X
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
১৬ আষাঢ় ১৪৩২

বাড়ি যাওয়া, করোনা ছড়ানোর সঙ্গে ভোগান্তিটা বোনাস

রুমিন ফারহানা
১১ মে ২০২১, ১৬:৫৬আপডেট : ১১ মে ২০২১, ১৬:৫৬

রুমিন ফারহানা গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে ভীষণ স্ফীত একটি পেট নিয়ে প্রখর রোদের মধ্যে একজন নারী হাঁটছেন পদ্মার তীর দিয়ে, পদ্মার চরে। তিনি মোট হেঁটেছেন ৫ কিলোমিটার। তার সন্তান প্রসবের সময় ছিল জুনের মাঝামাঝি। দুর্গম পথে তীব্র গরমে পুড়তে পুড়তে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার ধকল সইতে পারেন না সেই নারী। প্রসব বেদনা উঠে যায় তার; চরের একটি ঘরে সন্তান প্রসব করেন তিনি। গল্পের শেষটা বিয়োগাত্মক ছিল না– সময়ের বেশ আগে পৃথিবীতে চলে আসা শিশুটি এবং তার মা সুস্থ আছে।

যারা এই গল্পটি পত্রিকায় এখনও পড়েননি তারা হয়তো ভাবছেন কোন পরিস্থিতিতে এমন অবস্থায় একজন নারীকে হাঁটতে হলো এতটা পথ? এটা এবারের করোনাকালে বাড়ি ফেরার একটা গল্প। এই মুহূর্তে অতি আলোচিত শিমুলিয়া ঘাটে ঘটে এই পরিস্থিতি। নদী পার হতে না পেরে নদীর তীর দিয়ে দুই কিলোমিটার হাঁটার পর দুপুরের দিকে একটি ট্রলারে চরে পদ্মা নদীর একটি চরে নামেন ওই নারী আর তার স্বামী। সেখান থেকে হেঁটে রওনা হন। অনুমান করি বাড়ি যাওয়ার এই মরিয়া চেষ্টার গল্পটি নিয়ে আমরা ট্রল করবো না।

শিমুলিয়া ঘাটের কিছু ছবি কয়েক দিন থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে মূল ধারার মিডিয়ায় এবং সামাজিক গণমাধ্যমে। শত শত মানুষ গায়ের সাথে গা ঠেকিয়ে ফেরিতে ওঠার চেষ্টা করছে– কেউবা ঘাটের সঙ্গে ফেরি বেঁধে রাখার দড়ি বেয়ে ‘কমান্ডো স্টাইলে’, কেউবা ফেরিতে ওঠার স্বাভাবিক পথে উন্মত্তের মতো হেঁটে। কীসের স্বাস্থ্যবিধি, কীসের সামাজিক দূরত্ব, কীসের মাস্ক, কীসের করোনা। আমরা এখন দারুণ ট্রলপ্রিয় জাতি। ফেরিঘাটের এই ছবিগুলো নিয়ে নানা রকম ট্রলে মেতে উঠেছি আমরা। যাত্রাপথে পদ্মা নদী পার হতে হয় বলে দক্ষিণের জেলাগুলোর মানুষেরই এই পরিস্থিতি হয়েছে। সারা দেশের অন্য জেলাগুলোতে দিব্যি চলে যাচ্ছে সব মানুষ।

এই যে মানুষগুলো করোনার এত বড় ঝুঁকিকে বিন্দুমাত্র আমল না দিয়ে এমন উন্মত্ত আচরণ করছে তার জন্য কি শুধু তাদেরই দোষ দেওয়া যায়? এই মানুষগুলো যদি মনে করে দেশে তো এই মুহূর্তে করোনার পরিস্থিতি মোটেও খারাপ নয়, তাহলে কি তাদের দায়ী করা যাবে?

সরকারি হিসাব কিন্তু কথা বলছে এই বাড়ি ফেরা মানুষদের পক্ষেই। সরকারি হিসাবে গত বেশ কিছু দিন থেকে করোনার শনাক্তের হার ৮ শতাংশের আশপাশে। মৃতের সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০-এ ওঠানামা করছে। অর্থাৎ কেউ যদি বলে বাংলাদেশ থেকে করোনা বিদায় নেবার পথে, তাহলে সেটা ভুল হবে না। এই পরিস্থিতিতে মানুষ যদি বাড়িতে তার প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে মরিয়া চেষ্টা করে, তবে তাকে কতটুকু দোষ দেওয়া যায়? আমরা অনেকেই হয়তো এই মুহূর্তে অন্তত ভুলে গেছি এই শহরে লক্ষ লক্ষ মানুষ থাকে, যাদের অতি আপনজন থাকে ভিন্ন কোনও জেলায়। এই মানুষগুলো ঈদের ছুটিতে প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার প্রতীক্ষা করেন দীর্ঘ সময়।

এই যে মানুষগুলো অকল্পনীয় কষ্টের মধ্যে পড়লেন, সেটা হয়েছে সরকারের ভয়ংকর অব্যবস্থাপনার জন্য। সরকার যদি সত্যিই চাইতো এই বছর মানুষ বিভিন্ন জেলার মধ্যে যাতায়াত করবে না, তাহলে মানুষকে ঢাকা থেকে বের হতে দেওয়া হলো কেন?

বিবিসি বাংলার খবরে রিপোর্টারের কাছে একজন সাধারণ প্রান্তিক নারী ঠিক এই প্রশ্নটিই তুলেছিলেন। ঢাকা থেকে দলে দলে মানুষকে বের হতে দিয়ে এরপর ফেরিঘাটে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এ এক উদ্ভট পরিকল্পনা।

গণপরিবহন খুলে দেওয়ার দিন সরকার যখন বলেছিল আন্তজেলা গণপরিবহন বন্ধ থাকবে কিন্তু জেলার ভেতরে গণপরিবহন চলতে পারবে। তখনই ফেসবুক দারুণ সব পরামর্শে ভরে গিয়েছিল– কীভাবে ভেঙে ভেঙে ঢাকা থেকে দেশের প্রত্যন্ত কোন জেলায় যাওয়া যাবে।

এখন আমরা ঠিক সেই পরামর্শগুলোই বাস্তবায়িত হতে দেখছি। মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি এমনকি মোটরসাইকেলে করে মহাসড়কে মানুষ ছুটছে তার বাড়ির দিকে। এতে মানুষকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া থেকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি এক ফোঁটাও, কিন্তু এই যাত্রার নামে মানুষের ওপরে তৈরি হয়েছে বীভৎস নিপীড়ন। সময় লেগেছে অনেক বেশি, যাত্রায় চরম অনিশ্চয়তা ছিল, আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার, মানুষের খরচ হয়েছে কয়েকগুণ। বহু প্রান্তিক মানুষকে ভয়ংকর সংকটে পড়তে হয়েছে।

সবকিছু ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় বিপদ তৈরি হয়েছে, যাত্রাপথের অনিশ্চয়তার কারণে বিভিন্ন জায়গায় বহু মানুষের জমায়েত হয়েছে। অথচ এখন একজন শিশুও জানে করোনার সময় এমন ভিড় করোনাকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। যেহেতু মানুষের বাড়ি যাওয়া ঠেকানোর মতো কোনও পদক্ষেপ সরকার নেয়নি, সরকারের উচিত ছিল আগের মতো স্বাভাবিক যোগাযোগ ব্যবস্থা রেখে তার মধ্যে যতটুকু সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ব্যবস্থা করা। এতে মানুষের এমন ভয়ংকর গাদাগাদি হতো না।

আসলে কোনও একটি দিক আলাদাভাবে বন্ধ করে রাখা যায় না। সবকিছু খুলে দিয়ে আন্তজেলা পরিবহন বন্ধ করে রাখা সেই সেক্টরে কাজ করা মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বিক্ষোভ তৈরি করবেই। সেই ক্ষোভ কমিয়ে আনা তখন হয়তো যায় যখন সরকার তাদের এই ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ত্রাণের নামে যে প্রহসন সরকার করেছে সেটা তারা যত লুকিয়ে ফেলতে পারবে ততই তাদের কম লজ্জায় পড়তে হবে। তাহলে পরিবহন সেক্টরে যে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে তারা চলবে কীভাবে?

একটা দেশের নাগরিকরা যখন করোনার মতো এত ভয়ংকর একটা মহামারিকে পাত্তা দেয় না তখন বুঝতে হবে তাদের সেই পরিস্থিতিতে আসলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। করোনার শুরু থেকেই সরকারের চেষ্টা ছিল এটাকে যতটা সম্ভব কমিয়ে দেখানো। সরকার ভেবেছিল এতে মানুষ একেবারে অসতর্ক হয়ে থাকবে এবং দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু থাকবে।

বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান ভীষণ রকম প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বব্যাংকের স্ট্যাটিসটিক্যাল ক্যাপাসিটি স্কোরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্তান ছাড়া আর সব দেশের নিচে। বাংলাদেশের স্কোর ৬২.২। এই সূচকে ভারতের পয়েন্ট ছিল ৭৫.৬। এছাড়া ভুটান ৬৩.৩, শ্রীলংকা ৮১.১, পাকিস্তান ৭১.১, নেপাল ৭৪.৪ পয়েন্ট পেয়েছে।

আর তাই করোনা শুরুর পর থেকে প্রতিদিন যে আক্রান্ত আর মৃতের তথ্য সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হচ্ছিল, সেই সংখ্যার প্রতিও মানুষের খুব একটা আস্থা ছিল না। এ ছাড়াও পরিসংখ্যানগত দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম পরীক্ষার দেশ বাংলাদেশ। একদিকে অতি অপ্রতুল পরীক্ষা অন্যদিকে তথ্য গোপন, সব মিলিয়ে বিষয়টি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে সরকার মুখে যাই বলুক মানুষ আর বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে রাজি না। এর ফলই দেখতে পাচ্ছি আমরা এখন।

এদিকে বাংলাদেশে সরকারিভাবে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব ঘোষিত হয়েছে। কেন্ট (ইউকে) আর সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট-এর অস্তিত্ব ঘোষিত হওয়ার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে আমরা বুঝবো ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব ছিল আরও আগে থেকেই। অর্থাৎ এই দেশের মানুষের মধ্যে এই ভ্যারিয়েন্টটি অনেক ছড়িয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে এই মানুষ উপচে পড়া ভিড় তৈরি করছে বিপণি কেন্দ্রগুলোতে।

ভারতে করোনা মহামারি এখন পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এবং নেপালেও তাণ্ডব চালাতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে স্বয়ং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন করোনা নিয়ে। কাগজে-কলমে স্থলসীমান্ত বন্ধ হলেও বহু মানুষ এখনও যাতায়াত করছেন, পণ্য আমদানি চলছে। সার্বিক পরিস্থিতি ঈদের পরের বাংলাদেশ নিয়ে কেমন বার্তা দেয়?

গত কিছু দিনে নানা সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভারতের কিছু ছবি আবার একটু মনে করি - সারি সারি চিতা জ্বলছে, শ্মশানে, শ্মশানের বাইরে, পার্কিং লটে। দাহ করার জন্য পাড়ার মাঠকে দ্রুত পরিণত করা হচ্ছে অস্থায়ী শ্মশানে। কোথাও বা দাহ করার দীর্ঘ সারির দৈর্ঘ্য কিলোমিটার ছুঁয়েছে, কোথাও বা তেমন অপেক্ষমাণ সারি থেকে লাশ টেনে নিতে চাইছে একটি কুকুর।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে
বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে
দুর্ঘটনায় ছয় মাসে প্রাণ হারিয়েছে ৪২২ শ্রমিক
দুর্ঘটনায় ছয় মাসে প্রাণ হারিয়েছে ৪২২ শ্রমিক
৪০ শতাংশ কৃষক পান না ন্যায্য মজুরি: জরিপ
৪০ শতাংশ কৃষক পান না ন্যায্য মজুরি: জরিপ
ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও মার্কিন পাল্টা শুল্ক বড় চ্যালেঞ্জ: বিজিএমইএ সভাপতি
ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও মার্কিন পাল্টা শুল্ক বড় চ্যালেঞ্জ: বিজিএমইএ সভাপতি
সর্বশেষসর্বাধিক