X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আয়কর রিটার্ন ইমেইলে জমা নেওয়ার উদ্যোগ যে কারণে জরুরি  

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন
৩০ জুলাই ২০২১, ১৭:২১আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২১, ১৭:২১
মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেমে নেই। প্রকট থেকে প্রকট, তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে এর ভবিষ্যৎ বিস্তার। এর  প্রতিরোধের সাধ্যমতো চেষ্টা চলছে অবিরত। এ প্রচেষ্টায় কখন যে বিরতির নিশ্বাস ফেলা যাবে জানে না কেউই! এ অদৃশ্য শত্রু বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মানব ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। অসহায় মানুষ সর্বশেষ মহান রবের কাছে প্রার্থনা করে, তিনি যেন এ অদৃশ্য শত্রুকে ঘায়েল করার ক্ষমতা তাঁর সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাতকে দান করেন। আমিন।  

মহামানবদের জীবনী পড়লে দেখা যায়, তাঁরা সকল সময় বিপদে ধৈর্য ধারণের জন্য বলেছেন। আমরা ধৈর্য ধরছি। আমাদের আপনজন, প্রতিবেশী, কাছের মানুষ, পরিচিতজনকে ইতোমধ্যে বিদায় দিয়েও নিজেদের জীবন সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছি। যত দিন দেহে প্রাণ থাকবে বহমান, ততদিন আমাদের চলারগতি থাকবে চলমান। এ চলমান জীবনের সংগ্রামে সংসার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় কাজের সকল স্তরে বিরাজমান কার্যাদি যেন বিকল্প চিন্তার ভাণ্ডারে ঘুরপাক খাচ্ছে। পরিবারের প্রধানকে, সমাজের মাতাব্বরকে, অফিস প্রধানকে প্রতিনিয়ত বিকল্প ভাবতে হচ্ছে। এ বিকল্প ভাবনার ফলও আসছে দ্রুত। তাই তো আমরা অতিমারির সময়েও অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে সক্ষম হচ্ছি।

আমাদের সরকার রাজস্ব আদায়কে অতীব জরুরি সেবার আওতায় স্থান দিয়েছে। মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য অতি জরুরি সেবাগুলো যেমন অত্যাবশ্যক, তেমনি রাষ্ট্রীয় অর্গানগুলো সচল রাখার ক্ষেত্রে রাজস্বও একটি অতীব জরুরি খাত। আগে তেমন না বুঝলেও এখন তা বঝুতে আর অসুবিধা হয় না। তাই কঠোর লকডাউন ব্যবস্থার মধ্যেও রাজস্ব আদায় অব্যাহত রাখার প্রজ্ঞাপন আমরা দেখেছি।

এ জরুরি সেবা খাতটির একমাত্র উপাদান দেশের নাগরিকগণ। যারা নিজেদের আয়-রোজকারের অর্থ দিয়ে রাষ্ট্রকে চলার গতি দিয়ে থাকে।  প্রত্যেক করদাতা নাগরিক রাষ্ট্রের জন্য ডিম পাড়া হাঁসের মতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ডিম পাড়া হাঁসের প্রতি খামারিরা বিশেষ নজর রাখলেও করদাতা নাগরিকদের জন্য আমাদের রাষ্ট্রের করার তেমন কিছু নেই। বরং করদাতাদের হয়রানির অভিযোগ বিস্তর। তাই অনেক করদাতা জোর করে হলেও রাষ্ট্রকে 'ডিম' উপহার দিতে বিরাগ। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র বড়ই বোকা। জোর করে ডিম পাড়ানোর চেষ্টা করে। ফলে হাঁসও মরে, ডিমও ভেঙে চুরমার! কর আদায় ঋণাত্মক! বছর বছর ঘাটতি বাজেট; সংশোধিত বাজেট বা ঋণ করে ব্যয় নির্বাহ করা হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক ব্যাপার।  

একটু কৌশলী হলে রাষ্ট্র অল্প বিনিয়োগে ব্যাপক রাজস্ব আদায় করার সুযোগ পেতে পারে। সভা, সেমিনার, নাগরিক সংলাপে আমরা অনেক গুণী মানুষকে বলতে শুনি রাষ্ট্র সকল সহজ উদ্যোগগুলো নিচ্ছে। শত কোটি টাকাও বরাদ্দ দিচ্ছে, ব্যয় হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উদ্যোগটা আর আলোর মুখ দেখে না। এর অন্তরালে নাকি একটি চক্র আছে। এ চক্র সরকারকে তা করতে বাধাগ্রস্ত করে। করদাতারা অসহায় প্রাণীর মতো এ বাণীগুলো শুনে অবাক! সরকার নাকি চক্রের মধ্যে জিম্মি। তাহলে সরকারের দরকার কী? প্রতিটি জায়গা একটি করে চক্র সক্রিয় করে দিয়ে সরকার হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকুক বা বিদায় নিয়ে ক্লান্তির নিশ্বাস ফেলুক। তবু তো আমরা বাঁচি। চক্রটি কিছুদিন চক্রান্ত করে ক্লান্ত হয়ে বলবে এবার করদাতাদের জন্য কিছু করি। এগুলো আমার আক্ষেপের কথা!

বাস্তবতা হলো সরকার চাইলে যেকোনও উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারে, এবং ভালোভাবে পারে। তাই করদাতা নাগরিকদের কষ্ট লাঘব করা যায় এমন কিছু করার উদ্যোগ নিলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ফলাফল আসবে।

এ ক্ষেত্রে চক্রকে দমন করার দায়িত্ব সরকারের। করদাতারা যত কম ঝামেলায়, সহজে ও নিরাপদে আয়কর পরিশোধ, নথি জমা ও সেবা পেতে পারে তার উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার বিগত ১১ জুলাই ২০২১ তারিখে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের স্মারক নং ০৪.০০.০০০০.৫১৪.১৬.০০১.২১.২২৩-এর মাধ্যমে সরকারি সকল অফিসের দাফতরিক কাজসমূহ ভার্চুয়ালি (ই-নথি, ই-টেন্ডারিং, ই-মেইল, এসএমএস, হোয়াটস অ্যাপসহ অন্যান্য মাধ্যমে) সম্পন্ন করার ঘোষণা করেছে। এটা সময়োপযোগী একটি কাজ। এটা বাস্তবায়ন করা হলে অবশ্যই দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল থাকবে বাধাহীনভাবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ সার্কুলারের বাইরে নয়। তবু রাজস্ব আদায় ও আয়করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধিও চলমান উদ্যোগগুলোর সঙ্গে অতিদ্রুততম সময়ের জন্য সার্কেলভিত্তিক ই-মেইল-এর মাধ্যমে রিটার্ন জমা নেওয়ার উদ্যোগ প্রয়োজন। কারণ বিগত বছর সীমিত পরিসরে সার্কেলভিত্তিক করমেলা হলেও এবার তা করা আদৌ সম্ভব কিনা, তা বলা কঠিন। তাই প্রতিটি সার্কেল থেকে একটি অভিন্ন ই-মেইল চালু করা হোক, যেখানে করদাতা বা তার প্রতিনিধি আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। করদাতার পক্ষে ইমেইল করার সঙ্গে সঙ্গে বা ই-মেইলটি গ্রহণ করার পর ফিরতি একটি ইমেইলে প্রাপ্তি স্বীকার অটোমেটিক চলে আসবে। এ ফিরতি ইমেইলটি হবে করদাতার জন্য প্রাপ্তিস্বীকার। ইমেইলভিত্তিক আয়কর রিটার্ন জমা নেওয়ার এ উদ্যোগটি হতে পারে এ সময়ের জন্য একটি সেরা উদ্যোগ।  

অনেকে বলবেন অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, তাই ইমেইলে দেওয়ার প্রয়োজন কী? কিন্তু অনলাইনে যে বিস্তারিত তথ্য দিতে হয়, অনেক করদাতার পক্ষে তা বুঝা বা ধাপে ধাপে তথ্য দিয়ে রিটার্ন জমা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে অনেকে এ সেবাটি গ্রহণ করতে তেমন আগ্রহী হচ্ছেন না। তবে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন ব্যবস্থা সহজীকরণ করেও রাজস্ব করদাতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা যেতে পারে। যে উদ্যোগই নেওয়া হোক, তা যেন ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয় এবং করদাতাদের বুঝতে সহযোগিতা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। নতুবা উদ্যোগগুলো কাজে আসবে না।

সম্প্রতি একটি ঘটনা বলে আজকের বিষয়টি শেষ করবো। আমি নিজে চলতি মাসে একটি ভ্যাট সার্কেল-এ বাংলা ফরমেটে একটি ভ্যাট রিটার্ন ইমেইলে সাবমিট করার জন্য সংশ্লিষ্ট সার্কেল কর্মকর্তাকে অনুরোধ করি। তিনি আমাকে উত্তর দিলেন, ইমেইলে রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে না। আমি উত্তর দিলাম সরকারি সিদ্ধান্ত আছে, আপনারা মানছেন না কেন? তিনি বলেন, আমাদের জন্য তা প্রযোজ্য নয়। ফোন কেটে গেলো। কিছুক্ষণ পরে তিনি ফোন দিলেন, বললেন আপাতত জমা দেন, অফিস খোলার পর হার্ডকপি জমা দিয়ে দেবেন। আমি সম্মতি দিলাম এবং ইমেইলে পাঠালাম। ৩০ মিনিটি পর তিনি আবার ফোন দিলেন, বললেন, বাংলা ফরমেট গ্রহণযোগ্য নয়। আমি বললাম, ইংরেজি ফরমেট পাচ্ছি না। আপনার কাছে থাকলে একটু পাঠিয়ে দেবেন। তিনি উত্তর দিলেন, এগুলো আমাদের কাছে নেই, থাকে না। আপনার প্রয়োজনে আপনি সংগ্রহ করে নেবেন। আপনাকে যেমন নিজের প্রয়োজনে বিআইএন নম্বর নিতে হয়েছে, তেমনই রিটার্ন জমার ফরমেটও নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করতে হবে। এনবিআর অফিসের সামনে বিক্রি হয়, সেখান থেকে কিনতে পারেন।

ওনার কথা শোনার পর আমি বললাম, আপনার কথাটি আমি মেনে নিতে পারছি না। আপনার দায়িত্ব হচ্ছে আমাকে ফরমেট সংগ্রহ করে দেওয়া। আপনি আমাকে সরকারি বিনামূল্যের ফরম কিনতে বলতে পারেন না।

এ অফিসারকে আমি সরাসরি দেখিনি। মনে হয়েছে নতুন চাকরিতে যোগদান করেছেন। আমার মনে হলো তিনি আমার কথা একটু আমলে নিলেন। আচ্ছা রাখি বলে ফোনটা কেটে দিলেন। তারও ২৫-৩০ মিনিটের মধ্যে আমার ইমেইলে ইংরেজি ফরমটি পাঠালেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং প্রশংসা করে একটি মেইলের উত্তর দেই। তিনি আমার কাছে এরপর দুই দুইবার ফোন করেছেন এবং আমাদের মধ্যে ভালো আলোচনা হয়েছে।

এ আলোচনাটা আনলাম এজন্য যে আমাদের নাগরিকরা যেমন কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেন, তেমন কর আদায়কারী কর্মকর্তাদের মাঝেও কিছুটা ভাব কাজ করে এমন- আইন মোতাবেক সব দায়িত্ব নাগরিকের, সময় মতো তা না দিলে জরিমানা ও জেল হতে পারে। সুতরাং আমার এখানে কাজ কী? করদাতার কাজ করদাতাই করবেন। কিন্তু না, করদাতারা সচেতন হলে কর আদায়কারীরাও দায়িত্বশীল হবেন।    

লেখক: আয়কর আইনজীবী
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ