বাংলাদেশের রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট ২০১৩ সালের ৫ মে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবিতে সে বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগকে ঘিরে দেশজুড়ে অসাধারণ এক গণজাগরণ ঘটেছিল। দেশের আনাচে-কানাচে তো বটেই, দেশের বাইরেও পৌঁছে গিয়েছিল সেই জাগরণের ঢেউ। সে ঢেউয়ের তোড়ে স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকরা কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিলেন।
গণজাগরণের প্রবল স্রোতে সবাই মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন। মুখে কুলুপ আঁটলেও কুবুদ্ধি থেমে ছিল না। মাহমুদুর রহমানের ‘আমার দেশ’ পত্রিকা আর ফরহাদ মজহাররা মিলে মাঠে নামায় হেফাজতে ইসলামকে। সব মানুষের অংশগ্রহণে মহৎ গণজাগরণকে বলা হয় ‘নাস্তিক ব্লগার’দের আন্দোলন। গণজাগরণ মঞ্চের মূল দাবি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মানে ফাঁসি। আর হেফাজতকে মাঠে নামানো হয় কথিত নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসির দাবি নিয়ে। এভাবেই দাবির ভারসাম্যে গণজাগরণ মঞ্চকে হেয় করা হয়। সামনে আসে ভয়ংকর হেফাজত। এই হেফাজতের জন্ম অবশ্য ২০১৩ সালে নয়। ২০১০ সালে চট্টগ্রামে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক এই সংগঠনটির জন্ম। শিক্ষানীতির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে তাদের আত্মপ্রকাশ। আর পরের বছর বিরোধিতা করে নারী উন্নয়ন নীতির। তবে তারা আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে গণজাগরণের বিরোধিতা করে। প্রথমে তারা ১৩ দফা দাবিতে ঢাকা অবরোধ করে এপ্রিলে। শুধু আমি নই, মুক্তচিন্তার যেকোনও মানুষ স্বীকার করবেন হেফাজতের সেই ১৩ দফা ছিল প্রগতিবিরোধী, নারীবিরোধী, দেশের উন্নয়নবিরোধী, সংস্কৃতিবিরোধী। এপ্রিলে ঢাকায় বিশাল সমাবেশ তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এরপর ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজত আবারও ‘ঢাকা অবরোধ’ করে। এবার তাদের ষড়যন্ত্র ছিল টানা অবস্থান নিয়ে সরকারের পতন ঘটানো। স্বাধীনতাবিরোধী সব অপশক্তি তাদের পেছনে জোট বাঁধে। তারা এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল, রীতিমতো ক্ষমতায় গেলে কে কোন দায়িত্ব নেবেন, তারও ছক কষা হয়ে যায়। দিনভর ঢাকায় তাণ্ডব চালানোর পর তারা অবস্থান নেয় শাপলা চত্বরে। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে সরকারও কঠোর অবস্থানে যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দৃঢ়তায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কৌশলী অভিযানে হেফাজতের সব স্বপ্ন ডুবে যায় শাপলা চত্বরে। অসহায় কর্মীদের রেখে নেতারা আগেই লেজ গুটিয়ে পালান। এমনকি হেফাজত প্রধান আল্লামা শফীও শাপলা চত্বরে আসেননি। রাতেই খালি হয়ে যায় শাপলা চত্বর। কিন্তু সরকার তার এই সাফল্যকে ধরে রাখতে পারেনি। বরং সরকারের ভেতরেরই একটি মহল হেফাজতের সমাবেশের উপস্থিতির জুজুর ভয় দেখিয়ে ভিন্ন খেলা শুরু করে। দেশজুড়ে হেফাজতের বিশাল সমর্থক আছে; বিএনপি-জামায়াতের পর হেফাজতকেও প্রতিপক্ষ বানানো ঠিক হবে না; এমন খোঁড়া যুক্তিতে সরকার হেফাজতকে দমন করার বদলে ‘পোষ মানানো’র নীতি নেয়। নগদ লেনদেন, রেলের জমি লিজ দেওয়ার মতো ঘটনাও শোনা যায়।
এই সুযোগে হেফাজতের অনেক আবদারও মেনে নেয় সরকার। পাঠ্যপুস্তক বদলানো, হাইকোর্ট চত্বর থেকে গ্রিক ভাস্কর্য অপসারণ করা হয়। হেফাজতকে ‘পোষ মানাতে’ সরকার কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দেয়। সেই স্বীকৃতি নিতে আল্লামা শফী আমন্ত্রিত হন গণভবনে। স্বীকৃতি দিলেও কওমি মাদ্রাসার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়নি। তারা রয়ে যায় সকল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তখন অনেকেই দুধকলা দিয়ে হেফাজত নামের কালসাপ পোষার বিপদ সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে বিপদটা আমলে নেয়নি সরকার।
গত বছর হাটহাজারী মাদ্রাসায় জুনায়েদ বাবুনগরী গ্রুপের বিদ্রোহ এবং বিনা চিকিৎসায় আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। সরকারের সঙ্গে হেফাজতের প্রেমের পরিসমাপ্তি ঘটে তখনই। আল্লামা শফীর পর হেফাজতের ক্ষমতায় আসেন উগ্রপন্থী বাবুনগরী। আর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করতে মাঠ গরম করার কৌশল নেন মামুনুল হক। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা দিয়ে শুরু হয় হেফাজতের নতুন পথচলা। তারপর মামুনুল গং একের পর সহিংসতার উসকানি দিতে থাকে। সর্বশেষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে বানচাল করতে মাঠে নামে হেফাজত। এবার তারা ইস্যু বানায় সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে। নরেন্দ্র মোদি এর আগেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হিসেবেই বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন সমস্যা ছিল না। কিন্তু এবার এই নরেন্দ্র মোদির সফরকে ঘিরে দেশজুড়ে মাসব্যাপী ঘৃণা-বিদ্বেষ আর উসকানি দেয় হেফাজত। স্বাধীনতা দিবসে সংঘর্ষ হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়; স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসবে লাগে রক্তের দাগ। এই সংঘর্ষ চলে পরের দুদিনও। এই তাণ্ডবের যবনিকাপাত ঘটে গত ৩ এপ্রিল চলমান সহিংসতার মূল উসকানিদাতা মামুনুল হক পরস্ত্রী নিয়ে নারায়ণগঞ্জের রয়েল রিসোর্টে গিয়ে ধরা খাওয়ার পর। সেদিন তার সমর্থকরা মামুনুলকে ছিনিয়েই নেয়নি শুধু, রয়েল রিসোর্ট এবং সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যাপক ভাংচুর চালায়। রয়েল রিসোর্ট তাণ্ডবের পরেই যেন টনক নড়ে সরকারের। কারণ, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সোনারগাঁয়ে হেফাজতের মূল টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ।
হেফাজতের কর্মীরা বেছে বেছে আওয়ামী লীগের অফিস, নেতাকর্মীদের বাসা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করে। হামলা করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর। কোথাও কোথাও প্রশাসনকে অকার্যকর মনে হয়েছে। অসহায় ছিল ক্ষমতাসীন দলও। নিজেদের ঘাড়ে এসে পড়ার পর সরকার বুঝতে পেরেছে দুধকলা পুষলেও কালসাপ সুযোগ পেলেই ছোবল দেয়। ছোবল খেয়ে এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সরকার।
গত কয়েকদিনে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সুনির্দিষ্ট মামলায় হেফাজতের অন্তত ৫০০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হেফাজত আবার সরকারের সঙ্গে সমঝোতার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। কিন্তু এবার মনে হয় আর হেফাজত জুজুর ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না। কারণ, সেই জুজুটা কাল্পনিক সেটা দেরিতে হলেও সরকার বুঝতে পেরেছে।
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের উপস্থিতিকেই জুজু বানিয়ে সরকারকে ভয় দেখাচ্ছিল সরকারের ভেতরেরই একটি অংশ। তাই তো অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ কৌশলগত সমঝোতায় গিয়েছিল উগ্র সাম্প্রদায়িক হেফাজতের সঙ্গে। যে সমাবেশকে ঘিরে এত ভয়, সে সমাবেশে অনেক লোক ছিল বলে বলা হয়, কিন্তু সেই অনেক মানে কত। যতটুকু এলাকায় তারা অবস্থান নিয়েছিল, বৈজ্ঞানিকভাবে মাপলে সেখানে সাড়ে ৩ লাখের মতো মানুষ বসতে পারে। আমি ধরে নিচ্ছি সেদিন ৫ লাখ লোক সমবেত হয়েছিল। ঠিক আছে, হেফাজতের দাবিই মানলাম, সেদিন ১০ লাখ এসেছিল সরকারের পতন ঘটাতে। কিন্তু ১৮ কোটি মানুষের দেশে ১০ লাখ লোকের সমাবেশ কি বিশাল কিছু। দেশের সব কওমি মাদ্রাসা হেফাজতের নিয়ন্ত্রণে। ‘বড় হুজুর’ ডাকলে মাদ্রাসার ছাত্রদের যেকোনও জায়গায় যেতে হয়। তাই চট করে ডাক দিলেই হেফাজত বিশাল সমাবেশ করে ফেলতে পারে। কিন্তু সমাবেশের একটা বড় অংশ মাদ্রাসার শিশু ছাত্র। ৫ মে রাতে সেই শিশুদের অসহায়ত্ব আমরা দেখেছি। সরকার যতই ঘুষ দিক, স্বীকৃতি দিক, হেফাজত কখনোই আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। বরং হেফাজত তোষণ করতে আওয়ামী লীগ তার অনেক সহজাত সমর্থক হারিয়েছে। দেরিতে হলেও তারা ভুলটা, ক্ষতিটা বুঝতে পেরেছে। তবে এই ক্ষতি শুধু সরকারের নয়, আওয়ামী লীগের নয়; গোটা দেশের, জাতির। গত আট বছরে সরকারের ছাড়ের সুযোগে হেফাজত দেশের অনেক ক্ষতি করেছে। এই সময়ে তাদের শিকড়ও পৌঁছে গেছে সমাজের অনেক গভীরে। সময় এসেছে এই অপশক্তির শিকড় উপড়ে ফেলার, কাল সাপের বিষদাঁত ভেঙে ফেলার।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ