X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্কুল যখন খুলছে

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৬:০৬আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৯:২৫

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

আজ হোক বা কাল, ধীরে ধীরে আমাদের সব স্কুল-কলেজ খুলতোই। তো সেই সময় এখন আমাদের নিকটে। সংক্রমণের ভয় এবং আগেকার প্রাত্যহিক রুটিনে ফেরা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা নিয়েই ৫৪৩ দিন পর খুলছে স্কুল ও কলেজ। চলতি ও পরবর্তী বছরের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস করবে প্রতিদিন। আর বাকিদের সপ্তাহে একদিন। সীমিত পরিসরে খোলা হলেও এতে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা।

এখন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা মিলে তাদের স্কুলগুলোকে কীভাবে সুষ্ঠু এবং নিরাপদ উপায়ে প্রাত্যহিক ছন্দে ফেরাবেন, সে ব্যবস্থা অবশ্যই করবেন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমনিতেই নড়বড়ে। গত প্রায় দু’বছর ধরে অতিমারি পরিস্থিতিতে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছে। এ সময় শহর ও গ্রাম, ধনী ও দরিদ্র পড়ুয়াদের মধ্যে বিভাজনটা স্পষ্ট হয়েছে ডিজিটাল বা অনলাইন নামের এক ধোঁয়াশা সিস্টেমে। ক’জনের স্মার্টফোন আছে? ক’জনই বা ইন্টারনেটের সুবিধা পায়? অ্যাসাইনমেন্ট বা অটোপাস যে পদ্ধতিতেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়েছে, তা ছিল এক কথায় মূল্যহীন।

সম্প্রতি ইউনিসেফ প্রকাশিত একটি সমীক্ষা জানালো, সারা পৃথিবীর অন্তত ৩০ শতাংশ বাচ্চার কাছে ফোন বা ইন্টারনেটের সুবিধা নেই। বাংলাদেশে এই অনুপাতটা নিশ্চয়ই অনেক বেশি হবে। তার ওপর সমীক্ষা বলছে, বঞ্চিতদের তিন-চতুর্থাংশই গ্রামাঞ্চলের এবং দরিদ্র পরিবারের। উপায়ান্তর না দেখে দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকরা ‘সুপাত্র’ দেখে কন্যাদের বিয়ে দিয়েছেন, ছেলেদের মাঠে, ঘাটে, সড়কে, মহাসড়কে কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। দৈনিক প্রথম আলো জানিয়েছে, করোনার সময়ে স্কুল বন্ধ থাকায় সাতক্ষীরার এক স্কুলেরই ৫৬ জন মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়েছে। দীর্ঘদিন স্কুলের সঙ্গে সংযোগ না থাকার কারণে বাচ্চাদের অনেকেই স্কুলছুট হয়ে গেছে। এদের অনেকেই আর কোনও দিন ক্লাসে ফিরবে না।

সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে শেখার। বলতে গেলে বিশাল একটা প্রজন্ম পাঠের অন্তর্গত বিষয়ের প্রায় কিছুই শিখতে পারলো না। স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের অনেকেই ভাষা ও গণিত বিষয়ক সামর্থ্যের দিক দিয়ে পিছিয়ে গেছে। এমনিতেই এক-দু’সপ্তাহ বন্ধ থাকলে বাচ্চারা অনেক কিছু ভুলে যায়, তাদের নতুন করে শেখাতে হয়। মাসের পর মাস পড়ার সঙ্গে পড়ুয়াদের যোগাযোগ না থাকার হিসাবটা বড় কঠিন। ভাবলে এক দুঃস্বপ্ন তাড়া করে। অনেকে শিশু শ্রেণির বা প্রথম শ্রেণির ক্লাসে আসতেই পারেনি। অনেক ছাত্রছাত্রী কলেজের বারান্দাও না দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেছে।

ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান শেখার সঙ্গে সঙ্গে জরুরি শিশুদের সামাজিক শিক্ষা, নিজের পরিবারের মানুষের বাইরের কারও সঙ্গে মেশা। স্কুল বন্ধ থাকায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়নি, খেলতে পারেনি, প্রকৃতিকে দেখতে পারেনি তারা। তাই এখন খোলার পর এই মনোজগতটা নিয়েও শিক্ষকদের ভাবতে হবে।

এটা শুধু যে সমাজের একটি শ্রেণি করোনাকালে কিছু কম লেখাপড়া শিখলো, তা নয়; আশঙ্কা হচ্ছে, এই বাচ্চাদের এক বড় অংশই হয়তো আর কখনও শিক্ষার মূলস্রোতে ফিরবে না। তাই বলছি, বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয় খুলছে, কিন্তু অনেককেই আর দেখা যাবে না শ্রেণিকক্ষে। দেশের কয়েক কোটি শিশু কিশোরের জীবন থেকে তাদের শৈশব আর কৈশোর চলে গেছে। বন্ধু, শিক্ষক, স্কুল, কলতলা, খেলার মাঠ, আকাশের রঙ, গাছের পাতা, পাখির ডাক, আইসক্রিম বিক্রেতার আহ্বান, মাটির গন্ধ, রোদে আর বৃষ্টিতে ভেজা - সব হারিয়েছে তারা। যারা ফিরবে তারা অনেক বন্ধুকে, সহপাঠীকে মিস করবে।  

করোনার স্বাস্থ্যবিধি তো মানতেই হবে, কিন্তু শিক্ষকদের আরও বেশি কিছু দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষকরা নিশ্চয়ই চেষ্টা করবেন শিক্ষার্থীদের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে মনোনিবেশ করার। জানার চেষ্টা করবেন, এমন এক কঠিন সময়ে পড়াশোনায় কতটা ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও জরুরি জানা যে, এই সময়ে সে কেমন ছিল এবং তার বাড়ির পরিস্থিতি কেমন ছিল, কীভাবে মোকাবিলা করেছে কোভিড পরিস্থিতি।

যারা আনলাইনে ক্লাস করেছে বা করতে পেরেছে, আর যারা পারেনি - একই ক্লাসে এমন দু’পক্ষকেই পাওয়া যাবে। যারা পারেনি তারা স্বাভাবিক কারণেই কিছুটা পিছিয়ে থাকবে। এরা যাতে অন্যদের কাছাকাছি যেতে পারে তার জন্য স্পষ্টতই কিছু করা প্রয়োজন।

শিক্ষক শিক্ষিকাদের জন্যও বিষয়টা চ্যালেঞ্জের। স্কুলের সঙ্গে আবার যুক্ত হওয়া এবং নতুন করে পড়াতে শুরু করার চ্যালেঞ্জটাও কম নয়। স্কুল খোলার পর শহরের প্রতিষ্ঠানগুলো নানা উপায়ে পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মেলাবে। তবে গ্রামের স্কুলগুলোকে নিয়ে ভাবনা অনেক। এখানে অভিভাবক, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের সবাইকে নিয়ে একটা প্রচেষ্টা নিতে হবে বাচ্চাদের প্রাথমিক ভিত্তিটা যে নষ্ট হয়েছে তাকে পুনর্গঠন কীভাবে করা যায়। খুব ছোট বাচ্চারা যেন বই থেকে পড়ে যেতে পারে এবং নির্ভয়ে অঙ্ক কষতে পারে, সেটাই চাওয়া এখন। অনেক বেশি কিছু নয়।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘খেলাধুলার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিরা দ্রুত নেতৃত্ব দিতে সক্ষম’
‘খেলাধুলার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিরা দ্রুত নেতৃত্ব দিতে সক্ষম’
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ