X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

আহা জীবন, আহা কলেজ জীবন!

প্রভাষ আমিন
২২ জুলাই ২০২১, ১৬:৫৯আপডেট : ২২ জুলাই ২০২১, ১৬:৫৯

প্রভাষ আমিন বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা হলে আমরা প্রথম যে প্রশ্নটি করি, কোন ক্লাসে পড়ো? তবে ইদানীং এই প্রশ্নটি করতে আমার অস্বস্তি লাগে। যাকে প্রশ্নটি করা হয়, সে বিব্রত হয়। কোন ক্লাসে পড়ে বা কোন ক্লাসে পড়তো, এই প্রশ্নে তারা তালগোল পাকিয়ে ফেলে। ১৫ মাসেরও বেশি সময় দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কে কোন ক্লাসে পড়তো, কোন ক্লাসে উঠেছে; সব এলোমেলো হয়ে যায়।

করোনা সংক্রমণ শুরুর পর গত বছর ১৭ মার্চ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তারপর দফায় দফায় বেড়েছে বন্ধের মেয়াদ। বিভিন্ন সময়ে স্কুল খোলার, পরীক্ষা নেওয়ার নানান পরিকল্পনা করা হলেও করোনার দাপটে কোনোটাই বাস্তবায়ন করা যায়নি। ক্লাস তো নয়ই, এই সময়ে কোনও পরীক্ষাও হয়নি। সবাই অটো পাস করে ওপরের ক্লাসে উঠে গেছে। ওপরের ক্লাসে উঠলেও ক্লাসরুমের দেখা পায়নি। ক্লাসরুম বলতে তারা বোঝে, জুম বা গুগল ক্লাস।

আগে শিক্ষার্থীরা স্কুল কবে বন্ধ হবে সেই অপেক্ষায় থাকতো। আর এখন কবে স্কুল খুলবে, সেই অপেক্ষায় তাদের দিন কাটে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন সংগ্রামও করেছে। তাদের অবস্থা হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের মতো। বহুব্রীহি নাটকে আসাদুজ্জামান নূরের চরিত্রের সংসার ছিল মা-মরা দুই বাচ্চা নিয়ে। একদিন বাচ্চা দুটি তাদের বাবাকে এসে বললো, বাবা স্বাধীনতা মানে কী? আসাদুজ্জামান নূর জবাব দিলেন, স্বাধীনতা মানে ইচ্ছামত যা ভালো লাগে তাই করা। বাচ্চা দুটি বললো, আমরা তো স্বাধীন। কিন্তু আমাদের স্কুলে যেতে ভালো লাগে না। তখন তাদের বাবা বললেন, তাহলে স্কুলে যেও না। তারা খুব খুশি। মনের আনন্দে তারা স্বাধীনতা উপভোগ করতে লাগলো। তিন দিন যেতে না যেতেই দুজন কাচুমাচু হয়ে বাবার কাছে এসে বললো, বাবা স্বাধীনতা আর ভালো লাগছে না। আমরা স্কুলে যাবো। এখন দেশের চার কোটি শিক্ষার্থীরও আর ছুটি ভালো লাগছে না। তারা সবাই স্কুলে ফিরতে চায়। অবশ্য চাইলেও সবার আর ফেরা হবে না কখনও। সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে স্কুলে ঝরে পড়ার হার কমে এসেছিল। আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার আবার বেড়ে যাবে। এরইমধ্যে বাল্য বয়সেই অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে। গরিব পরিবারের অনেকে পড়াশোনা ছেড়ে পরিবারকে সহায়তা করতে কাজে লেগে গেছেন। কয়েকদিন আগে রূপগঞ্জে হাসেম ফুড ফ্যাক্টরির আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ৫২ জনের বেশিরভাগই শিশু, যারা করোনার আগে স্কুলে যেতো, এখন কারখানায় যায়। আসলে বর্তমানকে সুরক্ষিত রাখতে চার কোটি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎকে আমরা জিম্মি করে ফেলেছি।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ক্ষতি পোষাতে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে বটে; কিন্তু দুধের স্বাদ যেমন ঘোলে মেটে না, তেমনি ক্লাসরুমের শিক্ষা অনলাইন ক্লাসে মেটে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো শুধু বইয়ের পড়া শেখায় না, জীবন শেখায়। শুধু বই পড়েই যদি জ্ঞানী হওয়া যেতো, তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর দরকারই থাকতো না। একটি শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পরিবারের পরেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়, তারপর মহাবিদ্যালয়, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্বকে চিনবে, জীবনকে জানবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা নতুন বন্ধু পাবে, নতুন সমাজ পাবে, নেতৃত্ব দিতে শিখবে, বিপদে বন্ধুর পাশে দাঁড়াবে, সমস্যা এলে তার সমাধানের পথ খুঁজবে। অনলাইন ক্লাসে যা কখনোই সম্ভব না। মাসের পর মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও তারা প্রমোশন পেয়ে যাচ্ছে। যাতে তাদের শিক্ষায় মারাত্মক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে, ভবিষ্যৎ জীবনে যা তাদের অনেক দুর্ভোগ ফেলতে পারে। ক্লাসরুমের বিকল্প হিসেবে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা হলেও, এই ব্যবস্থা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিদ্যমান বৈষম্যকে আরও প্রকট করেছে। অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে ডিজিটাল ডিভাইস লাগে, হাইস্পিড ইন্টারনেট লাগে। শহরের শিক্ষার্থীরা পেলেও গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী সব সুবিধা পান না। অথচ মূল্যায়নের সময় সবাইকে এক পাল্লায়ই মাপা হবে।  

দেড় বছরের করোনা আসলে তিন বছরের শিক্ষাসূচি লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। সব পর্যায়ে জট লেগে গেছে। করোনায় অন্য সব ক্ষতি হয়তো পুষিয়ে নেওয়া যাবে। সময়ে স্বজন হারানোর বেদনাও হয়তো প্রশমিত হয়ে যাবে। কিন্তু শিক্ষার যে ক্ষতি তা কোনোদিনই পূরণ হবে না। এই ঘাটতির ক্ষতি বয়ে বেড়াতে হবে দীর্ঘদিন। গত বছর অটোপাস নিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখে সরকার এবার যেকোনও মূল্যে অন্তত পাবলিক পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি নভেম্বরে এসএসসি এবং ডিসেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। বিষয় কমিয়ে, সিলেবাস কমিয়ে হলেও পরীক্ষা নেওয়া হবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা উচিত কী উচিত না, এ নিয়ে গণভোট হলে দুই পক্ষেই সমান ভোট পড়বে। দুই পক্ষেই যুক্তির অভাব নেই। প্রতিদিন যেখানে দুইশ জন মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আবদার করাটা কেউ মেনে নেবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের আসলে প্রথম সুযোগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সুযোগ নিতে হবে। সরকার করোনার অনেক ব্যাপারে অনেক ছাড় দিলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে কোনও ঝুঁকি নেয়নি। যখন গার্মেন্ট কারখানা খোলা, শপিং মল খোলা, গণপরিবহন খোলা; তখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধই রয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনের ব্যাপারে সরকারের অতি স্পর্শকাতরতা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু বর্তমানকে সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জিম্মি করা কোনও কাজের কথা নয়। গত বছরের ১৭ মার্চের পর নানা সময়ে সাধারণ ছুটি হয়েছে, বিধিনিষেধ হয়েছে, কঠোর বিধিনিষেধ হয়েছে, শিথিল লকডাউন হয়েছে, কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর খোলেনি। দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, বিশ্বের এমন ১৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। তবে এখন ইউনিসেফ আর ইউনেসকোও দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।

সম্প্রতি এক যৌথ বিবৃতিতে এ দুই প্রতিষ্ঠানের প্রধান এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বন্ধের ক্ষেত্রে স্কুলগুলো সবার শেষে এবং পুনরায় খোলার ক্ষেত্রে সবার আগে থাকা উচিত। স্কুলগুলো পুনরায় চালুর ক্ষেত্রে সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর টিকা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করা যায় না। স্কুল খোলার জন্য করোনা শূন্যের কোঠায় যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা যায় না।’

তবে বাংলাদেশে হয়েছে উল্টো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে সবার আগে। কবে খুলবে তাও কেউ জানে না। আমারও মনে হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার সময় চলে এসেছে। পরবর্তী প্রথম সুযোগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। যে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকি বিবেচনা করে মাসের পর মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হচ্ছে, তারা তো আর ঘরে বসে থাকছে না। তারা বেড়াচ্ছে, খেলছে, শপিং মলে যাচ্ছে, গরিবরা কারখানায় যাচ্ছে। তাহলে আর স্কুল বন্ধ রেখে লাভ কী। বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে স্কুলে যাওয়া যায়, কীভাবে বাড়তি ক্লাস করে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া যায়, সেটাই ভাবতে হবে। ইউনিসেফ-ইউনেসকো প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য টিকা পর্যন্ত অপেক্ষা না করার কথা বললেও আমার মনে হয়, বাংলাদেশের টিকার যে সরবরাহ তাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের টিকা কর্মসূচির আওতায় আনার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। ইউনিসেফ আর ইউনেসকো প্রধানের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘স্কুলে যেতে না পারার কারণে শিশু এবং তরুণ জনগোষ্ঠী যে ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তা হয়তো কখনোই পুষিয়ে নেওয়া যাবে না। শেখার ক্ষতি, মানসিক সংকট, সহিংসতা ও নির্যাতনের সম্মুখীন হওয়া থেকে শুরু করে স্কুলভিত্তিক খাবার ও টিকা না পাওয়া বা সামাজিক দক্ষতার বিকাশ কমে যাওয়া—শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি তাদের শিক্ষাগত অর্জন এবং সামাজিক সম্পৃক্ততায় এর প্রভাব দেখা যাবে।’ আমিও একমত তাদের এই যুক্তির সঙ্গে।

আগেই বলেছি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধু পাঠ্যবই শেখায় না, জীবন শেখায়। আমার সবচেয়ে মায়া লাগছে, কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য। যেকোনও মানুষকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, তার জীবনের সেরা সময় কোনটা? সবাই বলবে, কলেজ জীবন। স্কুল পর্যন্ত সবাই অভিভাবকের কঠোর শাসনে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পুরো স্বাধীন হয়ে যায়। মাঝখানে কলেজ জীবন হলো, স্বাধীনতা আর পরাধীনতার দোলাচল, বৃহত্তর জগতের হাতছানি, এক রহস্যময় জগৎ। আমার ছেলে প্রসূন এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। ১ এপ্রিল তাদের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী সেটা ডিসেম্বরে হওয়ার কথা। ডিসেম্বরে হবে কিনা বা আদৌ হবে কিনা কেউ জানে না। প্রসূনরা তবু কিছু দিন কলেজের দেখা পেয়েছে, তার পরের ব্যাচ এখনও কলেজ কাকে বলে জানে না। নিজের কলেজ জীবনের স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে এই অসহায় প্রজন্মের জন্য আমার বড্ড মায়া  হয়। মনে আছে কলেজে ওঠার পর আমরা কত দুষ্টুমি করেছি। অনেক আপাত নিষিদ্ধ জিনিসের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে কলেজে। আমাদের কলেজ জীবনে বাংলাদেশ ছিল স্বৈরাচার কবলিত। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ব্যয় করেছি আমার যৌবনের উজ্জ্বল অধ্যায়। আর এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা জানলোই না কলেজ জীবন কাকে বলে। কলেজের চেহারা না দেখেই হয়তো কেটে যাবে তাদের কলেজ জীবন।

আহা জীবন, আহা কলেজ জীবন।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সীমান্তে কোনও ধরনের হত্যাকাণ্ড চায় না বাংলাদেশ
সীমান্তে কোনও ধরনের হত্যাকাণ্ড চায় না বাংলাদেশ
দুর্নীতির মামলায় মেজর মান্নান কারাগারে
দুর্নীতির মামলায় মেজর মান্নান কারাগারে
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের অবশ্যই জেতা উচিত: সাকিব
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের অবশ্যই জেতা উচিত: সাকিব
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ