X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘টিকটক অপু’র ‘জাতে ওঠা’ নিয়ে গাত্রদাহ

ডা. জাহেদ উর রহমান
২৮ আগস্ট ২০২১, ১৭:২৯আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০২১, ১৭:২৯

ডা. জাহেদ উর রহমান ‘টিকটিক অপু’র চুল আর এক ‘সংকীর্ণ বারান্দা’র কথা’– শিরোনামে অপুকে নিয়ে এক বছর আগে একটা লেখা লিখেছিলাম বাংলা ট্রিবিউনেই। লেখাটি তাকে নিয়ে, ঠিক সেটা নয়। আমার আর সব লেখার মতোই তার সেই ঘটনাটিকে একটি উপসর্গ হিসাবে বিবেচনা করে পৌঁছতে চেয়েছিলাম রোগের কাছে। এই লেখাতেও অপুকে নিয়ে সাম্প্রতিক আরেকটা ঘটনাকে ধরে মূল বিষয়ের কাছে পৌঁছার চেষ্টা করবো।

অপুকে নিয়ে আগে যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি লিখেছিলাম সেটা একটু মনে করে নেই। টিকটকে ভিডিও বানিয়ে বিখ্যাত হওয়া অপু মারামারির একটা মামলায় গ্রেফতার হয়েছিল গত বছর। সেই গ্রেফতারের পর তাকে নিয়ে সংবাদ হয়েছে নানা মিডিয়ায়। সোশ্যাল মিডিয়াতেও আমরা অনেক কথা বলেছি তাকে নিয়ে। কিন্তু আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল আরেকটি ব্যাপার।

অপু থানায়, এমনকি অবিশ্বাস্যভাবে আদালতেও তার চুল নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। আদালত অপুর কাছে জানতে চেয়েছিল, ‘তোমার চুলের এই অবস্থা কেন?’ অপু তখন পুরো নীরব ছিলেন; কোনও উত্তর দেননি। তবে তার আইনজীবীকে জবাব দিতে হয়েছে। আদালতকে তিনি জানান– ‘অভিনয় করা জন্য এমন কালার করতে হয়’। আগের লেখাটিতে অপুকে এমন প্রশ্ন করার এখতিয়ার নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছিলাম। বলেছিলাম একটা রাষ্ট্র নাগরিকের ব্যক্তিজীবনের চৌহদ্দিতে কোন পরিস্থিতিতে কতটুকু ঢুকতে পারে সেটা নিয়ে।

‘অপু ভাই’ আবার ভীষণ আলোচনায়। মূলধারার একজন চলচ্চিত্র পরিচালক অপুকে তার একটি ওয়েব সিরিজের জন্য চূড়ান্ত করেছেন। সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করতে যাচ্ছেন তিনি। এই খবর জানিয়ে এবং অপুর নতুন একটি লুকের ছবি যুক্ত করে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন সেই পরিচালক। তারপর সামাজিক মাধ্যমে সেটা নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এখনকার সময়ে যা হয়, সামাজিক মাধ্যমের কোনও ট্রেন্ড যদি খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠে, মূলধারার মিডিয়াও সেটা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

অপুকে নিয়ে এই সিদ্ধান্ত কিছু মানুষকে এতটাই ক্ষুব্ধ করেছে যে পরিচালক অনন্য মামুনকে তার সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে আবার স্ট্যাটাস দিতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, দেখলাম একটা গুরুত্বপূর্ণ নিউজ পোর্টালও এই বিষয়ে অপুর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। 

সমালোচনার জবাবে অপু বলেন, ‘যদি ভালো কিছু করতে চাই, মানুষ সমালোচনা করবেই। যারা আমাকে নিয়ে সমালোচনা করছেন, তাদের আমি অনেক ভালোবাসি। কারণ তারা কিন্তু আমাকে ইগনোর করে না। তারা আমাকে দেখে, আমার কাজগুলো নিয়ে সমালোচনা করে বা কথা বলে– এটাই আমার জন্য অনেক কিছু। এটাকে আমি আশীর্বাদ হিসেবে দেখছি।’

কেন অপুকে একটা ওয়েব সিরিজে নেওয়া এতটা খারাপভাবে নিয়েছে আমাদের ‘সচেতন’ নাগরিক সমাজের অনেকে? জবাবটা পাওয়ার জন্য যতগুলো সম্ভব রিপোর্ট পড়ার চেষ্টা করলাম। সেগুলোতে সামাজিক মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে অনেকের দেওয়া যুক্তিগুলো দেখতে পেয়েছি।

অপুর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, অভিনয়ে তার নাকি যথেষ্ট জ্ঞান-দক্ষতা নেই। এই প্রসঙ্গে অনেকের ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে এই বলে বছরের পর বছর অনেক থিয়েটারকর্মী প্রচণ্ড ত্যাগ স্বীকার করে তাদের অভিনয় চর্চা চালিয়ে যান, কিন্তু আমাদের অনেক পরিচালক সেসব অভিনয়শিল্পীকে মূল্যায়ন করেন না। অভিযোগ এসেছে সামাজিক মাধ্যম টিকটকে পরিচিতির সূত্র ধরে ‘সস্তা জনপ্রিয়তা’ পাবার জন্য পরিচালক এমন একজনকে তার সিরিয়ালে নিচ্ছেন। আলোচনায় এসেছে অপুর অতীত অপরাধের অভিযোগের প্রসঙ্গ। আর সাম্প্রতিককালে যেহেতু টিকটককে কেন্দ্র করে নারী পাচারসহ বেশ কিছু মারাত্মক অপরাধ সংগঠনের অভিযোগ এসেছে, তাই টিকটকও আবার এসেছে আলোচনায়।

সমালোচনাকারীরা যেহেতু জানেন কোন কথা বলতে হবে আর কোনটা বলতে হবে না, তাই আসল কথাটা তারা চেপে গেছেন বলে আমার বিশ্বাস। কিংবা তারা হয়তোবা নিজের অবচেতনের এই কারণটাকে স্বীকার করবেন না নিজের কাছেই। মূল কারণ নিয়ে আমার এই অনুমান নিয়ে কথা বলার আগে যেসব কারণ প্রকাশ্যভাবে বলেছেন, সেগুলো নিয়ে কয়েকটা কথা বলে নেওয়া যাক।

অপু অভিনয় জানেন কিংবা জানেন না– সেটা দর্শককেই বিচার করতে দেওয়া যাক। অপুর ওয়েব সিরিজটি মুক্তি পায়নি এখনও। তার আগেই আমরা বলতে পারি না সেটির কী অবস্থা হবে। আর মুক্তির পরও আমাদের অনেকের কাছে মনে হতেই পারে সেখানে অপুর অভিনয় একেবারে ভালো হয়নি। কিন্তু যদি তাকে প্রচুর দর্শক গ্রহণ করে তাহলে সেটা নিয়ে আমাদের আপত্তি থাকার কোনও কারণ নেই। অভিনয়ের মান ভালো হয়েছে, না খারাপ সেটা আসলে খুব সাবজেক্টিভ ব্যাপার।

চলচ্চিত্রে বা টিভি মাধ্যমে অভিনয় করার জন্য থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড খুব জরুরি, আমি অন্তত মনে করি না। থিয়েটার অভিনয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্কুলিং দেয়, এটাকে উড়িয়ে না দিয়েও কয়েকটা কথা বলতে চাই। আমরা অনেকেই জানি রেডিও, মঞ্চ ও চলচ্চিত্র প্রতিটি মাধ্যমে অভিনয়ের ফর্ম অনেকটাই আলাদা। একটা ফিক্সড জায়গায়, অনেক দূরে বসে মঞ্চে নাটক দেখার ক্ষেত্রে দর্শক অভিনেতাদের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দেখতে পায় না। এই সীমাবদ্ধতাকে উৎরে দর্শককে ম্যাসেজ পৌঁছে দিতে গিয়ে মঞ্চে স্বাভাবিক জীবনের চাইতে অনেক বেশি মাত্রায় শারীরিক অভিনয়, এবং ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন এবং ভয়েস অ্যাকটিং করতে হয়। অর্থাৎ মঞ্চের অভিনয় আমাদের স্বাভাবিক জীবনের বাস্তবতার চাইতে অনেকটাই আরোপিত। ক্যামেরায় নানা দৈর্ঘ্যের শটে মানুষকে দেখানো যায় বলে তাতে এই অতিরঞ্জনের প্রয়োজন পড়ে না। এই দেশের অতি বিখ্যাত একজন অভিনেতার টিভি এবং সিনেমার অভিনয়ে অনেক ক্ষেত্রে আমি মঞ্চের অভিনয়ের এই অতিরঞ্জন খুঁজে পেয়েছি।

বাজার অর্থনীতিতে শিল্প একটা পণ্য, আর দশটা পণ্যের মতই। আর আলোচিত পরিচালক অন্তত কোনও অল্টারনেটিভ সিনেমা (কথ্য কথায় ‘আর্ট ফিল্ম’) বানানো পরিচালক নন, তিনি পরিচিত একজন বাণিজ্যিক সিনেমার পরিচালক হিসাবেই। তাহলে অপুর টিকটকের অসংখ্য ফলোয়ারের কারণে তার ওয়েব সিরিজের দর্শক যদি বাড়ে এবং সেই চিন্তা করে তিনি যদি অপুকে তার সিরিজে নিয়ে থাকেন, তাতে দোষের কী আছে?

আসা যাক, অপুকে নিয়ে আমাদের যেখানে মূল সমস্যা, সেটার প্রসঙ্গে। আমি বিশ্বাস করি মূল কারণ হচ্ছে– একজন ‘তুচ্ছ’ অপু ভাইয়ের ‘জাতে ওঠা’টা আমরা গ্রহণ করতে পারছি না। কারণ অপু আমাদের মতো নয়। আমাদের সকলের হাতে যতটুকু আর্থিক, বিশেষ করে সামাজিক পুঁজি জন্ম থেকেই বা বেড়ে ওঠার সময় থেকেই ছিল তার তুলনায় ছিটেফোঁটাও ছিল না অপুর কাছে।

গত বছর অপু ভাই গ্রেফতার হওয়ার পর তার জীবন সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছিলাম; সেটা এখন আবার আলোচনায় এসেছে। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেলে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ির গ্রামে নানার বাড়িতে বড় হয় সে। সেখানে এক কওমি মাদ্রাসায় ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে। অভাব অনটনের কারণে বেশিদূর পড়ালেখা করতে পারেনি। কিছুদিন কাজ শেখার পর মোবাইল ও টিভি মেকানিকের কাজ করা শুরু করে। এরপর কাজ করে সোনাইমুড়ি বাজার ও জেলা শহরের বিভিন্ন সেলুন দোকানে। তারপর সে টিকটক ভিডিও বানাতে শুরু করে।

অপুর বানানো টিকটক ভিডিওগুলোতে দেখা যায় তার শরীরে ক্রনিক অপুষ্টির ছাপ আছে। তার ভাষা, ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন, শারীরিক ভাষা আমাদের মতো ‘মার্জিত’ নয়। এজন্যই বোধ করি অপুর ভাষা নিয়ে কাজ করার কথা জানিয়েছেন পরিচালক। জানিয়েছেন অপুকে অভিনয় নিয়ে গ্রুমিং করা হয়েছে।

টিকটকে অপু যা যা করেছে, বলেছে সেগুলো আমাকে আকৃষ্ট করেনি মোটেও। অপু যে মানুষদের জন্য তার ভিডিও বানিয়েছেন, আমি নিশ্চিতভাবেই সেই শ্রেণিতে পড়ি না। কিন্তু সেই কারণে আমি অপুকে মোটেও খারিজ করে দেই না। আমার আপনার মতো অনেককেই অপু আকৃষ্ট করতে পারেনি, কিন্তু পেরেছে অসংখ্য মানুষকে। পত্রিকার রিপোর্টে দেখেছি অপুর জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল এমনকি নোয়াখালী থাকা অবস্থাতেই ঢাকা থেকে গাড়ি ভাড়া করে অনেক তরুণ-তরুণী গিয়ে অপুর সাথে টিকটক ভিডিও বানানোর অংশগ্রহণ করেছে।

মধ্যবিত্ত থেকে ওপরের দিকে ধনী পর্যন্ত আর্থ-সামাজিক শ্রেণিগুলো ইতিহাসের সব সময় সমাজের সবকিছুর নির্ধারক হয়ে ছিল। তাদের আর্থিক এবং সামাজিক পুঁজি তাদের হাতে এই একচেটিয়া ক্ষমতা দিয়ে রেখেছিল। এদেরকে এড়িয়ে কারো পক্ষে শিল্প-সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব ছিল না। ওই শ্রেণিটিই নির্ধারণ করতো সমাজে কে কতটা পরিচিতি পাবে, কতটা সেলেব্রিটি হবে। সর্বোপরি তারাই ঠিক করেছে কোনটা শিল্প হবে আর কোনটা হবে না, তারাই নির্ধারণ করেছে শিল্প কীভাবে করতে হবে।

গত বেশ কয়েক বছরে নানারকম সামাজিক মিডিয়া আগের সব প্রতিষ্ঠানগুলোর একচেটিয়াত্ব ভেঙে দিয়েছে। সেই অর্থে এসব মিডিয়া পুঁজিবাদের বড় অস্ত্র হলেও এক ধরনের সাম্যবাদ তৈরি করেছে। এখন পূর্বের প্রচলিত সব মিডিয়াকে পাশ কাটিয়েও কেউ সেলিব্রিটিতে পরিণত হতে পারেন এবং সেটার স্বীকৃতি একটা পর্যায়ে সাবেকি মিডিয়া, প্রতিষ্ঠানগুলোও দিতে বাধ্য হয়।

এমন অনেক মানুষ সেলেব্রিটি হিসাবে বেরিয়ে আসছেন যারা এই কয়েক বছর আগেও সেটা হতে পারার প্রশ্নও আসতো না। আমরা যারা সমাজে এই ক্ষেত্রের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতাম তাদের ‘রুচির ফিল্টারে’ আটকে যেত তারা।

এখন অনেকেই এই সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে বড় ফ্যান-ফলোয়ার তৈরি করে ফেলছেন। তারা এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠছেন যে তাদেরকে আর আমরা অনেকেই উপেক্ষা করতে পারছি না। আবার অনেকে এই পরিবর্তনটা মেনে নিতে পারছি না, তাই আমাদের গাত্রদাহ হয়। তাদেরকে অবজ্ঞা করে সেই ক্ষত কিছুটা উপশম করার চেষ্টা করি। কিন্তু এসব কোনও কিছুই সামনের সময়টাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

লেখাপড়া না জানা/কম জানা, অপুষ্টির শিকার দেহ, আমাদের মানদণ্ডে ‘আনকালচার্ড’ কথা, আচরণের মানুষ বড় তারকা হয়ে উঠবেই। আমরা কী ভাবলাম, তাতে কিছু আসবে যাবে না। যারা এই বাস্তবতা বুঝবো তারা এই প্রবণতা মেনে নিতে না পারি, অন্তত মেনে নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। এটাই হতে পারে ‘অপু ভাই’দের নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার, সমাজে তার জায়গা তৈরি করার, ‘জাতে ওঠার’ ডামাডোলের মধ্যে গাত্রদাহ হওয়া থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ