X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

আইনের ‘নিজস্ব গতি’ বলতে কী বোঝায়?

আমীন আল রশীদ
১২ মে ২০২১, ১৭:৩৩আপডেট : ১২ মে ২০২১, ১৭:৩৩
আমীন আল রশীদ প্রতিটি অপরাধের পরে রাষ্ট্রের তরফে যে কথাটি জোর দিয়ে বলা হয়, তা হলো—অপরাধী যেই হোক পার পাবে না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। তদন্ত চলছে। অপরাধীর পরিচয় যাই হোক, দোষী প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে ইত্যাদি। সবশেষ বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে একজন তরুণীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলার পরেও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল একই মন্তব্য করেছেন।

প্রশ্ন হলো আইনের নিজস্ব গতি বলতে কী বোঝায়? আইনের আদৌ কোনও নিজস্ব গতি আছে কিনা বা সে চাইলেই নিজের মতো চলতে পারে কিনা? যদি না পারে তাহলে তার গতি কোথা থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়?

সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দুই বছর ধরে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন তার কথিত স্ত্রী—যাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের একটি রিসোর্টে গিয়ে তিনি মূলত আলোচনায় আসেন। প্রশ্ন হলো, বিয়ের প্রলোভনে পড়ে ওই নারী কেন মামুনুল হকের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন? এই প্রশ্ন তাকে করা হবে কিনা বা বিয়ের প্রলোভনে পড়ে কোনও নারী যদি কোনও পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়ান, তাহলে তিনি ওই পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করতে পারেন কিনা? উপরন্তু যদি মামলা করতেই হয়, তাহলে সেটি দুই বছর পরে কেন?

এসব প্রশ্নের সুরাহা কীভাবে হবে এবং এই ক্ষেত্রে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে কিনা বা এক্ষেত্রে আইনের গতি কী হবে?

ধর্ষণ বলতে কী বোঝায় এবং কোন পরিস্থিতিতে একটি ঘটনাকে ধর্ষণ হিসেবে গ্রহণ করা হবে, তারও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা দরকার। সমঝোতার ভিত্তিতে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পরে সেই পুরুষের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে অথবা কোনও চাপে একজন নারী যদি ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন, সেটি আমলযোগ্য হবে কিনা এবং সেই শারীরিক সম্পর্কটি আসলেই সমঝোতার ভিত্তিতে হয়েছিল নাকি জোরপূর্বক—সেটি প্রমাণের সর্বজনগ্রাহ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলাও আবশ্যক।

একটি জাতীয় দৈনিকের খবর বলছে, দেশের ৭২টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে যে দেড় লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন, তার একটি বড় অংশই মিথ্যা মামলা। ৮০ শতাংশ মামলা যৌতুক, ধর্ষণ ও যৌন পীড়নের অভিযোগে দায়ের করা হলেও এর আড়ালে রয়েছে অন্য ধরনের বিরোধ।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটা বড় সুবিধা হলো এই যে, এই আইনে জামিন পেতে বেগ পেতে হয়। পুলিশের বরাত দিয়ে আরেকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে দেশব্যাপী ১৫ হাজারের কিছু বেশি নারী নির্যাতনের মামলা হলেও প্রায় চার হাজার মামলার ক্ষেত্রে পুলিশি তদন্তে ঘটনার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আবার অনেক মামলায় পরিবারের একজন দোষী হলেও পুরো পরিবারকে জড়ানো হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাজধানীর শাপলা চত্বরসহ বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের তাণ্ডবের অভিযোগে যে মামলা হয়েছিল, ৮ বছর পরে এসে এখন ওই মামলায় হেফাজত নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। যদিও ২০১৩ সালের পর থেকে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের বেশ উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়; হেফাজতের অনেক দাবি সরকার মেনে নেয় এবং এ নিয়ে সরকার বেশ সমালোচিতও হয়। অথচ ৮ বছর পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাশকতার ঘটনা ঘটলে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের দূরত্ব স্পষ্ট হয়—যেটির সূত্রপাত ধোলাইপাড় এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনে হেফাজতের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে। প্রশ্ন হলো, ৮ বছর আগের মামলায় এখন কেন হেফাজত নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে? এতদিন তারা সরকারের বন্ধু ছিলেন বলে মামলাটি ফাইলচাপা পড়েছিল? এই ক্ষেত্রে তাহলে আইনের গতিটি কোথা থেকে কে নিয়ন্ত্রণ করছেন?    

আইনের গতি নির্ধারিত হয় প্রধানত রাজনৈতিকভাবে। এর সঙ্গে  অনেক সময় যুক্ত হয় ক্ষমতা, অর্থ ও অন্যান্য চাপ। অর্থাৎ আইনের নিজস্ব গতি বলে কিছু নেই। বরং প্রতিটি আইন কোন গতিতে চলবে এবং কাকে কতটুকু গতিতে গিয়ে সে পাকড়াও করবে, তা নির্ভর করে রাষ্ট্র বা সরকারের ওপর। অর্থাৎ কোন আইন কখন সক্রিয় থাকবে অথবা কতটুকু ক্রিয়াশীল থাকবে এবং সে কাকে ধরবে এবং কোন তরিকায় ধরবে, সেটি নির্ভর করে সরকারের রাজনৈতিক অভিলাষের ওপর। দ্বিতীয়ত, আইনের গতি নির্ভর করে যারা ওই আইনের প্রয়োগ করেন, অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর। তৃতীয়ত ব্যক্তির ওপর। অর্থাৎ একই আইন একই অপরাধে ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। আচরণ করে মানে আইনকে যেভাবে বলা হয়, সে সেভাবে অ্যাক্ট করে। কারণ তার নিজস্ব কোনও ক্ষমতা নেই।

যে অপরাধে পুরান ঢাকার প্রভাবশালী এমপি হাজী সেলিমের পুত্র ইরফান সেলিম জেল খাটলেন এবং বীরদর্পে জেলখানা থেকে বেরিয়ে গেলেন, সেই একই অপরাধ সমাজের অন্য কোনও সাধারণ মানুষ করলে তাকে নিঃসন্দেহে আরও কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হতো। ইরফান সেলিম যে জেলখানায় বেশ রাজার হালেই ছিলেন, সেটি জেলখানা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণের সময় তার সফেদ পাঞ্জাবি পরা হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় স্পষ্ট। কিন্তু জেলখানার ভেতরে সবাই এরকম রাজকীয় হালে থাকার সুযোগ পান না। যদিও জেলকোড বা জেলখানা কীভাবে পরিচালিত হবে তার একটি আইন রয়েছে। কিন্তু সেই আইনেরও গতি নির্ধারিত হয় যারা এর প্রয়োগ করেন তাদের ওপর। জেলখানার আইনের গতি প্রধানত নির্ভর করে পয়সার ওপর। কারণ কথিত আছে, জেলখানার ভেতরে টাকা দিলে সবই মেলে। অর্থাৎ যার পয়সা নেই, তার জন্য জেলখানা যেরকম, যার পয়সা আছে, তার জন্য জেলখানা সেরকম নয়। যদিও আইন একটি। কিন্তু এর গতি-প্রকৃতি ভিন্ন। ব্যক্তিভেদে এর আচরণ ভিন্ন। অনেক বড় বড় অপরাধী জেলখানায় যাওয়ার পরে চিকিৎসার নামে হাসপাতালের কেবিনে মাসের পর মাস রাজার হালে থাকেন—যা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হয়ে থাকে। অর্থাৎ এখানেও আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে—যে গতিটা রাষ্ট্র নির্ধারণ করে দিয়েছে।

বাংলাদেশের আইনগুলো নিজস্ব গতিতে চলে কিনা বা নিজস্ব গতি বলতে কী বোঝায়, তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন সব আইন কি জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রণয়ন করা হয় বা আইনসমূহের উদ্দেশ্য বা ইনটেনশন কী? এই প্রশ্নটি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে। কারণ, এই আইনের উদ্দেশ্য হিসেবে ডিজিটাল প্লাটফর্মে নাগরিকের সুরক্ষার কথা বলা হলেও আসলে এটি যে ভিন্নমত দমন এমনকি গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তা এরইমধ্যে নানা ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিজস্ব গতিতে চলবে বলা হলে প্রথমেই এই আইনের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।

এরকম আরও কিছু আইনের কথা উল্লেখ করা যায়, যেগুলো মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের কাজে ব্যবহার করা হয়। যেমন সন্ত্রাসবিরোধী আইন, জননিরাপত্তা (বিশেষ বিধান) আইন, দ্রুত বিচার আইন ইত্যাদি। সবশেষ ২০১৮ সালে দ্রুত বিচার আইন সংশোধন করে সাজার মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে করা ওই আইনটি  দুই বছরের জন্য করা হলেও পরবর্তীতে সব সরকারই আইনটির মেয়াদ বাড়িয়েছে। সবশেষ এর সর্বোচ্চ সাজার মেয়াদ ৫ থেকে ৭ বছর করা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০২ সালে যখন আইনটি করা হয় তখন তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল এবং তারা এই আইনকে ‘আওয়ামী লীগ দমন আইন’ বলে অভিহিত করেছিল। অথচ তারাই এই আইনে সাজার মেয়াদ  বাড়িয়েছে। অর্থাৎ বিএনপি যেমন এই আইনটিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে ব্যবহার করেছিল, আওয়ামী লীগও তা-ই করছে। ভবিষ্যতে অন্য কোনও দল ক্ষমতায় এলে তারাও এই আইনকে তাদের প্রতিপক্ষ দমনের কাজেই ব্যবহার করবে—তাতে সন্দেহ নেই। স্মরণ করা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল। বিএনপি সরকারের আমলে এই মামলার কোনও অগ্রগতি হয়নি। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে মামলাটি সচল করে এবং অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। অর্থাৎ বিএনপি সরকার এই অপরাধের বিচারে সংশ্লিষ্ট আইনের গতিকে নিজের মতো নিয়ন্ত্রণ করেছে।

আইনের নিজস্ব গতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রতিটি আইনের যে বিধানের দিকে নজর দেওয়া দরকার, তা হলো ‘সরল বিশ্বাস’। অর্থাৎ প্রতিটি আইনের প্রয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধে তাদের দায়মুক্তির বিধান থাকে। ধরা যাক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও সদস্য প্রকাশ্যে কোনও নাগরিককে গুলি করলো এবং তার বিরুদ্ধে মামলা হলো, তাহলেও তদন্ত রিপোর্টে উক্ত অপরাধকে  ‘সরল বিশ্বাসে কৃত’ কিংবা ‘আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি’ বলে উল্লেখ করে অভিযুক্তকে দায়মুক্তি দেওয়া সম্ভব। প্রশ্ন হলো, সরল বিশ্বাসের সংজ্ঞা কী এবং এটা কে ঠিক করবেন যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কাজটি না বুঝে করেছেন? আইনে সরল বিশ্বাসের কোনও ব্যাখ্যা নেই। এটা নির্ভর করে যিনি ঘটনাটি তদন্ত করবেন এবং যিনি বিচার করবেন, তাদের ওপর। ফলে পুলিশ বা অন্য কোনও বাহিনীর সদস্য অথবা প্রজাতন্ত্রের অন্য যেকোনও পর্যায়ের কোনও কর্মচারী যদি কোনও নাগরিককে হয়রানি করেন, বিপদে ফেলেন, ফাঁসিয়ে দিয়ে পয়সা খান অথবা কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে একজন নাগরিকের জীবন বিপন্ন হয়, তারপরও ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে সুরক্ষা দেওয়ার বিধান প্রচলিত আইনেই রয়েছে। সুতরাং, একই কাজ একজন সাধারণ মানুষ করলে সেখানে আইন একরকম, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান কেউ করলে আরেক রকম এবং আইন প্রয়োগকারীরা করলে একেবারেই অন্য রকম। অর্থাৎ আইনটিকে যদি আমরা একটি অস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে এর গতি বলতে বোঝাবে অস্ত্রটি কার হাতে রয়েছে এবং কার নির্দেশে অস্ত্রটি কার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।

লেখক: সাংবাদিক।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পোস্ট অফিসে স্মার্ট সার্ভিস পয়েন্ট উদ্বোধন করলেন সুইডেনের প্রিন্সেস
পোস্ট অফিসে স্মার্ট সার্ভিস পয়েন্ট উদ্বোধন করলেন সুইডেনের প্রিন্সেস
এক‌দি‌নের রিমান্ড শে‌ষে কারাগারে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম
এক‌দি‌নের রিমান্ড শে‌ষে কারাগারে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম
যে কারণে রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করলো মলদোভা
যে কারণে রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করলো মলদোভা
রোজা ও ঈদের কেনাকাটায় প্রিমিয়ার ব্যাংকের কার্ডে বিশেষ ছাড়
রোজা ও ঈদের কেনাকাটায় প্রিমিয়ার ব্যাংকের কার্ডে বিশেষ ছাড়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ