X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

আগুন লাগাই স্বাভাবিক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৪ জুলাই ২০২১, ১৫:৪৫আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২১, ১৫:৫৯

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় আগুনে ৫২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের অপরাধের বিচার হবে কিনা, শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণ পাবে কিনা কিংবা সারা দেশেই সব ধরনের কারখানায় কর্মপরিবেশ শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ হবে কিনা সে নিয়ে টেলিভিশন টকশোতে অনেক কথা হয়েছে, পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ হয়েছে এবং নানা প্রতিশ্রুতিও আসছে।

কিন্তু এই ভাবনাগুলোকে আমার কাছে অনেক দিন ধরেই অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। বরং মনে হয় আগুন লাগাটাই স্বাভাবিক। বারবার একই ঘটনা ঘটতে থাকলে অনেক বড় অস্বাভাবিক ঘটনাকেও মানুষ স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করে। ঠিক এমন করেই এই কারখানার মালিক বলেছেন, ‘শিল্প হলে আগুন লাগবেই এবং শ্রমিক মরবেই’। বিষয়টি শুধু কারখানার আগুন নয় আসলে। প্রতিবছর এই শহরের কোনও না কোনও বস্তিতে আগুন লাগে। বিধ্বংসী আগুনে বস্তির মানুষ সর্বস্ব হারাবে, আজীবনের সঞ্চয় হারিয়ে কোনও মানুষ আহাজারি করবে, কোনও শিশু ছাইয়ের মধ্যে তার বইপত্র খুঁজতে থাকবে, তার মা কান্না করবে – এমন দৃশ্য টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান বা পত্রিকার ফটোগ্রাফারের জন্য কিছুটা সংবাদ উপযোগী মনে হলেও দেশের বাস্তবতায় আসলে কিছুই না। খুবই স্বাভাবিক।

তাজরিন বা আরও কত কত পোশাক কারখানার আগুন, টাম্পা ফয়েল কারখানার আগুন, বনানীর এফ আর টাওয়ারসহ অসংখ্য আগুনের ঘটনা তো মানুষ মনেই করতে পারে না পুরনো ঢাকার নিমতলী, চুড়িহাট্টার মতো বড় ঘটনার পর। কিন্তু সেসবও যখন মানুষ ভুলতে বসেছিল করোনার দাপটে তখন এলো নারায়ণগঞ্জের সেজান জুস ফ্যাক্টরির আগুন। এটাও ভুলতে সময় লাগবে না। কারণ, আমরা জানি আবার আগুন লাগবে। এই রাজধানী জানে, এ দেশের সব জনপদ জানে আগুন লেগেই থাকে। তাই নারায়ণগঞ্জের আগুন আরও একটি স্বাভাবিক ঘটনা।

হাসেম ফুডস লিমিটেডের মালিকের দোষ অনেক। তার বিল্ডিংয়ের ডিজাইনে সমস্যা আছে, অর্থাৎ বিল্ডিং কোড মেনে তা নির্মিত হয়নি। এত বড় বিল্ডিংয়ে সিঁড়ি মাত্র দুটো। তাও পর্যাপ্ত চড়া নয়। তার এখানে দাহ্য পদার্থ এমনভাবে রাখা ছিল যা সেফটি স্ট্যান্ডার্ডের পরিপন্থী। এই মালিক শিশু শ্রমিক নিয়োগ করেছে যেখানে আইনে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ। শ্রমিকদের বেতন ও ওভারটাইমও ঠিকমতো দেওয়া হতো না। এগুলো সবই আমরা কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে শুনছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নকশায় সমস্যা থাকার পরও বিল্ডিংয়ের অনুমোদন জুটলো কী করে? এমন করেই জুটেছিল রানা প্লাজারও। অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকলেও এই কারখানার ছাড়পত্র কে দিলো বা এটি কি ছাড়পত্র ছাড়াই চলছিল? তাহলে শিশুশ্রমসহ আর সব অপরাধের জন্য যে দায়িত্ব পালন করার কথা কলকারখানা পরিদফতরের, সেই অফিসের কর্তারা তাহলে কি অপরাধী নন?  

তাই আগুন কেন লাগে– এমন প্রশ্ন করে আর লাভ নেই। আগুন লাগবেই। কারণ, নীতি বাস্তবায়ন আর নজরদারির সিস্টেমে গলদের মধ্যেই সব উপকরণ আছে আগুন লাগার। আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো আইন অমান্য করা। এরমধ্যে যদি সিস্টেমের ভেতর দুর্নীতি বড় জায়গা নিয়ে থাকে, নজরদারিতে গাফিলতি থাকে তাহলে তো কথাই নেই। পোশাক কারখানার পরিবেশ নিরাপদ করার কোনও উদ্যোগ ব্যবসায়ীরা নেয়নি, সরকারও নেওয়াতে পারেনি। কখন হয়েছে আমরা জানি। যখন বাইরের ক্রেতারা কঠোর চাপ দিয়ে বলেছে, ‘তোমাদের পণ্যই নেবো না, কারখানার পরিবেশ শ্রমিকের জন্য নিরাপদ না হলে’। এরপরও এখন সব পোশাক কারখানা নিরাপদ এটা অন্তত আমি ভাবতে পারছি না।

অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা বিধেয়। কিন্তু একটি আগুনের ঘটনারও বিচার হয়েছে সে কথা আমরা শুনিনি। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরই একটি প্রশ্ন ওঠে, এবং আগুন নিভে যাওয়ার পর সেই প্রশ্নটিও ক্রমে চাপা পড়ে যায়— কেন পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া এত এত কাঠামো গড়ে উঠছে, কেন শহরের বস্তিগুলোকে নিরাপদ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, কেন যেখানে সেখানে যেনতেনভাবে কারখানা গড়ে ওঠে?

এসব প্রশ্ন উঠে তারপর এগুলো কালের স্রোতে ভেসে যায়। বাংলাদেশে যারা ব্যবসা বাণিজ্য করে তাদের ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে সখ্য থাকে। বলতে গেলেই তারাই আইন ও নীতিমালা প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে জড়িত থাকে। ‘মানুষ’-তো আসলে মরে না, মারা যায় তারা, শ্রমিক বা বস্তিবাসী বা অতি সাধারণ নাগরিক। এদের জীবনের কথা শাসনপ্রণালির কোনও স্তরেই কখনও সেভাবে আসলে লিপিবদ্ধ থাকে না।

প্রতিবারই তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু তদন্তের ফলাফল কী হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা জনগণে জানতে পারে না। প্রতিবারই বিভিন্ন সরকারি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের মধ্যে পরস্পরবিরোধী কিছু অভিযোগ শোনা যায়। শ্রমিকের বা বস্তিবাসীর অসতর্কতা এবং আইন না মানবার প্রবণতা এমন বিপদ ডেকে আনে বলে সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কাউন্সিলর বা কারখানা মালিকরা বলে থাকেন। কিন্তু কোন ক্ষেত্রে ঠিক কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটে, তা সচরাচর প্রকাশ পায় না। ফলে, সাবধানতা অবলম্বনের পরিসরটিও আর তৈরি হয় না।

আমাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আরও আধুনিকায়ন প্রয়োজন, যেমন আমরা এটির গুরুত্ব বুঝতে পেরে শুধু এর জন্য একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল বানিয়েছি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন এই আগুন সমস্যার সমাধানে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার গুরুত্ব বাড়িয়ে পদক্ষেপ নেওয়া। মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে একটি বহুজনগ্রাহ্য সমাধানসূত্রে উপনীত হওয়া প্রয়োজন। পুড়ে যাওয়া বস্তির জায়গায় নতুন করে ঘর বানিয়ে দেওয়া, মৃত শ্রমিকের পরিবারকে কিছু টাকা ধরিয়ে দেওয়া কোনও সমাধান নয়।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ