X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাউন্ড বক্স থামুক, পাড়া জুড়াক

শেগুফতা শারমিন
২২ জানুয়ারি ২০১৮, ১৫:০২আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০১৮, ১৫:১৬

শেগুফতা শারমিন ট্রাম্প থেকে প্রণব। আরাকান থেকে ফিলিস্তিন। রোহিঙ্গা থেকে নির্বাচন। বড় বড় ইস্যু। বড় বড় চিন্তা। বড় বড় হেডলাইন। লম্বা লম্বা আলোচনা। এতশত ইস্যুর ভিড়ে আমাদের কয়জনের নজরে পড়েছে গত শনিবারের পত্রিকার একটা ছোট্ট খবর। বিষয়– ‘নাজমুল হকের মৃত্যু’। নাজমুল হক কে? না ভাই, উনি কোনও ট্রাম্প, প্রণব নন। উনি ছোট বা বড় কোনোরকম কোনও কেউকেটা নন। একজন খুব সাধারণ নাগরিক। আমার বা আপনার মতোই। নিতান্ত আম জনতার প্রতিনিধি। তাহলে এইরকম একজন সাধারণ মানুষের মৃত্যুর খবর কেন পত্রিকায় আসলো আর কেনইবা আমাদের তা নজরে পড়তে হবে? যখন আমরা চিন্তায় আছি উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন আদৌ হবে কিনা!
সিটি করপোরেশন ইলেকশন আজ হোক বা কাল। ট্রাম্প আরো এক টার্ম ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক। প্রণবের সাথে দাঁড়িয়ে বা বসে কেউ ছবি তুলুক বা না তুলুক। কোনোটাই আমার আপনার দৈনন্দিন যাপিত জীবনে তাৎক্ষণিক প্রভাব রাখে না। যতটা প্রভাব রাখে নাজমুল হকের মৃত্যু। তাই নাজমুল হকের মৃত্যুকে আমাদের গোনায় ধরতে হবে। কারণ প্রতিনিয়ত এই মৃত্যু ঝুঁকির মুখে আছি আমরা সবাই। শিশু থেকে বৃদ্ধ, ধনী থেকে গরিব, এই নগরের অধিবাসীরা কেউ বাদ নেই, এই ঝুঁকি থেকে।

যে ঝুঁকি তৈরি করছি আমরা নিজেরাই। দূষিত খাবার যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিকর। দূষিত শব্দও ঝুঁকিকর। তফাৎ হচ্ছে, খাদ্যে দূষণ করে কতিপয় ব্যবসায়ীরা কিন্তু শব্দদূষণ করি সবাই। আমাদের নাগরিক শিক্ষার অভাব, পারস্পরিক সম্মানবোধের অভাব, অন্যের প্রতি সহনশীলতার অভাবে আমরা অনায়াসে শব্দদূষণ করি। নিজের আনন্দ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে আমরা শব্দদূষণ করি। বিন্দুমাত্র চিন্তা করি না, পাশের জনের প্রতি কোনও অসহনশীল আচরণ করলাম কিনা। বাড়িতে বিয়ে বা গায়ে হলুদ। বাজাও বাদ্য। উচ্চরবে। বড় বড় সাউন্ড সিস্টেম। তুলকালাম হিন্দি গান। রাত বাজে এগারো বা বারো। যত রাত তত জমজমাট। এক বাড়িতে বিয়ে মহল্লা জুড়ে কারও ঘুম নাই। আসলে ঘুমের অবস্থা নাই। ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের একটি। এই শহরে প্রতি এক বর্গ কিলোমিটারে বাস করে ৪৫ হাজার মানুষ। পৃথিবীর দ্বিতীয় ঘনবসতির শহর মুম্বাইয়ে যা ৩১ হাজার জন। তো এক বাড়িতে বিয়ে মানে আসলে সেই গানের আওয়াজ শুনতে হচ্ছে অন্তত ৪৫ হাজার মানুষকে। এবং যথারীতি সেই ৪৫ হাজার মানুষের সবাই বিয়ের আনন্দ উপভোগ করার মুডে নাই।

কেউ হয়তো অসুস্থ। কারও বাড়িতে মৃত্যুশোক। কারও পরীক্ষা। কারও চাকরি চলে গেছে। কারও ব্যবসায় ধস নেমেছে। কারও বাড়িতে বাজার নাই। কারও রান্না হয় নাই। কারও বাচ্চার স্কুলে বেতন দেওয়া হয় নাই। কারও স্বামী বউ পিটিয়েছে। মোট কথা সমস্যার শেষ নাই। ৪৫ হাজার মানুষের ৯০ হাজার সমস্যা। এর ভেতর চলছে ‘বেবি ডল’ বা ‘নাগিন নাগিন’। যার বিয়ে সে করবে। কারও কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু এই এত এত মানুষকে যন্ত্রণা দিয়ে কেন? এরকম এক যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন বলেই আর কে মিশন রোডের বাসিন্দা নাজমুল হককে জীবন দিতে হয়েছে। কালকে কে সিরিয়ালে আছেন, কে জানে?

পৃথিবীর প্রায় সব শহরের বাসিন্দারা সাবধানে থাকেন, সচেতন থাকেন যেন কোনোভাবে প্রতিবেশীর বিরক্তি তৈরি না হয়। এ বাড়ির শব্দে যেন ও বাড়ির বিড়ালটারও ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। মানুষের এই সচেতনতা এই বোধ তার শিক্ষার বহিঃপ্রকাশ। আর আমাদের দেশে আনন্দ ফুর্তি মানেই উচ্চরব, কোলাহল। তাও আবার সাউন্ড বক্সের মুখ বাইরের দিকে দিয়ে। বাসার পাশে কমিউনিটি সেন্টার। সেখানে পার্টি হবে, স্বাভাবিক। মানুষ টাকা দিয়ে ভাড়া নেবে। হইচই, গান বাজনা তো করবেই। কিন্তু সাউন্ড বক্সটাকে ভেতরে রেখে গান বাজালেই হয়। তা না। অনুষ্ঠান হবে, খাওয়া দাওয়া হবে ভেতরে। গান বাজবে বাইরে। ওপেন এয়ার। একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গিয়ে যে একটা সামাজিক অপরাধ হয়ে গেলো, কারও সে বোধ নাই।

রাস্তার উল্টোদিকে পোশাকের এক শো রুমের উদ্বোধন হবে। আয়োজন দোকানের ভেতর। সাউন্ড বক্স রাস্তার রোড ডিভাইডারে। বিয়ে অথবা দোকানের উদ্বোধন, জন্মদিন বা জাতীয় দিবস। উদ্দেশ্য যা হোক আয়োজন একরকম। সাউন্ড বক্সে জোরে শব্দ। গান মানে সেই হিন্দি বেবি ডল আর নাগিন। বাংলা বাপুরাম সাপুড়ে। এর বাইরে আছে কুলখানি, মৃত্যুবার্ষিকী বা ওয়াজ। কনটেন্ট এবার ভিন্ন। কিন্তু পরিবেশনায় সেই বহির্মুখী মাইক বা সাউন্ড বক্স। উচ্চ শব্দ। বলছিলাম, ঢাকার কথা। নগরবাসী নাগরিক সভ্যতা শিখে নাই। সভ্য আচরণ করে না। আর নগরবাসীদের অন্ধ অনুসরণ করে গ্রামের মানুষ। মাসখানেক আগে গ্রামে গিয়ে শুনি, পরপর তিনরাত মাইক বাজে। দূরে কোথাও, বহু দূরে। জানি না, দেখি না। শুধু শব্দ শুনি। আর শীতের রাতে জেগে থাকি, নির্ঘুম।

মানুষের দেখে ভালোটা শেখার চেয়ে মন্দটা শেখার গতি বেশি। মন্দটা ছড়াতে ছড়াতে আমরা ভুলে যাই, কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। মন্দটাই হয়ে যায় সংস্কৃতি। এমন সংস্কৃতি, যা প্রমাণ করে আমাদের অসভ্যতা, অন্যের প্রতি উদাসীনতা। নিজেরাই গড়ি, নিজেরাই ভুগি। নিজে না ভোগা পর্যন্ত অনুধাবণও করি না। বোকায় ঠেকে শেখে। আসুন নিজে ঠেকা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে নাজমুল হকের মৃত্যু দেখে শিখি। নিজে আওয়াজ কমাই। আর নিজে নিজে কেউ না কমাতে চাইলে, আইন চলুক না, স্বাভাবিক গতিতে। এই ইট কাঠ পাথরের নরকে নানা বঞ্চনার মাঝেও মানুষ অন্তত একটু স্বস্তিতে ঘুমাক।

লেখক: উন্নয়নকর্মী

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজধানীতে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অভিযোগ
রাজধানীতে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অভিযোগ
মুক্তি পাওয়া আসামির প্রবেশন মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন, অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ
মুক্তি পাওয়া আসামির প্রবেশন মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন, অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ
মতিঝিলে ফুটপাত থেকে বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার
মতিঝিলে ফুটপাত থেকে বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার
খেলাধুলার মধ্য দিয়ে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি: প্রধানমন্ত্রী
খেলাধুলার মধ্য দিয়ে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি: প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ