন তারই ‘ছায়া অবলম্বনে’ নিজেরা লিখে যাচ্ছেন ও ক্ষেত্রবিশেষে ‘কাট অ্যান্ড পেস্ট’-ও করছেন। এখানে তো কপিরাইট ভঙ্গের কোনও সমস্যা নেই–আর ‘আফ্টারঅল একজনের মৃত্যু নিয়ে লিখছি- কে চেক করতে যাবে?’ কী দারুণ একটা ব্যাপার– তাই না?

তাই কিছু স্মৃতিচারণ, নিজের আবেগ ও দুঃখ কষ্ট প্রকাশ,  কিছু দোয়া, কিছু ‘ওপারে ভালো থাকবেন’ বা ‘এভাবে চলে গেলেন’ বা ‘আর নিতে পারছি না’ মার্কা অনুভূতি ছাড়াও মৃত ব্যক্তির সঙ্গে শেষ তোলা ছবি বা সেলফি ছাপানো যেন এই সামাজিক যোগাযোগের যুগে একটা রমরমা সামাজিক রেওয়াজ বা রিচুয়ালে পরিণত হয়েছে।

এসব কোনোটাতেই আমার ব্যক্তিগত আপত্তি বা সমস্যা নেই। আছে কেবল দুঃখ–আমার দুঃখ অন্য জায়গায়।

একটু খেয়াল করে দেখুন তো, কয়েকদিন আগে যারা চলে গেছেন তাদের কত দ্রুত আমরা ভুলতে বসেছি? আমাদের নিউজফিডে ২৪ ঘণ্টারও কম সময় কি ফরিদ আহমেদ, বা মিতা হক, বা ক’দিন আগে আলী জাকের, বা অন্য কোনও কিংবদন্তি চলে যাওয়ার কথা আর মনে আছে? মনে নেই বা মনে থাকার কথাও না। কারণ, চাই বা না চাই আমরা সবাই এই দুর্যোগকালে ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ মানসিক মোড বা প্রক্রিয়ায় বিচরণ করছি।

মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত লোকজন আর বাকি দশজনের মতো মারা যাবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা ভুলে যাই মিডিয়ার লোকজনও মানুষ। তাই আমাদের একেকজনের ফেসবুক স্ট্যাটাস ও পোস্টে আমরা বিষয়গুলো এমনভাবে নিয়ে আসি যাতে মনে হয় আমরা কত হাজার বা কত শত লাইক, শেয়ার, লাভ, স্যাড, কেয়ার এমনকি ‘হাহা’ রিয়্যাক্টের আশায় বসে আছি, সেটাই মুখ্য!  এ যেন মৃত্যুকে ঘিরে এক মিডিয়া টিআরপির বাণিজ্যর রীতিমতো যুদ্ধ চলছে।

তবে, এ যুদ্ধের বীভৎস ও অশ্লীল রূপ বোঝা যাবে (দয়াল আমাদের ক্ষমা করুক) যদি আগামীতে একই দিনে দু’ বা তার অধিক ‘বিখ্যাত’ ব্যক্তি মারা যান। তখন ঠিকই আমরা চলে যাবো নতুন এক দিগন্তে। কাকে ছেড়ে কাকে নিয়ে লিখবো- ছবি ছাপাবো কি ছাপাবো না? 

আমরা সবাই জানি, মিডিয়ার ‘অঘোষিত  ব্ল্যাকলিস্ট’ সবসময় সাংস্কৃতিক আঙিনায় বলবৎ ছিল, আছে এবং সম্ভবত থাকবে। আমরা তখন ‘অমুককে নিয়ে লিখলে তমুক আবার কী মনে করে’, বা ‘ছবি দিলে কি আমাদের ক্যারিয়ারের কোনও ক্ষতি হবে’ এসব চিন্তায় হবো বিভোর।

তার ওপরে রয়েছে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি। কবরী দি যে জন্মগত হিন্দু ছিলেন ও অভিনয় করতেন এ দুই ‘মহাপাপ’-এর জন্য ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, হাসি-তামাশা ও কটাক্ষের কমতি নেই। ওনাকে ‘দাফন’ করা হবে নাকি ‘দাহ’ করা হবে এই নিয়েও চলেছে বিতর্ক। অবশেষে ওনার দাফন কতটা ‘জায়েজ’ হয়েছে সেই আলোচনা আরও অনেক দিন চলবে বলে মনে হচ্ছে। সেসব নিম্ন রুচির ফোরাম ও প্রোফাইলগুলোতেও দেখি কয়েক লাখ লাইক- কী আশ্চর্য!

মোদ্দাকথা, মৃত্যু কখনও বলে-কয়ে আসে না। প্রতিটি মৃত্যুই দুঃখজনক, আর প্রতিটি মানুষ সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে। তবে কথা হলো, যার কোনও খোঁজ-খবর আমরা দু’দিন আগেও নেইনি বা কখনই নেইনি- তাদের মৃত্যু নিয়ে এই লম্ফঝম্প কোনোভাবেই আন্তরিকতা বা সহমর্মিতার স্বাক্ষর বহন করে না, করে ‘কুরুচির’। এই কুরুচি অন্যের ওপরে সংক্রমণ বা ভাইরাল করা কতটা যৌক্তিক বা সেই ‘নাগরিক অধিকার’ আমাদের আদৌ আছে কিনা তা নিজেকেই প্রশ্ন করার সময় এখন চলে এসেছে।

কেউ ভুলে যাবেন না যে, করোনা কোনও তামাশা নয় এবং খুব সহজে আমাদের এ থেকে মুক্তি আশা করা অনুচিত। অনেক মৃত্যু আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে এবং তার জন্য প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি ও তদপুরি মানসিক সুস্থতা। মৃত্যু নিয়ে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়ে দু’কলম লিখতে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। কখনও ভুলবেন না– জীবনের মতো মৃত্যুও একেকজন মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। আমাদের দু’কলম স্ট্যাটাস আরেকজনের ভেতরে প্যানিক সৃষ্টি করবে বা মানসিকভাবে দুর্বল ও ভারাক্রান্ত করবে এ বিষয়ে সবাই সংবেদনশীল থাকবেন বলে আশা করছি। জাতিগতভাবে আমরা সবাই ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হই– এটা মোটেও কাম্য নয়।

শোকবার্তা বা অবিচুয়ারি লেখাও একটা বিশাল শিল্প। বাংলাদেশে হাতেগোনা  দুয়েকজন বাদে এই শিল্পে সিদ্ধহস্ত খুবই কম লোকই আছেন। অতএব, সামাজিক মিডিয়া ছাড়া প্রিন্ট বা অনলাইন মিডিয়ার এই মুহূর্তে দায়িত্ব বহুগুণ বেড়ে গেছে। শোকবার্তাগুলো এমনভাবে তৈরি হোক, যাতে যিনি মারা গেছেন তাঁর জীবন সম্পর্কে আরও পরিপূর্ণ জানতে পারি– এবং সবকিছু যেন হয় ব্যক্তি অনুভূতির; অহেতুক ও অযাচিত ইমোশন-বহির্ভূত।

লেখক: সংগীতশিল্পী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ